ভর্তি পরীক্ষা সংস্কার করবে কে?
গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ৮৫.৯৫ শতাংশ। প্রাপ্ত ফলাফলে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৮৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬২ হাজার ৪২১ জন। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮১ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন।
এছাড়া বরিশাল বোর্ডে পাসের হার ৮৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭ হাজার ৩৮৬ জন। কুমিল্লা বোর্ডে পাসের হার ৯০ দশমিক ৭, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৪ হাজার ৯৯১ জন, দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ০৬ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১১ হাজার ৮৩০ জন।
সিলেট বোর্ডে পাসের হার ৮১ দশমিক ৪০ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫৪ হাজার ৮৭১ জন। চট্টগ্রামে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১২ হাজার ৬৭০ জন। ময়মনসিংহে পাসের হার ৭৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭ হাজার ১৭৯ জন। যশোরে পাসের হার ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৮ হাজার ৭০৬ জন।
আরও জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) 'ক' ইউনিটে স্নাতক ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ ছিল। এবার 'ক' ইউনিটে মোট আসন সংখ্যা এক হাজার ৮৫১টি। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য এক হাজার ৭৭৫টি, মানবিকের জন্য ৫১টি ও ব্যবসায় শিক্ষার জন্য ২৫টি।
আরও পড়ুন >>> নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা কোথায়?
ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছেন ১১ হাজার ১০৯ জন। তাদের মধ্যে ১০ হাজার ৫৫৭ জন বিজ্ঞান বিভাগের, ৫৪২ জন মানবিক ও ১০ জন ব্যবসায় শিক্ষার। মোট পরীক্ষার্থী ছিল এক লাখ ১৭ হাজার ৭৬৩ জন। তাদের মধ্যে এক লাখ ১৪ হাজার ৫০ জন বিজ্ঞান বিভাগের, ৩ হাজার ৩৮০ জন মানবিক ও ৩৩৩ জন ব্যবসায় শিক্ষার। (ডেইলি স্টার, ৫ জুন ২০২৩)
আমি একজন মা। সবেমাত্র আমার সন্তান উচ্চশিক্ষার সুযোগের জন্য ভর্তি যুদ্ধ শেষ করল। কী নিদারুণ এই পরীক্ষা-পরীক্ষা খেলা! আমার সন্তান দিনরাত এক করে পড়াশোনা করে। তার পরিশ্রম আর দুঃশ্চিন্তা, এই সবকিছুর আড়ালে আমাদের প্রতি তার অভিমান- সেটা আমার সবসময় চোখে পড়েছে।
মুখে না বলেও যেন অনেক কিছু বলে সে। হয়তো বলছে, মা আর পারছি না আর ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আমি তো অসহায় তাকে বলতে পারছি না, ‘এটাই শেষ; যা তুই এবার বই-খাতা রেখে টিভি দেখ, খেলতে যা।’
পারিনি বলতে। উল্টো বকা দিয়েছি। সারাদিন পড়-পড়-পড় করেই চলেছি। আতঙ্কে থেকেছি। কী হবে চান্স না পেলে! কী বলবে সবাই! না অন্য কিচ্ছু নয়, ‘তুই পড়। তোকে পড়তেই হবে’, না হলে যে মান সম্মান থাকবে না।
হায়রে কতকিছু ভেবে সন্তানকে সারাদিন বকেছি। কী হয়েছে তাতে? আমি আমার সন্তানের কাছে খারাপ হয়েছি এইতো! এতে কার-ই বা কী আসে যায়।
আমাদের দেশের এই শিক্ষাব্যবস্থা একজন শিক্ষার্থীর চিন্তা-ভাবনা, ইচ্ছা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সব শেষ করে দিচ্ছে। একজন ছেলে বা মেয়ে যখন চিন্তা করে, ছোট থেকে স্বপ্ন দেখে চিকিৎসক হওয়ার, তখন তো সে বাচ্চাটা তার সর্বস্ব দিয়েই চেষ্টা করে। এবং কেউ সফল হয়, কেউ হয় না-এটাই তো স্বাভাবিক।
যারা সফল হয়, দেশের মানুষ তো তাদেরই দেশ সেরাই মানে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা ছেলে বা মেয়ে যখন তার ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পেয়ে যায়, তখন তাকে আবার অন্য জায়গায় কেন ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। আমি এটাই বুঝতে পারিনা।
আরও পড়ুন >>> জিপিএ-৫ তৈরির কারখানা!
তবে কি সে দ্বিধায় পড়ে যায়? সে কি পড়বে নাকি নিজেকে আরেকবার মানুষের কাছে প্রমাণ করবে যে আমি সব জায়গায় সেরা। তবে কি আমরা সন্তানদের লোক দেখানোর জন্য পড়াশোনা করাই! নাকি এটাই আমাদের সিস্টেম?
মনে করুন, একজন ছাত্র বা ছাত্রী তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পেয়ে কোথাও ভর্তি যুদ্ধে টিকে গেল। সে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল। তখন দেখা গেল, তার কাছে মনে হলো থাক আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ব না, সবাই বলছে প্রকৌশল পড়াই ভালো।
তখন সে তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছেড়ে মানুষের কথায় একটা নতুন জীবন শুরু করল। এখানে তার এতদিনের ইচ্ছা বা সিদ্ধান্তর কোনো দাম নেই? এই ছেলে বা মেয়েটি ভবিষ্যতে তার জীবনের অন্য সিদ্ধান্ত কীভাবে নেবে? এর জন্য কে বা কারা দায়ী ভাবুন তো?
হ্যাঁ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবচেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে যারা মেরিট লিস্টে থাকে তারাই সব জায়গায় শুরুতে থাকে। এটাই স্বাভাবিক।
আমরা জানি ও মেনে নেই যে তারাই দেশ সেরা। কিন্তু এক জায়গা টিকে যাওয়ার পরে কেন সব জায়গায় পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করতে হয় তারাই সেরা। হ্যাঁ, বলবেন তো বুয়েটে যদি অন্য সব জায়গার পরে পরীক্ষা হয়, সেই ক্ষেত্রে আমরা তো ঝুঁকি নিতে পারি না! হ্যাঁ সত্যিই তো।
কেন বুয়েটে সবার আগে পরীক্ষা হয় না? আমাদের দেশের সিস্টেমটা কেন এমন? কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তো এত আগে পরীক্ষা নেয় যে বাচ্চারা সেখানে পড়বে না জেনেও ভর্তি হয়ে যায়। কারণ ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।
আরও পড়ুন : সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি?
শুধু ভর্তি নিয়েই ক্ষান্ত হন না, ক্লাস-পরীক্ষাও শুরু করে দেন তারা। কিন্তু পরে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেয়ে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি বাতিল করেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তখন যে আসন শূন্য হয়, তখন কী করে সেই আসন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পূরণ করে? এভাবে আরেকজন শিক্ষার্থীর সুযোগ নষ্ট হচ্ছে।
ক্লাস-পরীক্ষা শুরুর পরেও সিট খালি হওয়া সাপেক্ষে আবার ভর্তি করা হয়। এরমধ্যে আরেকজন শিক্ষার্থীকে নানান রকম ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সেই ধাক্কা শুধু ঐ শিক্ষার্থীই জানে। এই সবকিছুর জন্য শুধুমাত্র আমাদের খামখেয়ালি দায়ী। একটা বা দুইটা পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করা যেতে পারে।
আমার সন্তানের এই ভর্তি যুদ্ধে তার সাথে সাথে আমিও কত কিছু দেখলাম। বুয়েট লিখিত পরীক্ষার দিন এক অভিভাবক জানাচ্ছেন, তার সন্তান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে চান্স পেয়েছে এবং সে আইবিএতেই পড়বে।
আমার প্রশ্ন ছিল, তবে কেন এই পরীক্ষা? অভিভাবকের উত্তর, ‘আমার সন্তান যে বুয়েটেও পড়ার যোগ্যতা রাখে প্রমাণ করতে হবে না?’ এ কেমন প্রমাণ? কার কাছে প্রমাণ? বার বার কেন প্রমাণ? কীসের প্রমাণ ? তবে কি আমরা সন্তানদের শুধু মানুষকে দেখানোর জন্যই পড়াশোনা করাচ্ছি?
হায়, আমাদের শিক্ষা। ভর্তি পরীক্ষার সময় লক্ষ্য করলাম, আরেক অভিভাবক জানাচ্ছে, ‘আমার সন্তান তো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, গুচ্ছভর্তি পরীক্ষা, সবখানে মেরিট লিস্টে টিকেছে। এখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকলেই হয়।’ আমার মনে হয় সবজায়গায় পড়ানোর সুযোগ থাকলে আমরা বাবা মা’রা তাই করতাম।
একি স্বপ্ন পূরণ? না অসুস্থ এক প্রতিযোগিতায় নেমেছি আমরা আমাদের সন্তানদের নিয়ে। দেশে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার জন্য যেমন একটাই পরীক্ষা দিতে হয়, আমার মনে হয় প্রকৌশল ও অন্যান্য ভর্তি সব এক পরীক্ষার আওতায় আনা উচিত। সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসাথে পরীক্ষা নেওয়া কি খুব কঠিন? বদলাতে হবে আমাদের সিস্টেম, বদলাতে হবে আমাদের মননকে।
ইয়াসমিন হক রলি ।। ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার