সংস্কারমুখী বাজেট বাস্তবায়নে প্রয়োজন সুসমন্বয়
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপিত হয়েছে মহান জাতীয় সংসদে। ০২ জুন ২০২৩ বিকেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে বাজেটের খুঁটিনাটি সম্পর্কে আরও জানা গেছে। আর পুরো মাস জুড়েই সংসদে আর সংসদের বাইরে চলবে বাজেট পর্যালোচনা।
তবে বাজেট বক্তৃতা এবং বাজেট ডকুমেন্টসগুলো প্রাথমিক পর্যালোচনার পরে আমার মনে হয়েছে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেকে যেমনটি ভাবছিলেন তেমন জনতুষ্টিবাদের পথে না গিয়ে বরং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই এই বাজেটের মূল লক্ষ্য।
নির্বাচনের বছরেও একটি সংযত ও ভবিষ্যতমুখী বাজেট দেওয়া মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটের প্রাথমিক পর্যালোচনায় মনে হয়েছে এই ভারসাম্য বজায় রাখতে বহুলাংশে সফল হয়েছেন আমাদের বাজেট প্রণেতারা। তবে পুরোপুরি সফলতা তো আসবে বাস্তবায়ন পর্যায়ে। আশা রাখবো সব অংশীজনের কার্যকর পারস্পরিক সহযোগিতায় এই বাজেট বাস্তবায়নে আমরা সফল হবো।
আরও পড়ুন >>> অর্থনৈতিক মন্দার শিকড় কোথায়?
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৫ শতাংশেরও বেশি বাড়িয়ে আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ লক্ষ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতিও ৬.৫ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতি যখন সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে সেইসময় এমন বাজেটকে প্রাথমিক বিচারে অনেকের কাছেই উচ্চাভিলাষী মনে হতে পারে। আমি তাদের সঙ্গে সবিনয়ে দ্বিমত পোষণ করি। এটিকে বরং বলা যায় সংস্কারধর্মী ও সুদূরপ্রসারী বাজেট।
বাজেটে সরকারের আয়বৃদ্ধির যে লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে তা অর্জন করা গেলে এই বাজেট বাস্তবায়নের অর্থ সরবরাহ নিয়ে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া ঋণ ও সহযোগিতা ছাড়াও আসছে অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ডের জন্য ৪ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাজেটে সরকারের আয়বৃদ্ধির যে লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে তা অর্জন করা গেলে এই বাজেট বাস্তবায়নের অর্থ সরবরাহ নিয়ে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।
কর প্রশাসনে ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে এই তুলনামূলক উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। সেজন্য রাজস্ব সংগ্রহকারী সংস্থার ডিজিটাইজেশন ও সংস্কারের প্রয়োজনীয় অঙ্গীকারও করা হয়েছে। আর সেটিই ছিল কাম্য।
প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় ২ লক্ষ ৫৮ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি এই যাত্রায় জিডিপির ৫ শতাংশের আশেপাশেই আছে (৫.১৫ শতাংশ)। এই অনুপাত সহনীয় বলা যায়। তবে এই ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে মুদ্রানীতির সঙ্গে বাজেটের সমন্বয় খুব জরুরি।
আরও পড়ুন >>> সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি!
চলতি বছরে ঘাটতি অর্থায়নে ১ লক্ষ ১৫ হাজার কেটি টাকার বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। আর আসছে অর্থবছরে এর চেয়েও আরও প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ঋণ নিতে হবে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে।
সরকার ঋণ নেওয়ার ফলে ব্যক্তি খাতের জন্য ঋণ সরবরাহে চাপ তো পড়বেই। তাই ব্যক্তি খাতের জন্য যে ঋণ সরবরাহ থাকবে তার বড় অংশই যেন উৎপাদনমুখী ও কর্মসংস্থানমুখী উদ্যোগে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এখানেই মুদ্রানীতির সঙ্গে বাজেটের সমন্বয়ের বিষয়টি জরুরি।
শুধু এক্ষেত্রেই নয়, একক মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ ও বাজারভিত্তিক সুদের হার নির্ধারণ প্রভাবিত করবে জনগণকে (বিশেষ করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান এগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হবে)। প্রাথমিক বিচারে মনে হচ্ছে মুদ্রানীতির এই দিকগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখেই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্যই বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাস শেষে গড় মূল্যস্ফীতি কিন্তু ৮ শতাংশের বেশি। তাই ৬.৫ শতাংশে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা বেশ কঠিন হবে বলেই আমার ধারণা।
একই সঙ্গে একথাটিও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্ব পণ্য বাজারে দাম ৪৩ শতাংশ কমেছে। আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতিও যেহেতু মূলত আমদানিজনিত তাই মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্যকে অবাস্তব বলছি না। তবে মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ এবং মূলত মুদ্রানীতির আওতায় পড়ে। সেজন্য তাকে নিঃসন্দেহে রক্ষণশীল ও বাজার-নির্ভর হতেই হবে।
আরও পড়ুন >>> বৈশ্বিক মন্দা ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি
তবে এই মধ্যবর্তী সময়ে কম আয়ের পরিবারগুলো সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থাও দরকার। বাজেটে তাই সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দও যতটা সম্ভব বাড়ানোর উদ্যোগ দৃশ্যমান। অনেকগুলো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও দেয় ভাতা/সুবিধা বাড়ানো হলেও অনেকে বলছেন এই বাবদ আসছে বছরের জন্য বরাদ্দ প্রয়োজনের চেয়ে বেশ খানিকটা কম হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্যই বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাস শেষে গড় মূল্যস্ফীতি কিন্তু ৮ শতাংশের বেশি।
চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ ১ লক্ষ ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি (যা সংশোধিত মোট বাজেটের প্রায় ১৮ শতাংশ)। আসছে বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি হলেও বাজেটের শতাংশ হিসেবে কমে ১৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
আমার মনে হয় আরও নতুন নতুন কর্মসূচি নেওয়া গেলে এবং বিদ্যমান কর্মসূচিগুলোর আওতায় সহায়তার পরিমাণগুলো আরও বাড়ানো গেলে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ আরও খানিকটা স্বস্তি পেত। তবে আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীদের দিক থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকা সত্ত্বেও আসছে অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ৮৪ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। একে জনস্বার্থের প্রতি নীতি-সংবেদনশীলতা হিসেবেই দেখতে হবে।
আরও পড়ুন >>> দুঃখী মানুষের বাজেটের সন্ধানে
দেড় দশক ধরে সুবিবেচনা ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি প্রণয়ন ও তার যথাসম্ভব বাস্তবায়নের জেরে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে—একথা তো মানতেই হবে। আর এই ভিত্তির জোরেই চলমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার ক্ষেত্রে অন্য অধিকাংশ অর্থনীতির চেয়ে আমরা ভালো অবস্থানে আছি।
আগামীর সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য ইতিমধ্যেই আমাদের সামনে এসেছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর পথনকশা। এই স্মার্ট বাংলাদেশ একটি দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা। ২০৪১ সাল নাগাদ যখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ সত্যিই অর্জন করা যাবে তখন আমাদের মাথাপিছু আয় হবে সাড়ে বারো হাজার ডলার।
দারিদ্র্যের হার তিন শতাংশ। চরম দারিদ্র্য শূন্য শতাংশ। অর্থনীতি হবে শতভাগ ডিজিটাল, ক্যাশলেস ও পেপারলেস। সকলেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক স্বাক্ষরতার সুবিধা পাবেন। স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে সবার দোরগোড়ায়। নগরায়ন হবে টেকসই। সমাজ হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক। প্রস্তাবিত বাজেটটি তাই আমি আশাবাদী দলিল হিসেবেই দেখছি।
ড. আতিউর রহমান ।। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর