চিকিৎসক কেন বাণিজ্যমুখী?
আমাদের দেশে চিকিৎসকরা একসময় পীরের মর্যাদায় আসীন ছিল। সামাজিক মর্যাদায় চিকিৎসকরা ছিল সবার ঊর্ধ্বে। তাই আজও কোনো সন্তান জন্মালে অভিভাবকরা তাকে চিকিৎসক বানানোর স্বপ্নে বিভোর থাকে।
এই স্বপ্ন দেখার মূল কারণ জনসেবা বা জনগণের সেবা। অর্থাৎ জনগণের জন্য চিকিৎসকরা যেন নিবেদিত থাকে। প্রশ্ন জাগে, চিকিৎসকদের সেই সেবামুখী মানসিকতা কি আছে? কেন আজ তারা বাণিজ্যমুখী?
শিক্ষক এবং চিকিৎসক হচ্ছে একটি জাতির আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। একটি জাতি দেউলিয়া হওয়ার শেষ সীমায় পৌঁছে, যখন সেই জাতির শিক্ষক এবং চিকিৎসক দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর এটা তখনই হয় যখন অর্থই সামাজিকভাবে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একমাত্র মাপকাঠি হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন >>> জীবন নিয়ে খেলা!
ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসহ আমাদের দেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে অর্থই একমাত্র রোল মডেল। তাই চিকিৎসকদের কেন আমরা ব্যতিক্রম ভাবছি?
চিকিৎসক কারা হয় তা নিশ্চয় আমাদের জানা আছে। ক্লাসের পেছনের সারির শিক্ষার্থীরা নিশ্চয় চিকিৎসক হয় না। বুকভরা আশা এবং মানবসেবার ব্রত নিয়ে স্কুল এবং কলেজের সেরা শিক্ষার্থীরাই তো মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়।
শিক্ষক এবং চিকিৎসক হচ্ছে একটি জাতির আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। একটি জাতি দেউলিয়া হওয়ার শেষ সীমায় পৌঁছে, যখন সেই জাতির শিক্ষক এবং চিকিৎসক দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
একদিকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক রাজনীতির বিষবাস্প, অন্যদিকে শিক্ষক ও সিনিয়র শিক্ষার্থীর হতাশা দেখে অল্প দিনেই বুঝে যায় যে চিকিৎসক পেশা আর আগের মর্যাদায় নেই। আর এই পেশায় ক্যারিয়ার গঠনও সহজ নয়। ফলে এক ধরনের হতাশাই তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মানব সেবার ব্রত ক্রমেই ফিকে হতে থাকে।
শিক্ষকদের ভেতর যার প্রাইভেট প্র্যাকটিস ভালো সেই শিক্ষকই তাদের কাছে রোল মডেল হয়ে দাঁড়ায়। ৭-৮ বছরের কঠিন পরিশ্রমের পর যখন পাস করে যখন বের হয় তখন দেখে তার স্কুল এবং কলেজ জীবনের মধ্যম কিংবা পেছনের সারির বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সাধারণ বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাস করে বিসিএস-এ উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিতে যোগদান করেছে।
আরও পড়ুন >>> অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক সিলগালা : বেটার লেট দ্যান নেভার
আর একজন চিকিৎসককে টিকে থাকার জন্য ক্লিনিকে ক্লিনিকে ঘুরতে হচ্ছে ১০-১২ হাজার টাকার বেতনের একটি চাকরির জন্য। পাশাপাশি রয়েছে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি।
কোনো ফাউন্ডেশন ট্রেনিং ছাড়া চাকরিতে যোগদানের পর বড় ধাক্কা আসে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ দেখে। হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ন্যূনতম পরিবেশও নেই। অন্যদিকে, রয়েছে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট-এ ভর্তি হওয়ার বিশাল চাপ।
কেননা, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট করতে না পারলে তো কোনো ক্যারিয়ার নেই। ভাগ্য ভালো থাকলে ৫-১০ বছর পর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করে দেখতে পায় তার স্কুল জীবনের বিসিএস উত্তীর্ণ বন্ধুটি ক্যারিয়ারের মধ্যে পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কিন্তু সে আজও মেডিকেল অফিসার।
ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসহ আমাদের দেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে অর্থই একমাত্র রোল মডেল। তাই চিকিৎসকদের কেন আমরা ব্যতিক্রম ভাবছি?
কবে সে ডিপিসি'র মাধ্যমে জুনিয়র কনসালটেন্ট বা সহকারী অধ্যাপক হবে তার জন্য তদবির করতে হচ্ছে। শত চেষ্টার পরও যাদের ভাগ্যে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি জুটলো না তাদের ক্লিনিক্যাল ক্যারিয়ার গঠনের স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়।
এই অবস্থায় তাদের কারও অর্থ উপার্জনের জন্য বাণিজ্যমুখী হওয়া কি স্বাভাবিক নয়? তারপর রয়েছে ওষুধ কোম্পানির লোভনীয় প্রস্তাব। তবে সবার ক্ষেত্রে নয়, কেবল মাত্র যাদের ভালো প্রাইভেট প্র্যাকটিস গড়ে উঠেছে তাদের ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষা করে।
আরও পড়ুন >>> স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?
যে সমাজে একজন ছাত্রনেতা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন সাধারণ কর্মী, একজন পুলিশ সদস্য, ভূমি অফিসের কেরানি কিংবা একজন রাজনৈতিক কর্মী রাতারাতি শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যায় সেই সমাজে সুবিধাবঞ্চিত এবং স্কুল ও কলেজ জীবনের মধ্যম কিংবা পেছনের সারির বন্ধুর তুলনায় ক্যারিয়ারে পিছিয়ে থাকা একজন চিকিৎসকের বাণিজ্যমুখী হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?
সমাজে অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি অহরহ চলছে দেখেই সাধারণ থেকে উচ্চপদস্থ সবাই অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতিকে স্বাভাবিক ভাবছে। আদতে তা স্বাভাবিক নয়। এটা যে অপরাধ তা কারও মধ্যে আলাদাভাবে প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব ফেলছে না। এই সবকিছুর জন্য নিশ্চয় সমাজ এবং রাষ্ট্র কি দায় এড়াতে পারে?
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক