পদ্মায় স্বর্ণ সেতুর এক বছর
২০২২ সালের ২৫ জুন মহা আড়ম্বরে উদ্বোধন হয়েছিল বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এই একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে একেবারে উদ্বোধন পর্যন্ত নানা রকম নাটকীয় ঘটনা, নানা উত্থান পতন, রাজনৈতিক বাদানুবাদ—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এক ভিন্ন ব্যঞ্জনা। ফিরে দেখা যেতে পারে সেইসব দিন। স্মরণ করা যেতে পারে অনেক অনেক ঘটনা অনুঘটনার কিছু খণ্ড চিত্র।
২৭ মে ২০২২। পদ্মা সেতু উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পাতায় একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং অর্থনীতিবিদ ড. মশিউর রহমান। সেখানে কথা বলার এক পর্যায়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। কান্নায় ভেঙে পড়েন! সেইদিন কেন ড. মশিউরের চোখে জল ছিল?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে পেছন ফিরতে হবে। ড. মশিউর রহমান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা। পদ্মা সেতুতে কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ যখন তোলা হয় তখন—যারা সমালোচনাকারীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ড. মশিউর রহমান। এছাড়া তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং সেতু সচিব মোশাররফ হোসেনকেও মিথ্যা অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়। তাকে জেলের ঘানি পর্যন্ত টানতে হয়েছে।
আরও পড়ুন >>> পদ্মা সেতু : পর্যটন সম্ভাবনার নতুন করিডর
তো, শুরু করেছিলাম ড. মশিউর রহমানকে দিয়ে। পদ্মা সেতু নিয়ে নানা মহলের সমালোচনায় বিদ্ধ ড. মশিউর রহমান সেই সময় গণমাধ্যমে আর্তি জানান, আমি আপনাদের কাছে সহানুভূতি চাই। আপনারা আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করুন। শেষমেশ বাধ্যতামূলক ছুটিতে যেতে হয় তাকে।
২০১২ সালের পাঁচই জানুয়ারি পদত্যাগ করতে হয় যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়। এরপর দফায় দফায় তাকে হাজিরা দিতে হয় দুদকে। দেড় মাস জেল খাটতে হয় সেতু সচিবকে।
২০১২ সালের ৩ ডিসেম্বর দুদক কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সৈয়দ আবুল হোসেন গণমাধ্যমে বলেছিলেন—কোনো অসৎ কাজে প্রাক্তন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন জড়িত নয়।
একটু পেছনে ফেরা যাক। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে প্রথমে এডিবি তারপর যোগ দেয় বিশ্বব্যাংক। উন্নয়ন সংস্থাগুলো যোগ দিতে থাকে অর্থায়নে। এরপর কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন থেকে সরে যেতে থাকে সংস্থাগুলো। একটার পর একটা আবদার রক্ষা করেও বিশ্বব্যাংককে ফেরানো যায়নি পদ্মায়।
পরে জানা যায়, বয়সসীমা পার হয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়ায় পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক।
২০১২ সালের ২৫ জুলাই লন্ডনে এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন—যখন (পদ্মা সেতুতে) পরামর্শক নিয়োগের বিষয় এলো, তখন একটা কোম্পানির জন্য তারা (বিশ্বব্যাংক) বারবার চাপ দিচ্ছিল সরকারকে এবং যোগাযোগমন্ত্রীকে। যেন ওই কোম্পানিকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়...
২০১২ সালের ২৫ জুলাই লন্ডনে এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন—যখন (পদ্মা সেতুতে) পরামর্শক নিয়োগের বিষয় এলো, তখন একটা কোম্পানির জন্য তারা (বিশ্বব্যাংক) বারবার চাপ দিচ্ছিল সরকারকে এবং যোগাযোগমন্ত্রীকে। যেন ওই কোম্পানিকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। এখন যদি আমি প্রশ্ন করি, বিশ্বব্যাংক কত পার্সেন্ট টাকা খেয়ে ওই কোম্পানির জন্য তদবির করেছে?
কল্পিত সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রায় দেন কানাডার আদালত। রায়ে বলা হয় পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ গালগল্প ছাড়া কিছুই নয়। তবে কল্পিত অভিযোগ শুনেই সমালোচনা আর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন দেশের রাজনীতি এবং সুশীল সমাজের কিছু মানুষ।
এই ষড়যন্ত্র শুধু যে বড়রা করেছেন তা নয়, সমাজের সাধারণ মানুষও মেতে উঠেছিলেন গুজবের অংশ হয়ে। পদ্মা সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগার গুজব এমনভাবে আক্রান্ত করেছিল যে এই গুজব ঠেকানোর জন্য আলাদাভাবে বিবৃতি দিয়ে হয়েছিল দফায় দফায়। ২০১৯ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকের ঘটনা এটি।
আরও পড়ুন >>> পদ্মায় উঠবে উন্নয়নের ঢেউ!
জুলাই মাসের গুজবের কথা আসতেই মনে পড়ে গেল রেনুর কথা। আপনাদের কি রেনুর কথা মনে আছে? তাসলিমা বেগম রেনু। ওই যে একজন নারী তার সন্তানের স্কুলের ভর্তির খবর নিতে গিয়েছিলেন বাড্ডার একটি স্কুলে। তারপর ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল এক শ্রেণির মানুষ।
২০১৯ সালের ২০ জুলাই দুপুরটা কি মেঘলা ছিল! নাকি কাঠফাটা রোদে পুড়ছিল শহরটা আজ তা মনে নেই। তবে সেদিন বৃষ্টি ছিল না। করোনার থাবা ছিল না পৃথিবী জুড়ে; বাংলাদেশ জুড়ে। সেই দিনের নগরটাও ছিল অন্য আরেকটা দিনের মতোই ট্রাফিক জ্যামে ঠাসা। রাস্তার পাশে বসেছিল শরবতওয়ালা। ছিল ভবঘুরে, মাতাল মাদকাসক্ত, কঠোর শ্রমে খেটে খাওয়া কিংবা শীতাতপ কক্ষে বসে রাজা উজির মারার ব্যস্ততা।
এই শহরের কোটি মানুষ অন্যদিনের মতোই সেদিনও বের হয়েছিলেন নিজের কাজে। খুব জরুরি একটা কাজে বের হয়েছিলেন তাসলিমা বেগম রেনুও। সন্তানের স্কুলে ভর্তির খোঁজ খবর নিতে গিয়েছিলেন বাড্ডার একটি প্রাইমারি স্কুলে। আর আমরা এই শহরের সভ্য মানুষেরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছি।
কত সহজে লিখে ফেললাম—তিন শব্দের বাক্য—পিটিয়ে মেরে ফেলেছি। অথচ মানুষরূপী হায়েনাগুলো যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রেনুর ওপর, আঘাতের পর আঘাত করে চলেছিল তার শরীর জুড়ে, তখন কেমন লেগেছিল তার? শারীরিক ব্যথা উপেক্ষা করে চোখের সামনে ভাসছিল কি প্রিয় সন্তানের মুখ? যাকে ভর্তি করাতে তিনি গিয়েছিলেন সেই স্কুলে?
শারীরিক ব্যথার পাশাপাশি তীব্র অপমানবোধ কাজ করেছে কি তার মনে? যারা তাকে আঘাতের পর আঘাত করছিল, মারের পর মার দিয়ে যাচ্ছিল সেই মানুষগুলোর সামনে দিয়েই তো তিনি স্কুলে গিয়েছিলেন। চারপাশের মানুষগুলোর হঠাৎ এমন দানব হয়ে ওঠায় কেমন অনুভূতি হয়েছিল রেনুর?
আজ আর জানার উপায় নেই। জানার উপায় সেদিনও ছিল না—২০১৯ সালের ২০ জুলাইয়ে। কারণ মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে মেরেই চলেছিল একদল পিশাচ—যাদের আমরা মানুষ নামে ডাকি! কিছু মানুষ যখন পেটাচ্ছিল রেনুকে তখন অনেকেই পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে রেকর্ড করছিল সেই ভয়াবহ নারকীয় দৃশ্য। রেনুকে বাঁচানোর জন্য, হায়েনাদের নিবৃত্ত করার জন্য এগিয়ে এলেন না কেউই। একজন মানুষও সেখানে ছিলেন না!
ঘটনার দিন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে নিথর পড়ে থাকতে দেখেছিলাম রেনুকে। ছিন্নভিন্ন জামা কাপড়, থেঁতলে যাওয়া দেহে বোঝা যাচ্ছিল মধ্যবিত্ত আভিজাত্যের ছাপ। অসংখ্য মানুষ তাকে ছেলেধরা সন্দেহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হায়েনার মতো, অথচ নিথর পড়ে থাকা দেহটার পাশে ছিল না কেউই।
স্কুলের সামনে অস্থায়ী কাঁচাবাজার শুধু বন্ধ ছিল। আশেপাশের বাকি দোকানপাট, মানুষের নিত্যদিনের ব্যস্ততা কিছুই থামেনি একটি মৃত্যুর জন্য। এক সময় পুলিশ নিয়ে যায় রেনুর মরদেহ মেডিকেলের মর্গে। ঘটনার দুইদিন পর মহাখালী রেনুর ভাইয়ের বাসায় গেলে দেখা হয় রেনুর পরীর মতো মেয়েটার সাথে। যাকে ভর্তি করানোর খোঁজ নিতেই তিনি সেইদিন গিয়েছিলেন বাড্ডার সেই স্কুলে।
আরও পড়ুন >>> পদ্মা সেতু : ‘বড় আশা’র ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে
মেয়েটা তখনো জানে না মায়ের কী নির্মম পরিণতি করেছি আমরা—এই সভ্য সমাজের মানুষেরা। মা বাইরে গিয়েছে তার জন্য চকলেট আনার জন্য—এই মিথ্যে সান্ত্বনায় মেয়েটা তখন ভুলে থাকলেও আজ সে কি জানেনি মানুষ কেমন হায়েনার মতো পিটিয়ে মেরে ফেলেছে তার নির্দোষ নিরীহ মাকে।
মাঝে মাঝে মনে হয় বাচ্চা মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু কেন জানি সাহসে কুলায় না। সে যদি প্রশ্ন করে বসে কেন এমন পরিণতি বরণ করতে হলো তার মাকে—কী জবাব দেব তখন? জবাব দেওয়ার মতো কোনো উত্তর আমার কাছে আছে কি? না, নেই! আর নেই বলেই অপরাধীর মতো পালিয়ে বেড়াই।
মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় রেনুর কথা, তার মেয়ের কথা। তার ছেলের কথা। আর মনে পড়ে রেনুর ভাইয়ের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের কথা। ভাইরাল হওয়া সেই স্ট্যাটাসটা ছিল এমন—“আমার বোন আমার চেয়ে বয়সে দশ বছরের ছোট হবে। রেনু ওর নাম। গতকাল গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ওর। ছোট বেলা হতে কিছুটা নার্ভাস প্রকৃতির রেনু ছিল খুব মেধাবী। স্কুলে কখনও দ্বিতীয় হয়নি। সব সময় ফার্স্ট গার্ল।
বাবা রেনুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন সে ডাক্তার হবে নয়তো সরকারি বিসিএস কর্মকর্তা। কিন্তু সংসার জীবনটা রেনুর সুখের হয়নি। ছোট ছোট দুটি সন্তান নিয়ে সে একাই জীবন অতিবাহিত করছিল।
সংসার ভেঙে গেছে বেশ আগেই। বাবা ও মা মারা গিয়েছেন। রেনু নিজের মতো করেই সন্তানদের ভাল স্টুডেন্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। ছোট বাচ্চাটার মাত্র চার বছর বয়স। মৃত্যুর আগের রাতে কিছুটা অস্থির দেখাচ্ছিল রেনুকে। ছোট বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য সকালে স্কুলে যাবে।
কল্পিত সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রায় দেন কানাডার আদালত। রায়ে বলা হয় পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ গালগল্প ছাড়া কিছুই নয়।
সকাল হলে বাসার কাছে প্রাইমারি স্কুলটায় ভর্তির বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই অপরিচিত দুটি বখাটে ছেলে তাকে অহেতুক প্রশ্ন করতে শুরু করলে সে নার্ভাস হয়ে যায়। রেনুর বেশ মানসিক অস্বস্তি হয় এধরনের জেরায়। সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। তার মতো সাধারণ মেয়ে সারাজীবনে চাকরি সংসার সমাজ ইত্যাকার বর্হিমুখী অনুষঙ্গকে আত্মস্থ করতে পারেনি।
তার অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য। যেমন পুলিশ, মাস্তান, ক্ষমতাবান, ডোমিনেটিং সোসাইটি, প্রভাব বিস্তারকারী মানুষজনের সামনে পড়লে সে ভাষা হারিয়ে ফেলত। কিন্তু মনে মনে সে ভাবতো অন্যরা তো বেশ মানিয়ে নিয়ে চলছে ফিরছে, সে পারছে না কেন?
আরও পড়ুন >>> পদ্মা সেতু কারিগরিভাবে কেন এত সমৃদ্ধ?
কেন এসব পরিস্থিতিতে পড়লে তার কথা বলার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে সে। কেন সে পরিষ্কার করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না, কেন সে মানুষের প্রশ্নের (অযাচিত) পরিষ্কার জবাব দিতে পারে না। কেন সে ছোট বেলায় দোষ না করেও মায়ের কড়া ধমকে চুপ করে ছিল, কেন সে স্বামীর অন্যায়েও নিঃশব্দ ছিল, কেন সে পুলিশের নাম শুনলেই অপরাধীর মতো ভয়ে নিজের মধ্যে সেঁধিয়ে পড়তো সে নিজেও জানে না।
সে ভয় পেতো চেনা পরিচিত ঢাকা শহরের এসব কিছু এইই ছিল সত্য। সেই সত্যটাই তার জীবন নিয়েছে। সেই প্রখর খরতাপের মধ্যে শত শত মানুষের কয়েকজন তাকে নৃশংস ভাবে পেটালো। পিটিয়ে তার সারা শরীর থেঁতলে দিল। শেষ নিঃশ্বাস বের হবার আগে তখনও সে তাকিয়েছিল মানুষগুলোর দিকে। রক্তমাখা মুখ, কপালের মধ্যে রক্তভেজা চুলগুলো ঘামে, রক্তে লেপ্টে আছে, সেই অবস্থায় তাকিয়েছিল মানুষের (মানুষ???!) দিকে। হয়তো শেষ মুহূর্তেও চেষ্টা করছিল গুছিয়ে কিছু বলতে…‘ভাইগো ও ভাই, আমি এখানে এসেছিলাম আমার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে।
আমি ছেলে ধরা না। আমার নাম তাসলিমা রেনু। দুটো বাচ্চা আছে আমার। আমি মরে গেলে ওদের কেউ থাকবে না। এখনো যদি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান আমি মরবো না। আমি সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে চাই। বাসায় বাচ্চাগুলো আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।’
কিন্তু বোবার মতো রেনু তাকিয়েই ছিল ঘোরলাগা চোখে। বিবশ বিহ্বল হয়ে মাটিতে পড়ে যায় রেনু। দুটি হাত চারটি হাত লাঠি হাতে ক্রমাগত পিটিয়ে পিটিয়ে শেষ করে দিলো —শুধু রেনুর জীবনটা নয়, তার সব স্বপ্ন, তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। আমার বোন রেনুর হত্যার ভিডিওটি যারা করেছেন, যারা দেখেছেন, তাদের সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ।
আপনারা সবাই অনেক গোছানো মানুষ। পরিপাটি ফিটফাট, নিরাপদ। রেনু, বোনটা আমার যদি এর ছিটেফোঁটাও স্মার্ট হতো!”
এই ঘটনার পরে রেনুর ভাগ্নে নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে পাঁচশ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করেছিলেন। পরের বছর পুলিশ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন। এর মধ্যে দুজন আসামি অপ্রাপ্তবয়স্ক। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন এক নারী। রেনুর বোন এবং ভাগ্নের করা এক রিটের প্রেক্ষিতে আদালত রুলও জারি করেছিলেন—কেন রেনুর পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না—জানতে চেয়ে।
কিন্তু কেন রেনুকে এভাবে প্রাণ দিতে হলো নির্মমভাবে? যেমনভাবে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন—পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে। আর তাতেই দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ছেলেধরা আতঙ্ক। অপরিচিত কাউকে দেখলেই দেশের অনেক জায়গায় ছেলেধরা সন্দেহে শুরু হয় গণপিটুনি।
পদ্মার বুকে তৈরি হওয়া সেতু দিয়ে প্রতিদিন পারাপার হন বহু মানুষ। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে দেওয়া এই সেতু এখন একটি পর্যটন স্থানও। যখনই কোনো কারণে পদ্মাসেতু পাড়ি দিই কিংবা ওই এলাকায় যাই, আমার খুব করে মনে পড়ে রেনুর কথা। রেনুর দীর্ঘশ্বাস কি মিশে আছে না পদ্মার বাতাসে বাতাসে!
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি