ইসির ভোট বন্ধের ক্ষমতা ও জাতীয় নির্বাচনে ভূমিকা
গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হলে নির্বাচনী অনিয়ম কম ঘটে। এই কথাটা সবাই আমরা জানি এবং বলি। বাস্তবতা হলো সেই রকম গণতন্ত্র এবং সেই রকম নির্বাচন আমরা করতে পারি না।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিজে গণতান্ত্রিক নয় বিধায় রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র ঠিকমতো চর্চা করাই হয় না। প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচনের ঘণ্টা বাজার আগেই অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির হয় প্রাক-নির্বাচনী কথার যুদ্ধ যা শেষ হয় সহিংসতা ও খুন-জখমের মধ্য দিয়ে।
আমাদের দেশে বরাবরই জাতীয় নির্বাচন যথেষ্ট চাপ এবং উদ্বেগের। সহিংসতা, বল প্রয়োগ করে ভোটকেন্দ্র বা বুথ দখল, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আধিপত্য বিস্তার সবই নির্বাচনী কারসাজির একটা কার্যকর উপায়। নির্বাচনী সন্ত্রাস ও সহিংসতার শিকার হওয়া মানুষেরা, এমনকি বিপর্যস্ত অঞ্চলের অন্য ভোটাররাও ভোট দিতে আগ্রহী হন কম। তাৎক্ষণিকভাবে তাই কমে যেতে পারে মোট ভোটদানের হার।
আরও পড়ুন >>> ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি
বিপক্ষের ভোট রুখতে সন্ত্রাসকে তাই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় অনেক ক্ষেত্রেই। আরেকটা উপায় হলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রার্থী ও তার দল চায় নির্বাচনকে নিজেদের প্রভাবে রাখতে।
গণতন্ত্রের স্বার্থে, ভোটারদের অধিকার রক্ষার স্বার্থে নির্বাচনকালীন কার্য পরিচালক হিসেবে নির্বাচন কমিশনের হাতে ক্ষমতা আছে আইন প্রয়োগের। ক্ষমতা আছে পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার। বর্তমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ তথা আরপিও অনুযায়ী, অনিয়ম বা বিরাজমান বিভিন্ন অপকর্মের কারণে নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে সেই আইনানুগ নির্বাচন করতে সক্ষম হবে না, তাহলে নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে কমিশন। সেদিকে দৃষ্টি পড়েছে এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিজে গণতান্ত্রিক নয় বিধায় রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র ঠিকমতো চর্চা করাই হয় না। প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচনের ঘণ্টা বাজার আগেই অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির হয় প্রাক-নির্বাচনী কথার যুদ্ধ যা শেষ হয় সহিংসতা ও খুন-জখমের মধ্য দিয়ে।
বলা হচ্ছে, এই ক্ষমতা সীমিত করে কমিশনকে শুধু ভোটের দিন সংসদীয় আসনের অনিয়ম ঘটা কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করতে পারার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় সংসদের কোনো আসনের নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা তুলে নিতে চাচ্ছে সরকার। যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হবে, শুধু সেসব (এক বা একাধিক) কেন্দ্রের ভোট স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা থাকবে কমিশনের হাতে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম–বল প্রয়োগের মতো কিছু ঘটলে ভোটের দিন, ভোট বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সীমিত করে জাতীয় নির্বাচন সংক্রান্ত আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী প্রস্তাব ৫ জুন ২০২৩, জাতীয় সংসদে তোলা হয়েছে। ইতিমধ্যে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, সবাই যখন একটি মেরুদণ্ডসম্পন্ন শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন চাইছে তখন কমিশন কি কিছু ক্ষমতা হারাতে বসেছে? বিলটি উত্থাপনে আপত্তি জানিয়ে সংসদে বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম।
আরও পড়ুন >>> ইভিএম ভীতি, ইভিএম রাজনীতি
তিনি বলেছেন, ‘আমরা দেখেছি, গাইবান্ধার নির্বাচন খারাপ হয়েছিল বলে কমিশন বন্ধ করে দিয়েছে। জানি না কী কারণে আইনমন্ত্রী আবার এখন আনলেন (আরপিও সংশোধনী) নির্বাচন কমিশন পুরো নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। গাইবান্ধার মতো পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার অধিকার সংশোধিত আরপিওতে নির্বাচন কমিশনের কাছে আর থাকছে না। তাদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এই স্বাধীনতা খর্বের বিষয়টি সংবিধানের চেতনা ও গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
গাইবান্ধার ঘটনার কারণেই শাসকপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিলো কি না তার স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা সরকারি দল দেয়নি। আইনমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, কোনো একটি ভোটকেন্দ্রে গণ্ডগোল হলে সেখানে ভোট বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু দু–তিনটি ভোটকেন্দ্রের গণ্ডগোলের কারণে অন্য যে কেন্দ্রগুলোয় সুষ্ঠু ভোট হয়েছে, সেইগুলোর নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে না। এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়।
নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ধারাবাহিকভাবে আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। কমিশন কতটা ঠিক, কতটা ভুল, তার অধিকারের সীমা কত দূর হওয়া দরকার তা আইনি বিবেচনা নিশ্চয়ই, রাজনৈতিক তর্কের বিষয় নয়।
আমরা জানি বিতর্ককে আমলে নেবে না সরকার। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতায় পাস করিয়ে নেবে বিল। কিন্তু কেন নেবে, কেন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা এত প্রয়োজন আওয়ামী লীগের মতো একটি সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলনকারী দলের, তা পরিষ্কার হলো না, স্বচ্ছ হলো না কারও কাছেই।
এই বিলে আরও একটি বিষয়ের ইঙ্গিত করছেন বিজ্ঞজনেরা। ‘ইলেকশন’ শব্দটিই আর থাকছে না যা দিয়ে তফশিল ঘোষণা থেকে শুরু করে গেজেট আকারে ফল ঘোষণা পর্যন্ত সময়কে বোঝাত। এখন বলা হচ্ছে ‘পোলিং’, অর্থাৎ শুধু ভোটের নির্বাচন কমিশন অনিয়মের কারণে ব্যবস্থা নিতে পারবে। এখানে তাদের ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।
আরও পড়ুন >>> জোশের লাগাম টানতে হবে
কমিশনের ক্ষমতা প্রশ্নে এই সংশোধনী উচ্চ আদালতের রায়ের সঙ্গেও যায় না। আদালতের রায় অনুযায়ী ভোটের ফলের পরও তদন্ত করে ইসি যেকোনো নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা রাখে।
এমনিতেই গত দুটি জাতীয় নির্বাচন ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা, স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় একচ্ছত্র দলীয় আধিপত্য, সহিংসতার কারণে ক্রমশ আমাদের শ্রেষ্ঠ উৎসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইছেন না নাগরিকরা। ভোটদানের হার ক্রমশ কমছে।
চমৎকার আয়োজনের পরও সদ্য সমাপ্ত গাজীপুর সিটি নির্বাচনে পুরো ৫০ শতাংশ ভোট পড়েনি। ‘নির্বাচক’দের মধ্যে যে অনীহা দেখা যাচ্ছে সেটা থেকে তাদের ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে উত্তম পন্থা মানুষকে বুঝতে দেওয়া যে, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী এবং কমিশন সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে ভালো নির্বাচন করতে সক্ষম। এখন যদি তার আইনি ক্ষমতাই কমে যায়, তবে তার করণীয় কী থাকবে সেটা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
এমনিতেই নির্বাচন কমিশনের স্বশাসন ও স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার, এবং তার যথেষ্ট কারণও আছে। একটা জন-ধারণা তৈরি হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশনের কাজে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তার সুবিধা হয় বেশি। গণতন্ত্রে প্রতিটি নির্বাচন এবং প্রতিটি ভোটার গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনারগণ সাংবিধানিক পদাধিকারী। তাদের কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ কারও ভালো অথবা খারাপ লাগতেই পারে।
নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ধারাবাহিকভাবে আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। কমিশন কতটা ঠিক, কতটা ভুল, তার অধিকারের সীমা কত দূর হওয়া দরকার তা আইনি বিবেচনা নিশ্চয়ই, রাজনৈতিক তর্কের বিষয় নয়। একটা কথা ঠিক যে, আজ নির্বাচন কমিশনকে যেভাবে সরকার ও বিরোধী দল যার যার জায়গা থেকে যেভাবে দেখে বা দেখতে চায় তা প্রত্যাশিত নয়। রাজনীতির সামগ্রিক অধঃপতনে অবশ্য সেটা কতটাই বা আশা করা যায়?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন