অনন্তলোকে ভালো থাকুন ‘মিয়া ভাই’
ঢাকাই সিনেমার যে ক’জনার নাম শুনলে শ্রদ্ধায় আর সম্মানে মানুষ অকুণ্ঠ ভালোবাসা দেখাতো তারা একে একে চলে যাচ্ছেন। না ফেরার দেশে যাওয়ার তালিকায় এতদিন ছিলেন জসিম, আনোয়ার হোসেন, হুমায়ুন ফরীদি, রাজ্জাক, এটিএম শামসুজ্জামান, কবরী ও ওয়াসিম। এদের পরে মানুষ যাদের শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন তারা হলেন—আলমগীর-সোহেল রানা-ফারুক-শাবানা-ববিতা। তাদের মধ্যে ‘মিয়া ভাই’ খ্যাত ফারুকও চলে গেলেন না ফেরার (১৫ মে ২০২৩) দেশে।
অনেকদিন যাবৎ ফারুক শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাও নিচ্ছিলেন। সবাই আশায় ছিলেন, উন্নত চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরবেন। কিন্তু আচমকা দুঃসংবাদ এলো, রূপালি পর্দার এই নায়ক রোগের কাছে হেরে গেছেন। মৃত্যুকে বরণ করেছেন।
শক্তিমান এই অভিনেতাকে আমি বা চলচ্চিত্রের প্রায় সবাই মিয়া ভাই বলে ডাকতেন। নামটিতে ছিল সাংঘাতিক জাদু। এই নামে ডেকে তাকে কতবার যে অশান্ত থেকে শান্ত হতে দেখেছি!
মিয়া ভাই কেমন মানুষ ছিলেন?
অভিনেতা হিসেবে ফারুকের মূল্যায়ন করা আমার মতো ছোট মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য। কিন্তু সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তাকে দীর্ঘসময় কাছ থেকে যতটুক দেখেছি সেই বিবেচনায় অবলীলায় বলতে পারি তিনি ছিলেন বাংলা সিনেমার অন্তপ্রাণ।
আরও পড়ুন >>> গল্প বলার স্বাধীনতা চাই
৯৭-৯৮ সালের কথা। সকাল ৭টা বলেন আর ১০টা বলেন, তার উত্তরার বাসায় যখনই যেতাম, তার বসার ঘরটিতে থাকতো মানুষ আর মানুষ। তার গ্রামের মানুষ। একেকজনের একেক রকম সমস্যা। তিনি মন দিয়ে শোনেন। জ্বলন্ত সিগারেটের ছাই অ্যাশট্রেতে রেখে একটা করে সমাধান করছেন।
ফারুক জন্মেছিলেন গ্রামে। বেড়ে উঠেছেন শহরে। বিশ্বাসী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শে। ১৯৭১-এর রণাঙ্গনের কথা বলতে বললে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মৃতিচারণ করে গেছেন।
থানার ওসিকে বলতে হবে, ফোন করছেন। ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে বলতে হবে, ফোন করছেন। মেয়ের বিয়ে-অর্থ সাহায্য প্রয়োজন, তাও করছেন। চোখে মুখে কোনো বিরিক্তর ছাপ নেই। সবাইকে বিদায় করে বলতেন, ‘আইছো? বহো। নাস্তাপানি খাও। আমি গোসল দিয়ে রেডি হয়ে আসি।’ আন্তরিকতায় মন ভরে যায়। কখনো সাদা পাঞ্জাবি-পাজামায়, আবার কখনো সুটেড-বুটেড হয়ে ফারুক ভাই সাক্ষাৎকারে বসতেন।
এই তো মনে হচ্ছে সেদিনকার কথা, তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম মাথার চুল এখনো এত কালো! ঘুটঘুটে আঁধারের মতো যেন! মিয়াভাই কী আশ্চর্য, চুলে কি কলপ দেন? চুল তো দেখি আপনার একটাও পাকেনি!
আরও পড়ুন >>> সিনেমা হোক দখিনা হাওয়ায় দুরন্ত পালতোলা নাও
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মিয়া ভাই সিগারেট জ্বালিয়ে লম্বা করে একটা টান দেন। ধোয়া ছেড়ে বললেন, ‘সবই ওপরওয়ালার দয়া। কোনোদিন তেল, কলপ, কিচ্ছু দেই নাই। সময়মতো ঘুমাই, টেনশন কম করি। আর টেনশন করেই বা কী লাভ? জীবন তো একটাই।’
সত্যিই ফারুক ভাই, আপনি যথার্থ বলেছিলেন। একজীবনে আপনি যা রেখে গেলেন, তা অম্লান হয়ে থাকবে আমাদের স্মৃতিতে।
জন্মেছিলেন গ্রামে। বেড়ে উঠেছেন শহরে। বিশ্বাসী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শে। ১৯৭১-এর রণাঙ্গনের কথা বলতে বললে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মৃতিচারণ করে গেছেন। একদিন জানতে চাইলাম, ‘মিয়া ভাই ধরেন আপনি সিনেমায় অভিনয় যদি না করতেন, তাহলে কী হতেন?’
উত্তর শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। বলেছিলেন, ‘হয়তো আমার লাশও পাওয়া যেত না।’
তিনি ছিলেন অকুতোভয় এক জীবন যোদ্ধা। জন্ম গ্রামে হলেও বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকায়। ছিলেন জেদি ও একরোখা। পাড়া মহল্লায় হৈ হুল্লোড় করে বেড়ানো এই মানুষটি নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে এইচ আকবর মঞ্চ নাটকে ফারুককে দেখে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন।
ফারুক প্রস্তাব নিলেন। ‘জলছবি (১৯৭১)’ নামে সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। নিজের জাত চেনালেন খান আতাউর রহমানের ‘সুজন সখী (১৯৭৫)’ সিনেমা দিয়ে। রূপালি পর্দার ফারুক রূপেই পরিচিতি পেলেন।
কোথাও অন্যায়-অনাচার দেখলে প্রতিবাদ করতেন। ন্যায়ের প্রশ্নে কোনো আপস ছিল না তার। তাই একের পর এক দুষ্টচক্রের চক্ষুশূলে পরিণত হন। কিন্তু আকবর খান পাঠানকে টেক্কা দেওয়ার সাহস কার?
অভিনয় শিল্পী ফারুক
‘সুজন সখী (১৯৭৫)’-এর পরে ফারুকের অভিনয়জীবনে একে একে যত সিনেমা এলো, এর বেশিরভাগই গ্রামীণ পটভূমির। পাশাপাশি শহুরে এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ছবিতেও সাফল্য পেয়ে যান। ‘নয়নমনি (১৯৭৬)’, ‘সারেং বৌ (১৯৭৮)’, ‘মিয়া ভাই (১৯৯০)’, ‘লাঠিয়াল (১৯৭৫)’, ‘পালকি (১৯৯০)’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮)’ একেকটি ছবি তো নয় যেন ৬৮ হাজার গ্রাম বাংলার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠা জীবন্ত এক ক্যানভাস।
আরও পড়ুন >>> শনিবার বিকেল : খুলে যাক রুদ্ধ দ্বার
তাকে যতদূর দেখেছি, তা নিয়ে কথা বলতে গেলে শেষ হবে না। তার অভিনয় জীবনের গল্পের শুরু আছে কোনো সমাপ্তি নেই।
‘গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮)’ সিনেমার আড়াই মিনিট, সেই দৃশ্যের কথা মনে আছে তো? আমি ঠিক জানি না এই দৃশ্যে অভিনয় করার মতো আর কোনো শিল্পী সেই সময় নির্মাতা আমজাদ হোসেন পেতেন কি না। কিন্তু ফারুককে তিনি ঠিকই পেয়েছিলেন।
প্রতিবাদী যুবক অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাকে বিষপান করানো হয়। বিষপানের যন্ত্রণা ক্যামেরার সামনে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, সেই দৃশ্য দেখে সিনেমা হলের ভেতরে চোখ মোছেননি এমন কোনো দর্শক তখন পাওয়া যায়নি।
‘সারেং বৌ (১৯৭৮)’ সিনেমার কথা মনে আছে? ফারুকের ঠোঁটে ‘ওরে ও নীল দরিয়া’ গানটি সিনেমায় দৃশ্যায়নে এলো, সেই গানটি এখনো চির সবুজ গান হয়ে আছে। সারেং চরিত্রে এমনভাবে অভিনয় করলো ফারুক যেন, ‘সুজন সখী (১৯৭৫)’-র সুজনের সাথে এই সারেংয়ের কোনো মিলই ছিল না। না অভিনয়ে না গেটাপে।
‘নয়নমনি (১৯৭৬)’-র কথা যদি বলি ‘চুল ধইরো না খোঁপা খুলে যাবে হে নাগর’ এই গানে ববিতাকে সঙ্গে নিয়ে যে অভিব্যক্তি দেখালেন, তা আজও রূপালি পর্দায় সেরা কয়েকটি দৃশ্যায়নের একটি।
এমন অভিনেতার কি মৃত্যু আছে? হয়তো জীবন প্রদীপ নিভে গেছে, কিন্তু শত বছর মিয়া ভাইয়ের এই কাজগুলো বেঁচে থাকবে।
সতীর্থদের কীভাবে দেখতেন?
খান আতা বলতে ফারুক ছিলেন অন্ধ। প্রায়ই বলতেন, বাবার পরে তার স্থান ছিল সবার আগে। আর রাজ্জাক ভাইকে তিনি যে সম্মান করতেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। বাদল খন্দকারের ‘পৃথিবী তোমার আমার (১৯৯৮)’ সিনেমায় তিনি আর রাজ্জাক ভাই একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন।
১৯৯৮ সালের কথা। এফডিসি’র কড়ইতলায় এই ছবির শুটিং সেট ছিল। একদিন দেখলাম, খাবার নিয়ে বসে আছেন। রাজ্জাক ভাই তখনো শুটিং করছেন। তার দৃশ্যায়ন শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফারুক দুপুরের খাবার মুখে তোলেননি।
আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী?
আলমগীর ভাইকে দেখতেন ভাইয়ের মতো। একদা বলছিলেন, ‘আলমগীরকে কেউ কটু বলা মানে সেটি আমাকে বলা।’
নারী অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে মন্তব্য করতে বলেছিলাম। মিয়া ভাই শাবানা-ববিতা-কবরী আপা এই তিনজনকে নিয়ে এত সুন্দর করে নিখুঁত মূল্যায়ন করলেন যে, তা এক কথায় ছিল চমৎকার।
তবে তাদের মধ্যে কবরীকে ফারুক সবসময় এগিয়ে রেখেছিলেন। বলতেন, শিল্পীর কোনো জাত নেই, কোনো রং নেই। শিল্পীরা কাদামাটি। তাদের কাজ মূল্যায়ন করার জন্য বারবার আহ্বান জানাতেন সংবাদকর্মীদের।
ফারুক নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সঙ্গে অভিনয় করতেন। সালমান শাহ-শাকিল খান-শাকিব খান-রিয়াজ-শাবনূর-পূর্ণিমা-পপি সবার সাথে অভিনয় করেছেন।
ফারুক সেটে থাকা মানেই ছিল পরিচালকদের চিন্তামুক্ত থাকা। সব শিল্পীরা সময়মতো শুটিং সেটে হাজির হতেন। মেকাপ রুমে থাকতো না কোনো টুঁ শব্দ, ছিল না চিৎকার চেঁচামেচি। ভয়ে নয়, তার প্রতি সম্মান জানিয়েই জুনিয়র শিল্পীরা এই নিয়মগুলো মেনে চলতেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে মিশে যেতেন একদম সহকর্মীর মতো। শুটিংয়ের অবসরে আড্ডা আর খোশ গল্পে যেভাবে মেতে উঠতেন, তা এখন কে করবে মিয়া ভাই?
ফারুক সেটে থাকা মানেই ছিল পরিচালকদের চিন্তামুক্ত থাকা। সব শিল্পীরা সময়মতো শুটিং সেটে হাজির হতেন। মেকাপ রুমে থাকতো না কোনো টুঁ শব্দ, ছিল না চিৎকার চেঁচামেচি। ভয়ে নয়, তার প্রতি সম্মান জানিয়েই জুনিয়র শিল্পীরা এই নিয়মগুলো মেনে চলতেন।
এফডিসিতে মাঝে মধ্যে প্রযোজক বা পরিচালকের সঙ্গে শিল্পীদের বিবাদ হতো। তার উপস্থিতি মানে অন্যায্য কথা বলার দুঃসাহস আর কেউ দেখাতো না। এই অভাব এখন কে পূরণ করবে?
সমাপ্তির পথে...
বাংলা চলচ্চিত্র দশ বছরে বড় দুঃসময় পার করছে। একের পর এক সমস্যা তৈরি হয়েছে। যৌথ প্রযোজনা নিয়ে সমস্যা, ভারতীয় সিনেমা আমদানি নিয়ে সমস্যা, এক সমিতি অন্য এক সমিতিকে বয়কট করছে—এই সময় হাল ধরলেন ফারুক আর আলমগীর। তারা দুই ভাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দিন নেই রাত নেই একটার পর একটা সমস্যার সমাধান করেছেন।
আরও পড়ুন >>> রুচির দুর্ভিক্ষের দায় কার?
দুষ্টের দমন নীতিতে থেকেছেন অবিচল। এক সময় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলেন। জাতীয় সংসদে নিজের নির্বাচনী এলাকার মানুষদের প্রয়োজনের কথা বলতে গিয়ে চলচ্চিত্রের উন্নয়নের কথা বলতে ভোলেননি। নানা রকম আবদার তুলেছেন। অনেক সুফলও আসতে শুরু করে।
এই নায়ক করোনাকাল শুরুর কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর থেকে বাংলা সিনেমার একাত্মতার বন্ধনগুলো নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে। নানারকম পটপরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে। অনেকেই আশা করেছিলেন, তিনি সুস্থ হয়ে আবার ফিরে এসে অতীতের মতো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবেন, সবাইকে আবার এক ছাতায় ছায়াতলে নিয়ে আসবেন। কিন্তু তা আর হলো না।
আর কোনোদিন এফডিসিতে তার পদচারণা থাকবে না। অন্ধকারাচ্ছন্ন ফ্লোরগুলোয় হয়তো লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন দেখা বা শোনা যাবে কিন্তু তাকে আর দেখা যাবে না। আর মিয়া ভাইয়ের সেই সুন্দর হাসিটা কেউ দেখবে না। অভিমানী সেই কণ্ঠস্বর আর কেউ শুনবে না। সমাপ্তি হলো চির সবুজ অভিনেতার পথচলা। বিদায় নিলেন এক অনন্য অভিভাবক। একইসঙ্গে আর গর্জে উঠবে না অন্যায়ের বিরুদ্ধে থাকা এক মিয়া ভাইয়ের কণ্ঠস্বর...।
কামরুজ্জামান বাবু ।। সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি