নেতৃত্বের প্রশ্ন এবং এক অন্ধকার পরিষদের কাহিনি
দৃশ্যপট ১ : একদা একজন সম্ভাবনাময় (ছাত্র) নেতা বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী থেকে যান্ত্রিক জলযান যোগে রাজধানী ঢাকায় এসেছিলেন। ভাগ্যান্বেষণে যখন তিনি রাজধানী ঢাকা আসার জন্য জলযান থেকে অবতরণ করেছিলেন তখন ‘পদ্মা সেতু’ হয়নি। ‘পদ্মা সেতু’ নাই অতএব জলযান ছাড়া আর উপায়ই বা কী ছিল? বুঝলাম, তখন ‘পদ্মা সেতু’ ছিল না, কিন্তু ‘পদ্মা সেতু’ নির্মাণে সাহসিকতা সম্পন্ন কোনো নেতাও কি ছিলেন না?
নেতা তো অনেকেই ছিলেন! কিন্তু বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দুর্ভাগা বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নেতৃত্ব দিতে সক্ষম এমন নেতা কি ছিলেন? ‘শেখ হাসিনা’ ছাড়া এমন নেতৃত্ব কি এখনো আছেন? অথবা বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো নেতৃত্ব কি আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, ‘না’।
দৃশ্যপট ২ : ঢাকাস্থ ফিলিস্তিন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যের মর্মার্থ হলো, বিদেশি গোপন সংস্থা থেকে টাকা নেওয়া মানুষ কখনো নেতা হতে পারে না। এই ধরনের নেতা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, একটি প্রশ্ন ও মানুষের অধিকার নিয়ে রাজনীতি করার কথা বলে ‘গণ অধিকার পরিষদ’ নামের একটি সংগঠনের অন্ধকারের কাহিনি নিয়ে বর্তমান লেখার অবয়ব বিন্যস্ত হয়েছে।
দৃশ্যপট ৩ : পছন্দ করার মতো নেতৃত্ব বাছাইয়ের চ্যালেঞ্জ সংবলিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ‘নিঃস্বার্থভাবে দেশের জন্য কাজ করবে- এমন একটি মানুষ দেখান। সেই রকম কোনো নেতৃত্ব আপনারা যদি দেখাতে পারেন আমার কোনো আপত্তি নাই।’ নেতৃত্ব সন্ধানের এই চ্যালেঞ্জ জাতির সামনে ছুঁড়ে দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ভাগ্যের লক্ষ্যে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য এটিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন।
আরও পড়ুন >>> অর্জন অনেক, চ্যালেঞ্জও কম নয়
অপর দিকে, ‘এক অন্ধকার পরিষদের কাহিনি’ হচ্ছে ‘গণ’ এবং ‘অধিকার’ যুক্ত ‘পরিষদ’ এর কাহিনি। প্রশ্ন উঠতে পারে কেন ‘অধিকার’ শব্দটিকে স্থলাভিষিক্ত করা হলো ‘অন্ধকার’ শব্দ দিয়ে। এইসব কৌতূহলের ব্যাখ্যা ও নেতৃত্বের প্রশ্ন এবং আলোচিত এই অন্ধকার পরিষদের কাহিনির ভিত্তিতেই বর্তমান লেখা!
বোধ করি, নেতৃত্ব সম্পর্কিত প্রশ্ন তোলার সময় রূপপুর পারমানবিক কেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা সমুদ্র বন্দর, মেট্রোরেল, দারিদ্র্য কমিয়ে আনা, বিনামূল্যে করোনার টিকা দেওয়া, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখা প্রভৃতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করেছিলেন।
এর পাশাপাশি, যেহেতু দক্ষিণাঞ্চলের অর্থাৎ পটুয়াখালীর গলাচিপায় জন্মগ্রহণকারী পরিষদ নেতার কথা এখানে বলা হচ্ছে সেহেতু, এটি মনে করা প্রাসঙ্গিক যে, ‘পদ্মা সেতু’ নির্মাণের মতো সাহসিকতার গুণাবলীসম্পন্ন নেতৃত্বের কথাই বঙ্গবন্ধু কন্যা ২৫ জুন ২০২৩ রাতে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের বাজেট বক্তৃতায় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আর আমরা এখন বাংলাদেশে সেই চ্যালেঞ্জের অর্থাৎ উপযুক্ত নেতৃত্বের সম্ভাব্য প্রাপ্যতা বা দুষ্প্রাপ্যতা যাচাই করছি।
যা হোক, উপরের দৃশ্যপট ১ অনুসারে রাজধানীতে আসার জন্য পুরো একটা রাত দক্ষিণাঞ্চলের কথিত নেতাকে কাটাতে হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকাগামী জলযানে। অপরদিকে, পদ্মা সেতু না থাকলেও সেই সময় কিন্তু ‘পদ্মা সেতু’ গড়ে তোলার জন্য দৃঢ়তা ও সাহসী নেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তখন ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী সংগ্রাম করছিলেন।
বাংলাদেশের সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেই সময়ের শাসককুল তার পিতা, মাতা, ভাই, বোনসহ ১৮জন হত্যা করেছে, কারাগারের অন্ধকারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেছে। তাকে দেশে ফিরতে বাধা দিয়েছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কস্থ পৈতৃক বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা তৎকালীন সরকারের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট লোকজন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কাণ্ডারি এই নেতৃত্বকে হত্যা করার লক্ষ্যে ১৯ বারের বেশি আক্রমণ করেছে। এতসব ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার’ অতিক্রম করে আজ বাংলাদেশকে উন্নয়নের দিকে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা। এ তো গেল আলোর দিকে যাত্রার কথা! এর বিপরীতে এইবার সেই অন্ধকার পরিষদের কাহিনি!
ছাত্রলীগ, ছাত্র অধিকার পরিষদ, কোটা সংস্কার আন্দোলন। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল কিন্তু ‘ধরলেই পাওয়া যায়’ তাই লোভ সামলানোও বেশ মুশকিলের কাজ! বরঞ্চ ‘ধরলেই’ লাভ! তাই হয়তো তিনি ধরেই ফেললেন। বলা হচ্ছে ৪০০ কোটি টাকা। কোথা থেকে, কেমন করে। তা জানার জন্য ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদানের বক্তব্যের শরণাপন্ন হতে হবে।
আরও পড়ুন >>> বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং বাংলাদেশ
পটুয়াখালী থেকে ঢাকা সেখান থেকে সোজা মধ্যপ্রাচ্য। পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রটি ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব তীরে ও লোহিত সাগরের উত্তর তীরে অবস্থিত। এই দেশটির উত্তর স্থলসীমান্তে লেবানন, উত্তর-পূর্বে সিরিয়া, পূর্বে জর্দান ও ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত ভূখণ্ড পশ্চিম তীর, পশ্চিমে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজা উপত্যকা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে মিশর অবস্থিত।
এই দেশটি ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে একটি ছোট, সংকীর্ণ, আধা-শুষ্ক দেশ। এটি প্রায় ৩৫ শতাব্দী আগে ইতিহাসে প্রবেশ করেছিল যখন এই গোষ্ঠীর জনগণ তার যাযাবর জীবনযাপন ত্যাগ করেছিল, ভূমিতে বসতি স্থাপন করেছিল এবং একটি জাতিতে পরিণত হয়েছিল।
এটি এখন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের আছে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা। আর এই গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে কোনো এক অজানা ‘টাস্কের’ দায়িত্ব পালন করছেন গণ অধিকার পরিষদ। যা প্রকৃত পক্ষে এই পরিষদের সাথে ‘অধিকার’-এর পরিবর্তে ‘অন্ধকার’ শব্দ যুক্ত হতে সাহায্য করেছে।
বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত ছাত্র আন্দোলন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় কথিত এই নেতা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্যতম যুগ্ম-আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের মুহসিন হলের উপ-মানব উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। স্কুল জীবনে তিনি ছাত্রলীগের স্কুল কমিটির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি বিতর্ক, অভিনয়সহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
উপরে উল্লিখিত মধ্য প্রাচ্যের একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদ দক্ষিণাঞ্চল থেকে আগত নেতা তিন দফা বৈঠক করার কথা প্রকাশ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে আগত এই নেতা কাতার, দুবাই ও ভারতে তিন দফায় মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী রাষ্ট্রে ততধিক প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার সাথে বৈঠক করেছেন। সম্প্রতি ঢাকার ফিলিস্তিন দূতাবাসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত একথা প্রকাশ করেন।
রোহিঙ্গাদের জন্য ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা ওআইসির খাদ্য সহায়তা অবহিত করতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ঢাকার ফিলিস্তিন দূতাবাস। ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত বলেন, গণপরিষদের এই নেতার সঙ্গে কাতার, দুবাই ও ভারতে তিন দফা বৈঠক হয়েছে ওই গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে। আমাদের (ফিলিস্তিনি) গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আমরা বৈঠকের ছবি পেয়েছি।
আরও পড়ুন >>> আমেরিকার প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য কতটা উপকারী?
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূত বলছেন, কাতার বিশ্বকাপের সময় (২০২২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত) বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। মধ্যপ্রাচ্যের একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চল থেকে আগত ওই নেতার বৈঠকের বিষয়ে তিনি যদি অস্বীকার করে থাকেন, তা ফিলিস্তিনের জন্য ভালো!
তবে বিষয়টি সত্য হলে এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। রাষ্ট্রদূত রামাদান বলেন, ‘বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে টাকা নেওয়া মানুষ কখনো নেতা হতে পারে না। এই ধরনের নেতা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।’
এই সময় রোহিঙ্গাদের খাদ্য সংকট রয়েছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গারা এখন খাদ্য সংকটে রয়েছে। ওআইসি ৪ হাজার রোহিঙ্গাকে খাদ্য সহায়তা দেবে। এদিকে মোসাদের এজেন্টের সঙ্গে ডাকসুর সাবেক ভিপির বৈঠক নিয়ে তার রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদে চলছে তোলপাড়।
ওই বৈঠক শেষে ডাকসুর সাবেক ভিপি মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন তারই দলের সদস্যরা। দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়াও এই অভিযোগ তুলেছেন। এবার ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত গোয়েন্দা সংস্থা-গণপরিষদ শীর্ষ নেতার বৈঠক হওয়ার খবর প্রকাশ করলেন।
এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুবাইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যের সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদ নেতার ছবিসহ বৈঠকের তথ্য ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও গণ অধিকার পরিষদ নেতা বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন। তিনি বলছেন, ‘এটি তার এডিট করা ছবি।’
জনগণের সামনে মানে হলো প্রকাশ্যে বা আলোতে আনা। জনগণের সমক্ষে আনা বললে আলোতে আনা বোঝায়। আলোর বিপরীতে আছে অন্ধকার। যখন কোনো সংগঠনের নাম হয় ‘গণ অধিকার পরিষদ’ তখন বুঝতে হবে এর যা কিছু সবই প্রকাশ্যে বা আলোর মাঝে।
একই সাথে গণমানুষের অধিকার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গঠিত একটি সংগঠন যাকে বলা হচ্ছে ‘পরিষদ’। গণ অধিকার পরিষদ। এই নামটির অ্যাটেমলজিক্যাল বা ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ব্যাখ্যা করলে জনমানুষের অধিকার সম্পর্কিত একটি সংগঠন হিসেবে এর পরিচিতিটা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু উপরের আলোচনায় আমরা পেলাম এক ‘অন্ধকার’ জগতের কাহিনি। গণ অধিকারের এই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে জনগণের সামনে শেষ ভরসা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প নেই।
অধ্যাপক অরুণ কুমার গোস্বামী ।। পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা; সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়