স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট ব্যাংক ডাকাত
ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, অসির চেয়ে মসি বড় অর্থাৎ তলোয়ারের চেয়ে কলম শক্তিশালী। এতদিন এটার প্রমাণ পাইনি। তবে ইদানীং ব্যাংকিং খাতের অবস্থা দেখলে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই, আসলেই কলম শুধু তলোয়ার নয়, যেকোনো অস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী।
একসময় বিশ্বে ব্যাংক ডাকাতি একটা দারুণ অ্যাডভেঞ্চার্স অপরাধ ছিল। ব্যাংক ডাকাতদের অনেকে তারকা অপরাধীর খ্যাতি পেয়েছিলেন। ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে অনেক গল্প-সিনেমাও হয়েছে। এখন আর ব্যাংক ডাকাতির কথা শোনা যায় না। কারণ অত কষ্ট করে, ঝুঁকি নিয়ে, অস্ত্র নিয়ে ডাকাতি করতে যাওয়ার কী দরকার। কলমের খোঁচায় আপনি যদি ব্যাংক থেকে ইচ্ছামতো ঋণ পেয়ে যান, সেটা যদি শোধ না করলেও চলে; তাহলে আপনি ডাকাতি করতে যাবেন কেন? খালি আপনার মানসিকতা হতে হবে ব্যাংক ডাকাতদের মতো। ঋণখেলাপিরা আসলে হলো স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট ব্যাংক ডাকাত।
বাংলাদেশে অনেক অপরাধ হয়, দুর্নীতি হয়, ধর্ষণ হয়, খুন হয়, ক্রসফায়ার হয়। সব অপরাধীরই কিছু চক্ষুলজ্জা থাকে। অপরাধটা গোপনে করেন। প্রকাশ্যে আসার দরকার পড়লে মুখোশ পরে আসেন। কিন্তু স্মার্ট ব্যাংক ডাকাতরা কোনো মুখোশ পরেন না, তাদের কোনো লজ্জা নেই।
ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সেই টাকায় বাড়ি-গাড়ি কিনে তারা আরামে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান। এটা কীভাবে সম্ভব, আমার মাথায় ঢোকে না। এমনিতে বাংলাদেশের যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা, ঋণ দেওয়া নেওয়ার যে সিস্টেম, তাতে কোনো ঋণই খেলাপি হওয়ার কথা নয়।
বাংলাদেশে যারা হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় তারা সমাজের উঁচুতলায় বাস করেন। আইন তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না। খালি মনে একটা প্রশ্ন জাগে, কৃষকের ঋণ আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের ক্ষেত্রে এত কড়াকড়ি হলেও বড় ঋণখেলাপিরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান কীভাবে?
২০২২ সালে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ায় ১২ কৃষককে কোমরে দড়ি বেধে ধরে নিয়েছিল পুলিশ। ব্যক্তিগত লোন দেওয়া এবং আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের যে ফুল প্রুফ ব্যবস্থা, তা দেখে যে কারও মনে হতে পারে, ব্যাংকের একটি টাকাও মেরে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যিনি ঋণ নিয়েছেন, শুধু তিনি নন, তার গ্যারান্টারও ব্যাংকের ফাঁদে আটকে যাবেন।
ব্যক্তিগত লোন দেওয়ার আগে ব্যাংক অফিস-বাসায় বারবার সরেজমিন তদন্ত করে। পারলে চৌদ্দ গোষ্ঠীর ঠিকুজি খোঁজে। দুই কিস্তি বাকি পড়লেই ব্যাংক থেকে ফোনের পর ফোন আসে। অনেকের বাসায় বা অফিসে ব্যাংক থেকে মাস্তান পাঠানোর কথাও শুনেছি। টানা তিন কিস্তি বাকি পড়লে নাকি বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো-সিআইবি (Credit Information Bureau -CIB)-তে রিপোর্ট চলে যায়।
সিআইবি তালিকায় নাম থাকলে আর ঋণ পাওয়া যাবে না। আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ব্যক্তিগত কাজে ঋণ নিয়েছি। নিয়মিত তা পরিশোধও করেছি বা করছি। তাও একবার সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও আমার ঋণ আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলো। অবাক হয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে আরও অবাক হলাম।
বেশ কয়েকবছর আগে এক সহকর্মীর ঋণের আবেদনে গ্যারান্টার হয়েছিলাম। সেই ঋণটি অনিয়মিত হয়ে যাওয়ার অপরাধে আমার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। পরে তার ঋণ নিয়মিত করার পরই আমি ঋণ পেয়েছিলাম। তার মানে লুকোচুরি বা ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ঋণ আদায়ের এই কঠোর ব্যবস্থা দেখে আমি বারবার আশ্বস্ত হই।
বাংলাদেশে তাহলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। খালি মনে একটা প্রশ্ন জাগে, কৃষকের ঋণ আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের ক্ষেত্রে এত কড়াকড়ি হলেও বড় ঋণখেলাপিরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান কীভাবে? এত কঠোর আইন, আর আইনের এত কঠোর প্রয়োগ থাকার পরেও বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ লাখ কোটি ছাড়িয়ে যায় কীভাবে? তাও অনেক ছাড় দিয়ে, অবলোপন করে, পুনঃতফশিল করে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কম দেখায়। না হয় খেলাপি ঋণ তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেত।
অনেকে ভাবতে পারেন হাজার টাকা ঋণ নিলে যদি মাঠ থেকে কৃষককে ধরে দড়ি বেধে কারাগারে পাঠানো হয়, তাহলে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে না জানি কী হয়। তাদের নিশ্চয়ই ডান্ডাবেড়ি পড়িয়ে নেওয়া হবে। মজাটা এখানেই। বাংলাদেশে যারা হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় তারা সমাজের উঁচুতলায় বাস করেন। আইন তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না।
ঋণখেলাপিদের নিয়ে কথা হচ্ছে অনেকদিন ধরেই। দুর্নীতি দমন কমিশন, হাইকোর্ট, সরকারি দল, বিরোধী দল, দাতাসংস্থা—সবাই ঋণখেলাপি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। বরং পরিসংখ্যান বলছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাস সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। আর এক বছরে (এপ্রিল ২০২২ থেকে মার্চ ২০২৩) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মার্চ মাস শেষে দেশে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এই সময়ে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।
তবে নিজেদের পারফরম্যান্স ভালো দেখানোর স্বার্থে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে। আগেই যেমনটি বলেছি, ছাড় দিয়ে, অবলোপন করে, পুনঃতফশিল করে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কম দেখায়। অবলোপন করার হিসাব ধরলে ৫২ বছরে কত লাখ কোটি টাকা স্মার্ট ব্যাংক ডাকাতরা লুটে নিয়েছেন, তা ভাবলেই শিউড়ে উঠতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের সাথে আইএমএফও একমত নয়। আইএমএফ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, সন্দেহজনক ঋণ ও আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণকেও খেলাপি দেখানোর পক্ষে। সেই হিসাব ধরলে এখনই খেলাপি ঋণ হবে ৩ লাখ কোটি টাকারও বেশি।
ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার ঘটনায় কারও বড় কোনো সাজার রেকর্ড নেই। বড় খেলাপিরা জানেন, টাকা থাকলে পুলিশ-প্রশাসন, আইন-আদালত ম্যানেজ করা কোনো ব্যাপারই না। তাই তারা টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ভাবেন না।
এতদিন খেলাপি ঋণ ছিল শুধু সরকারি ব্যাংকগুলোয়। কিন্তু সর্বশেষ হিসাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় এই অশুভ থাবার বিস্তার ঘটেছে। এমনিতে ঋণ নিতে গেলে কোনো না কোনো সম্পদ ব্যাংকে বন্ধক রাখতে হয়। যাতে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে সেই সম্পদ বিক্রি করে টাকা আদায় করতে পারে। কিন্তু ব্যাংকের একটি চক্র সম্পদের অতি মূল্যায়ন করে বাড়তি ঋণ বিতরণ করেন। ফলে সম্পদ বিক্রি করে ঋণ আদায় হয় না।
আবার ঋণখেলাপিদের অনেকে আদালতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়া আটকে রাখেন। ব্যাংক যদি ঋণগ্রহীতার বন্ধকি সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করত, তাহলে খেলাপি ঋণের ঝুঁকি অনেক কমে যেত। সমস্যা হলো, ঋণ নিয়ে ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার এই চক্রে ব্যাংক কর্তৃপক্ষও জড়িত। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অধিকাংশই পারিবারিক সম্পত্তির মতো। ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে জিম্মি থাকতে হয় গোটা ব্যাংককে। সরকারি ব্যাংকগুলো তো আগে থেকেই অশুভ চক্রটি দখল করে রেখেছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার ঘটনায় কারও বড় কোনো সাজার রেকর্ড নেই। বড় খেলাপিরা জানেন, টাকা থাকলে পুলিশ-প্রশাসন, আইন-আদালত ম্যানেজ করা কোনো ব্যাপারই না। তাই তারা টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ভাবেন না। টাকা না দেওয়ার কৌশল খোঁজেন।
আইএমএফ নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবই যদি ধরি, তাহলে খেলাপি হওয়া ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা কারা নিয়েছেন তাদের তালিকা পেতে কয়েক মিনিট সময় লাগার কথা। সরকার চাইলে চিহ্নিত এই খেলাপিদের কাছ খেকে অর্থ আদায় বা তাদের আইনের আওতায় আনাও কঠিন ব্যাপার নয়। বন্ধকি সম্পত্তিতে না হলে গাড়ি-বাড়ি সব বিক্রি করে হলেও টাকা আদায় করতে হবে। জনগণের টাকা মেরে আপনি গুলশানে আরামে ঘুমাবেন, কোটি টাকার গাড়িতে চড়বেন; এটা হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। ঋণখেলাপিরা হয় কারাগারে থাকবে নয় বস্তিতে থাকবে। অপরাধীরা আরামে থাকবে কেন।
১৫ বছরে বাংলাদেশের অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। নিজেদের অর্থে আমরা পদ্মাসেতু বানাতে পারি। বিশ্ব এখন বাংলাদেশকে সমীহের চোখে দেখে। আমি খালি ভাবি সব খেলাপি ঋণ যদি আদায় করা যেত, যেটা খুবই সম্ভব এবং যদি অর্থপাচার বন্ধ করা যেত, যদি আর্থিকখাতে সুশাসন নিশ্চিত করা যেত; তাহলে বাংলাদেশ এখন আরও কতটা এগোতে পারত।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ