Threads vs Twitter : থ্রেডস বনাম টুইটার দ্বৈরথ
তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম উপায় হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এই যোগাযোগমাধ্যমে আমরা ছবি, ভিডিও ও তথ্য শেয়ার করার মাধ্যমে নিকটজনের সাথে কৃত্রিমভাবে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করি এবং যোগাযোগ রক্ষা করি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মধ্যে আমাদের কাছে সুপরিচিত হচ্ছে ফেসবুক (Facebook) (যেখানে আমরা আমাদের ছবি, অডিও, ভিডিওসহ সব তথ্য শেয়ার করতে পারি), টিকটক (TikTok) (যেখানে শুধুমাত্র ভিডিও শেয়ার করা যায়), ইনস্টাগ্রাম (Instagram) (যেখানে শুধুমাত্র ছবি শেয়ার করা যায়) এবং টুইটার (Twitter) (যেখানে শুধুমাত্র টেক্সট মেসেজ শেয়ার করা যায়)।
চ্যাটজিপিটি (ChatGPT) নিয়ে আলোচনা শেষ হতে না হতেই বর্তমানে যে বিষয়টি আলোচনার তুঙ্গে উঠেছে তা হলো ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম-এর স্বত্বাধিকারী সংস্থা মেটা দ্বারা তৈরিকৃত টেক্সট মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন থ্রেডস। এই অ্যাপ্লিকেশনটি যাত্রা শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন দিক থেকে একের পর এক রেকর্ড ভঙ্গ করে তার জনপ্রিয়তা জানান দিচ্ছে।
আরও পড়ুন >>> পাবজি : অনলাইন গেইমের রীতিনীতি ও অর্থনীতি
অ্যাপ্লিকেশনটি চালু হওয়ার একদিনের মধ্যেই এতে যুক্ত হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন ব্যবহারকারী এবং মাত্র পাঁচ দিনে এটি অতিক্রম করেছে একশ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর মাইলফলক যা সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত চ্যাটজিপিটি-এর রেকর্ডকেও ভঙ্গ করে দিয়েছে। এই অ্যাপ্লিকেশনটির সরাসরি প্রভাব পড়েছে একই ধরনের আরেকটি অ্যাপ্লিকেশন টুইটারের ওপর। এজন্য অনেকে একে টুইটার-কিলিং অ্যাপ্লিকেশন নামেও অভিহিত করছে।
Threads : থ্রেডস কী?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় আমরা সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি শেয়ার করি সেটি হচ্ছে স্ট্যাটাস যা মূলত একটি ক্ষুদ্র টেক্সট মেসেজকে বোঝায়। থ্রেডস হচ্ছে এমনই একটি মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন যেখানে ব্যবহারকারীরা টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে সাম্প্রতিক যেকোনো ঘটনা বা বিষয় নিয়ে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। বর্তমান বিশ্বের একশটির বেশি দেশে থ্রেডস অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা যাচ্ছে।
Threads : থ্রেডস-এর সূচনা
ইনস্টাগ্রাম ২০১৯ সালেই থ্রেডস নামক একটি অ্যাপ্লিকেশনের সূচনা করে স্ন্যাপচ্যাট (Snapchat)-এর সমধর্মী একটি অ্যাপ্লিকেশন হিসেবে যেখানে ব্যবহারকারীরা টেক্সট মেসেজের সাথে ভিডিও চ্যাট করতে পারত। কিন্তু জনপ্রিয়তার অভাবে ২০১৯ সালে অ্যাপ্লিকেশনটির ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
২০২২ সালে ইলন মাস্ক (Elon Musk) টুইটার অধিগ্রহণ করার পর থেকেই টুইটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশকিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন যেটা ব্যবহারকারীদের জন্য মোটেই স্বাচ্ছ্যন্দদায়ক ছিল না। ঠিক তখনই ফেসবুক-এর স্বত্বাধিকারী মার্ক জুকারবার্গ (Mark Zuckerberg) টুইটারের সমপর্যায়ের একটি অ্যাপ্লিকেশন চালু করার পরিকল্পনা করেন এবং এজন্য ‘প্রজেক্ট – ৯২ (Project 92)’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেন।
থ্রেডস হচ্ছে এমনই একটি মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন যেখানে ব্যবহারকারীরা টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে সাম্প্রতিক যেকোনো ঘটনা বা বিষয় নিয়ে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে।
এই প্রকল্প ২০২৩ সালের জুন মাসে থ্রেডস নামে গুগল প্লে স্টোর (Google Play Store)-এ অবমুক্ত করা হয়। থ্রেডস-এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো যেকোনো ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী নতুন কোনো তথ্য না দিয়েই সরাসরি থ্রেডস যুক্ত হতে পারছে এবং ইনস্টাগ্রাম-এর ফলোয়ারসহ সবকিছুই সেখানে নিয়ে আসতে পারছে।
Threads : থ্রেডস-এর ফিচারসমূহ
বর্তমানে যেকোনো একজন থ্রেডস ব্যবহারকারী সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দ ব্যবহার করে একটি পোষ্ট প্রদান করতে পারেন। এছাড়া তার সাথে যুক্ত করা যাবে ওয়েব লিংক, ছবি এবং ভিডিও। আর যেহেতু থ্রেডস অ্যাপ্লিকেশনটি ইনস্টাগ্রাম-এর সাথে যুক্ত, থ্রেডস-এর যেকোনো পোষ্ট খুব সহজেই ইনস্টাগ্রাম-এ শেয়ার করা যায়।
আরও পড়ুন >>> মুঠোফোনে আসক্তি বাড়ার কারণ কী?
এছাড়া অন্যান্য প্ল্যাটফর্মেও একে একটি লিংক হিসেবে শেয়ার করার সুযোগ রয়েছে। থ্রেডস ব্যবহার করে একজন ব্যবহারকারী সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট দৈর্ঘ্যের ভিডিও শেয়ার করতে পারেন। এছাড়া ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীরা তাদের ইউজার ভেরিফিকেশান স্ট্যাটাসটি এখানে সরাসরি পেয়ে যাবেন।
Threads : থ্রেডস-এর সীমাবদ্ধতা
থ্রেডস যদিও টুইটারকে সমকক্ষ বিবেচনা করে তার সাপেক্ষে অনেকগুলো ফিচারে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, এখনো বেশকিছু ক্ষেত্রে তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বর্তমানে থ্রেডস ব্যবহারকারীরা সরাসরি কোনো ধরনের মেসেজ আদান-প্রদান করতে পারে না, কোনো ট্রেন্ডিং স্টোরিস (Trending Stories) বা হ্যাশট্যাগ (# Hashtag) শেয়ার করতে পারে না।
অধিকন্তু, তারা তাদের পোষ্টগুলো এডিট বা আপডেট করতে পারে না। এছাড়া থ্রেডস ব্যবহারকারীদের বর্তমানে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি রয়েছে তা হলো যদি কোনো ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী তার থ্রেডস একাউন্টটি ডিলিট করে দিতে চান তাহলে তার ইনস্টাগ্রাম একাউন্টটিও ডিলিট হয়ে যাবে।
তবে, থ্রেডস কর্তৃপক্ষ খুব দ্রুত এই সমস্যাটি সমাধান করবেন বলে ব্যবহারকারীদের আশ্বস্ত করেছে। এছাড়া অন্যান্য সীমাবদ্ধতাগুলো তারা সীমাবদ্ধতা হিসেবে বিবেচনা না করে ব্যবসায়িক পলিসি হিসেবে বর্ণনা করেছে যেগুলো তারা সময়ের সাথে সাথে ব্যবহারকারীদের জন্য উন্মুক্ত করবে।
Threads : থ্রেডস-এর তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা
থ্রেডস-এর তুমুল জনপ্রিয়তার মধ্যেও যে বিষয়টি নিয়ে সতর্কতামূলক আলোচনা হচ্ছে তা হলো থ্রেডস-এর তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা। থ্রেডস-এর স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান মেটার তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভিযোগ রয়েছে এবং তা নিয়ে প্রচুর সমালোচনাও হয়েছে।
আরও পড়ুন >>> সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস কীভাবে ছড়ায়?
ফেসবুক কর্তৃক তার ব্যবহারকারীদের তথ্য অনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এসব কারণে থ্রেডস-এর তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন গোপনীয়তা বিশেষজ্ঞরা থ্রেডস ব্যবহারের ক্ষেত্রে এবং সেইখানে তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ প্রদান করেছেন।
Threads vs Twitter : থ্রেডস কি টুইটারের বিকল্প হতে যাচ্ছে?
থ্রেডস অ্যাপ্লিকেশনটি চালু হওয়ার পর থেকে যে বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে তাহলো থ্রেডস কি টুইটারের বিকল্প হতে চলেছে?
থ্রেডস ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীরা তাদের একাউন্টের তথ্য দিয়েই থ্রেডস-এ যুক্ত হতে পারবে। এছাড়া থ্রেডস যেহেতু ফেসবুক কর্তৃপক্ষ দ্বারা নির্মিত, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছেও তারা খুব সহজেই এর প্রচারণা চালাতে পারছে।
অপরদিকে, টুইটার হচ্ছে সর্বাধিক পরিচিত ও ব্যবহৃত টেক্সট মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন। মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে তারা সহজে যেকোনো পরিবর্তন গ্রহণ করতে পারে না অথবা চায় না।
সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যানেও দেখা গিয়েছে যে, থ্রেডস চালু হওয়ার পর টুইটারের ব্যবহার প্রায় ১১ শতাংশের মতো কমে গিয়েছে।
থ্রেডস ব্যবহার করে একজন ব্যবহারকারী সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট দৈর্ঘ্যের ভিডিও শেয়ার করতে পারেন। এছাড়া ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীরা তাদের ইউজার ভেরিফিকেশান স্ট্যাটাসটি এখানে সরাসরি পেয়ে যাবেন।
কিন্তু আমরা যদি ভুলে না যায়, ২০১১ সালের দিকে গুগল কর্তৃপক্ষ ‘গুগল+ (Google+)’ নামে একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে আসে যাকেও একটি ‘ফেসবুক কিলার (Facebook killer)’ অ্যাপ্লিকেশন নামে অভিহিত করা হয়েছিল।
এটিও প্রথম বছরেই প্রায় ৯০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু সেই অ্যাপ্লিকেশনটি ২০১৯ সালে এসে বন্ধ করে দেওয়া হয় যথেষ্ট সংখ্যক ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে না পারার কারণে। সুতরাং সাম্প্রতিক সাফল্য দিয়ে ভবিষ্যতের গতিপথ বিবেচনা করা হয়তো এইক্ষেত্রে সঠিক নির্দেশনা নাও প্রদান করতে পারে।
আরও পড়ুন >>> সাইবার বুলিংয়ের শিকার শিশু থেকে তারকা : সমাধান কোথায়?
যদিও বর্তমান সময়ে টুইটার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তার ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে। এছাড়া সমধর্মী দুটি অ্যাপ্লিকেশনের সামর্থ্য জানান দিতে তাদের স্বত্বাধিকারীরা (ইলন মাস্ক ও মার্ক জুকারবার্গ) এক প্রকার বাগযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন।
এছাড়া টুইটার কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই থ্রেডস-এর বিরুদ্ধে তার সাবেক কর্মচারীদের ব্যবহার করে ব্যবসায়িক গোপনীয় তথ্য চুরির অভিযোগ করে আসছে এবং এই বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়েছে।
ফলে কোন অ্যাপ্লিকেশনটি ভবিষ্যতের টেক্সট মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন প্ল্যাটফর্ম হবে তা হয়তো সময়ই বলতে পারবে। তবে যেহেতু থ্রেডস এবং টুইটার উভয়ই সমধর্মী টেক্সট মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন, তাই এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, থ্রেডস টুইটারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। তবে, যে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দিয়ে সর্বাধিক সুবিধা প্রদান করবে ব্যবহারকারীরা সেইটিই বেছে নেবে।
ড. সজীব সাহা ।। সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়