ভারতের চন্দ্রযান, মহাকাশ গবেষণা ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট
১৯৬৯ সাল। চাঁদের বুকে প্রথম মানুষের পা পড়ে। এরপর চন্দ্রমুখী হতে তেমন আগ্রহী ছিল না পরাশক্তিরা। কিন্তু গেল ১০ বছরে আবারও চাঁদের বুকে কোন দেশের পতাকা উড়বে তা নিয়ে যেন অঘোষিত লড়াই চলছে। আমেরিকা তো আছে, সেই দলে জাপান, চীন কিংবা আমাদের প্রতিবেশি ভারতের আগ্রহ বেশ খেয়াল করা যাচ্ছে।
১৪ জুলাই চন্দ্রযান-৩ উৎক্ষেপণ করেছে ভারত। হাজারও কিশোর-কিশোরীর সামনেই সতীশ ধাওয়ান মহাকাশকেন্দ্র থেকে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) নভোযানটি উৎক্ষেপণ করে। স্থানীয় সময় বেলা ২টা ৩৫ মিনিটে দেশটির অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যের শ্রীহরিকোটায় অবস্থিত সতীশ ধাওয়ান মহাকাশকেন্দ্র থেকে নভোযানটি উৎক্ষেপণ করা হয়।
নিজেদের তৈরি নভোযানটি চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণে সফল হলে ভারত হবে চন্দ্রপৃষ্ঠে নভোযান নামানো চতুর্থ দেশ। এর আগে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন চন্দ্রপৃষ্ঠে নভোযান অবতরণ করেছে। চন্দ্রযান-৩–এর পৃথিবী থেকে চন্দ্রপৃষ্ঠে পৌঁছাতে এক মাসের মতো সময় লাগতে পারে। সবকিছু ঠিক থাকলে এটি আগামী ২৩ আগস্ট চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করবে।
অবতরণের পর এটি চন্দ্রপৃষ্ঠে এক চান্দ্রদিবস পর্যন্ত কার্যক্রম চালাবে। এক চান্দ্রদিবস মানে পৃথিবীর ১৪ দিনের সমান। ৪৩ দশমিক ৫ মিটার বা ১৪৩ ফুট দীর্ঘ মার্ক-৩ নামের একটি রকেট চন্দ্রযান-৩ চাঁদের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডারের নাম ‘বিক্রম’ আর রোভারের নাম ‘প্রজ্ঞান’।
আরও পড়ুন >>> সাইবার বুলিংয়ের শিকার শিশু থেকে তারকা : সমাধান কোথায়?
শুরুতে চাঁদের দক্ষিণ অংশে অবতরণ করবে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। বিক্রম সফলভাবে অবতরণ করতে পারলে এটি ‘প্রজ্ঞান’ নামের রোভারটিকে ছাড়বে। আর এই রোভারই চাঁদের বুকে ঘুরে ঘুরে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাবে।
২০১৯ সালের ইসরোর চন্দ্রযান-২ চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণে ব্যর্থ হয়েছিল। অভিযানে পাঠানো অরবিটারটি এখনো চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। তাই এবারের অভিযানে ইসরো চাঁদের কক্ষপথে নতুন কোনো অরবিটার পাঠায়নি।
চাঁদের মাটিতে নামতে কক্ষপথে থাকা চন্দ্রযান-২–এর অরবিটারের সাহায্য নেবে চন্দ্রযান-৩–এর সঙ্গে যাওয়া ল্যান্ডার ও রোভারটি। চন্দ্রপৃষ্ঠে এই অভিযানের উদ্দেশ্য সেখানে নিরাপদ ও সহজ অবতরণের সক্ষমতা অর্জন, ‘প্রজ্ঞান’ রোভারের চন্দ্রপৃষ্ঠে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ানোর সক্ষমতা যাচাই ও বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করা।
ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের চন্দ্র অভিযান নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া খেয়াল করতে হবে আমাদের। পাকিস্তানি গণমাধ্যমগুলো ভারতের চন্দ্র অভিযানকে বড় অর্জন বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে। প্রথম দুটি চন্দ্র অভিযানের ব্যর্থতার পরে আবার চাঁদে যাওয়ার অভিযানকে ভারতকে অনন্য এক স্থানে নিয়ে গিয়েছে বলে গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে। ভারত নানান প্রতিকূলতার মধ্যে মহাকাশ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। মহাকাশ কর্মসূচিতে কাজ করা বিজ্ঞানীদের ওপর ভারতের নির্ভরতা আশা জাগানিয়া।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর মহাকাশ গবেষণার উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার জন্য জাতীয় কমিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারত ১৯৬৯ সালের ১৫ আগস্ট ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO) প্রতিষ্ঠা করেছিল।
মানুষের চন্দ্রবিজয়ের মাত্র ২৫ দিনের মধ্যেই ইসরো চালু হয়। এই গবেষণা সংস্থার মূল উদ্দেশ্য মহাকাশ প্রযুক্তির বিকাশ ও মহাকাশ অধ্যয়নের জন্য গবেষণা ও জ্ঞান প্রয়োগ করা। এছাড়া বিভিন্ন খেয়াযান উৎক্ষেপণ বা উৎক্ষেপণ-উপকরণের প্রয়োজন মেটাতে কাজ করার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
আরও পড়ুন >>> ChatGPT : চ্যাটজিপিটি : যা জানা দরকার
বহুমুখী স্যাটেলাইট কক্ষপথে প্রেরণ থেকে শুরু করে কল্পবিজ্ঞানের এলিয়েন বা বহির্জাগতিক জীবন অনুসন্ধানের জন্য মহাকাশ মিশন পাঠানোর লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা এক হন ইসরোর মাধ্যমে। বর্তমানে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মহাকাশ সংস্থা এটি।
তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ভারত ইসরোকে অনেক বছর ধরেই শক্তিশালী করে তুলছে। ইসরো স্যাটেলাইট যোগাযোগ, স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং ও নেভিগেশন, রিমোট সেন্সিং, মহাকাশযান পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ, গ্রাউন্ড স্টেশন অপারেশন ও ডেটা বিশ্লেষণ এবং প্রক্রিয়াকরণে সহায়তা নির্ভর নানান কাজে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে।
চন্দ্রযান-৩ যানটি একটি রোভারের মাধ্যমে চাঁদে অন্বেষণ করবে। পাকিস্তান এরই মধ্যে ৬টি স্যাটেলাইট আকাশে প্রেরণ করেছে। সেখানে বাংলাদেশ এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ব্যবহার শুরুর কাজ। দেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’-এর ধরন নির্ধারণের জন্য ফ্রান্সের প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস (পিডব্লিউসি)-কে নিয়োগ দিয়েছে বিএসসিএল।
২০১৮ সালের ১২ মে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশের খরচ হয় ২ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ হাইব্রিড স্যাটেলাইট হতে পারে। এই স্যাটেলাইটটি আবহাওয়া, নজরদারি বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হবে।
সেই ষাটের দশকে টাটা ইন্ডাস্ট্রিজের সাহায্যে ভারতে আইটি শিল্পের বিকাশ ঘটে ১৯৬৭ সালে মুম্বাইতে। সান্তাক্রুজ ইলেকট্রনিক্স এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন নামে প্রথম সফটওয়্যার রপ্তানি অঞ্চল ১৯৭৩ সালে মুম্বাইতে যাত্রা শুরু করে। এই স্থাপনাগুলো হলো আধুনিক দিনের আইটি পার্কের অগ্রদূত।
প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে তার মহাকাশ কর্মসূচির উন্নয়নে সাহায্য করেছিল। ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর, ভারত আইটি সেক্টরে সফটওয়্যার বিকাশের ওপর আরও জোর দেয়। কংগ্রেস কিংবা বিজেপি দলের সব সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে। নানাভাবে আইটি সেক্টরকে শক্তিশালী করতে থাকে।
অন্যদিকে, সেই সময়ে এশিয়ান টাইগার হিসেবে হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ান দ্রুত শিল্পায়নে ছুটছিল। বছরে সাত শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির হারের সাথে এগিয়ে চলছিল। ইংরেজি দক্ষতা, আইটি দক্ষতা এবং সাশ্রয়ী নানান সুবিধার নিয়ে তরুণ প্রযুক্তিবিদ ও তরুণ কর্মীবাহিনী নিয়ে ভারত বিশ্বের নানান বাজারে প্রবেশ করে।
আরও পড়ুন >>> ডিজিটাল ডিভাইস ও আগামীর শিশু
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত দক্ষ বলা যায়। সারা বিশ্বেই এখন ভারতের শিক্ষিত আইটি পেশাদারদের মেধাবৃত্তিক কাজে দেখা যাচ্ছে। ভারতের বর্তমানে আইটি সেক্টরের অংশ ভারতের জিডিপির প্রায় নয় শতাংশ। ভারতের আইটি বাজারের মূল্য ১৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৫ সাল নাগাদ সাড়ে তিনশ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
এই পটভূমিতে পাকিস্তানি গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে—ভারতের চন্দ্রযান তো চাঁদের পথে, পাকিস্তানের চন্দ্রযান কোথায়? পাকিস্তানে পদার্থবিদ ও নোবেল বিজয়ী ড. আবদুস সালামের নির্দেশনায় ১৯৬১ সালে মহাকাশ গবেষণা কমিশন প্রতিষ্ঠা করে। ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাকিস্তান পারমানবিক গবেষণা চালিয়েছে অনেক বছর। সেই প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের চন্দ্রযান কোথায় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তান পারমানবিক গবেষণায় সাফল্য পেলেও সেই ধারাবাহিকতা অন্য সব ক্ষেত্রে পাকিস্তান সামগ্রিকভাবে স্থির হয়ে আছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কলহের কারণে বিকাশ কম হচ্ছে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া উল হকের দেখানো পথে এখনো যেন চলছে পাকিস্তান। ডলারে সহায়তার ওপর পাকিস্তানের অত্যধিক নির্ভরতা অনেক উদ্যোগকে পিছিয়ে দিচ্ছে। পাকিস্তান এখনো নিশ্চিত নয় যে সেইখানে কোন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। মাত্র এক বছর আগে, পাকিস্তান সবার জন্য একটি সিলেবাস চালু করার পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিল। এই প্রেক্ষিতে পাকিস্তান ভারতের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে বলে বলা যায়।
জাহিদ হোসাইন খান ।। গবেষক