পাকিস্তান : তথাপিও মোর গুরু নিত্যানন্দ রায়!
খবরে প্রকাশ, ভুয়া বিল দেখিয়ে এক পাকিস্তানি বাংলাদেশ থেকে সাত কোটি টাকা পাকিস্তানে পাচার করেছে। এই খবর শুনে বাংলাদেশে পাকিস্তানের সমর্থকেরা বলছে, তা আর এমন কী! এর চেয়ে কত হাজারগুণ বেশি টাকা কানাডায় বা মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়েছে কিংবা ভাইয়ের টাকা ভাই নিয়েছে, সমস্যা কী?
কেউ বলছেন, ধরা পড়েছে বলে এই সাত কোটির কথা আমরা জানতে পারলাম। এই রকম বহু হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে পাচার হচ্ছে সবার অজান্তে। বাংলাদেশ থেকে সারা বিশ্বেই টাকা পাচার হচ্ছে, কারণ এখানে আর কিছু থাক বা না থাক, এখনো কিছু টাকা আছে।
২০২৩ সালের মে মাসে এসে পাকিস্তানের মুদ্রাস্ফীতি এখন ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আর কয়েক সপ্তাহ মাত্র চলার মতো বৈদেশিক মুদ্রা আছে পাকিস্তানের হাতে। ডলারের বিপরীতে বাংলা টাকার বিনিময় মূল্য যদি শ খানেক হয়, পাকিস্তানি রুপির মূল্য দুই শ ছাড়িয়ে গেছে। দেশটির এই দুর্দশার জন্য চীন দায়ী করছে পাশ্চাত্যকে, আমেরিকা যার মোড়ল।
আরও পড়ুন >>> পাকিস্তান : কান্ট্রি অব থ্রি ‘এ’
এদিকে আমেরিকা পাকিস্তানের চীনা ঋণের ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করেছে—চীনা ঋণের কারণে পাকিস্তানের অবস্থা না আবার শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে যায়! পাকিস্তানে এই মাসে খাদ্যপণ্যের দামও ইতিহাসে সর্বোচ্চ। খাদ্যপণ্যের মূল্যের বিচারে শ্রীলঙ্কার ঠিক পরেই পাকিস্তানের অবস্থান। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের দুর্দশা এখন চরমে।
যেকোনো দেশেই মুদ্রাস্ফীতির মূল্য দিতে হয় দুর্বলদের যার মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘু, ভিন্ন মতাবলম্বী ও নারী। অভাব যখন দরজা দিয়ে ঢোকে, বিবেক তখন জানালা দিয়ে পালায়।
প্রতি পাঁচ বছর পরপর পাকিস্তান বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েছে এবং সেই ঋণের টাকা কিছু অংশ দেশে নয়ছয় হয়েছে, বেশিরভাগ পাচার হয়েছে বিদেশে। চিরদিনই পাকিস্তানে অর্থাভাব ছিল।
পাকিস্তানে সংখ্যালঘুরা ভালো ছিল না কোনো কালেই। এখন তাদের জীবন নরকতুল্য। পারিবারিক সম্মান রক্ষার ঠুনকো অজুহাতে নারী হত্যা অতি সাধারণ ঘটনা। পাকিস্তানে জন-অসহিষ্ণুতা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দেশটিকে সভ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা যেতে পারে।
কয়েক বছরে কয়েক শ লোককে ধর্ম অবমাননার সত্য/মিথ্যা অভিযোগে প্রকাশ্য দিবালোকে গণপিটুনি দিয়ে বেঘোরে খুন করা হয়েছে। সম্প্রতি ইমরান খানের জনসভায় গণপিটুনির ঘটনায় জনতা এতটাই উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল যে পুলিশ মৃতের লাশ উদ্ধারের সাহস পর্যন্ত করেনি। নিহতের অপরাধ নাকি ছিল এটুকুই যে, তিনি নিজস্ব এক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম ধর্মকে ব্যাখ্যা করছিলেন যা জনতার মনঃপুত হয়নি।
আরও পড়ুন >>> জঙ্গিবাদ : যেভাবে আমরা ব্যর্থ হয়েছি
পাকিস্তানের এই দুর্দশার কারণ কী? পাকিস্তানের জন্মদাতারা—মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দিন প্রমুখ দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই দেশগঠনে মনোযোগ দেননি। এই নেতাদের না ছিল জ্ঞান, না ছিল কাণ্ডজ্ঞান।
আগের হাল যে দিকে যায়, পিছের হাল তার বিপরীত দিকে যায় না। জুলফিকার আলী ভুট্টো কিংবা আইয়ুব খান-ইয়াহিয়া খানও এমন কোনো সুস্থ মানসিকতার লোক ছিলেন না। মূলত নেতাদের অপরিণামদর্শিতার কারণে পাকিস্তান পিছিয়ে পড়েছে। সুযোগ বুঝে ব্লাডি সিভিলিয়ানদের হটিয়ে বারবার পাকিস্তানের ক্ষমতা জবরদখল করেছে সেনাবাহিনী।
প্রতি পাঁচ বছর পরপর পাকিস্তান বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েছে এবং সেই ঋণের টাকা কিছু অংশ দেশে নয়ছয় হয়েছে, বেশিরভাগ পাচার হয়েছে বিদেশে। চিরদিনই পাকিস্তানে অর্থাভাব ছিল।
তিন তিনবার ভারতের কাছে গোহারা হেরে অবশেষে আণবিক বোমার মালিক হতে গিয়েও পাকিস্তানকে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছিল। স্রেফ আমেরিকা থেকে নগদ টাকা পেতে পাকিস্তান নিজের ভূমিতে মুজাহিদিন-তালেবান ইত্যাদি সন্ত্রাসবাদী দল গঠিত হতে দিয়েছিল, বিদেশে সন্ত্রাসবাদ রপ্তানি করেছিল।
সেই সন্ত্রাসবাদ এখন বুমেরাং হয়ে পাকিস্তানকেই আঘাত করছে। এখানে ওখানে, ধর্মস্থানে, নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থানে বোমাহামলা ঘটেই চলেছে যখন তখন। এই হামলাগুলোর মধ্যে বেশকিছু আবার আত্মঘাতী। পাকিস্তান নিজেও একটি আত্মঘাতী রাষ্ট্র বটে।
অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে পাকিস্তানের যাবতীয় দুর্দশার জন্য দেশটির নেতারা চিরকাল ভারতকে দায়ী করেছেন। যদিও এর সত্যতা মেলেনি।
আরও পড়ুন >>> পাকিস্তানের বিপজ্জনক রাজনীতি
ইসলাম কায়েমের নামে ইসলাম ধর্মকে স্রেফ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন তারা। সাম্প্রদায়িকতা যদি কোনো দেশের উন্নয়নের উপাদান হতো, তবে পাকিস্তান সাত দশকে পৃথিবীর উন্নততম রাষ্ট্র হয়ে উঠত।
সাম্প্রদায়িকতা যে একটি রোগ এবং এই রোগের যে উপশম দরকার এই ব্যাপারটি পাকিস্তানের নেতারা কখনো বুঝতে চাননি, ইচ্ছে করেই। সৃষ্টিকর্তা সাধারণত শাস্তি দেওয়ার জন্য পাপীর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেন বলে গণবিশ্বাস। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তিনি ব্যতিক্রম করেছেন বলা যায়। কারণ, পাকিস্তানের জন্মকালীন নেতাদের বেশিরভাগের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি।
পাকিস্তানের যুবসমাজ নিজেদের দেশের ওপর এতটাই তিতিবিরক্ত যে অন্তর্জালে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কিছু বলার সময় ইদানীং তাদের কণ্ঠ থেকে প্রশংসা উপচে পড়ে। পাকিস্তানেও দুই-এক শহরে মেট্রো আছে, কিন্তু পাকিস্তানের ইউটিউবার-টিকটকাররা ঢাকার মেট্রোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
কী দেখে বাংলাদেশের প্রশংসা করে তারা? বাংলাদেশের নিজেরই হাজার সমস্যা আছে। এক সেনানিবাস ছাড়া অন্য কোথাও, কখনো ট্রাফিক লাইট দিয়ে গাড়ি চালানো সম্ভব হয়নি বাংলাদেশে। নিচে তিনঘণ্টা ধরে হাজার হাজার গাড়ির যানজটে জানের জেরবার। এতদসত্ত্বেও ইন্টারনেটের কল্যাণে কিছুটা জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান অর্জিত হয়ে পাকিস্তানের যুবসমাজ বুঝে গেছে, বাংলাদেশ বর্তমান পাকিস্তানের তুলনায় উজ্জ্বল। অদূর ভবিষ্যতেও উন্নয়নের বিচারে বাংলাদেশের ধারে কাছে আসার সম্ভাবনা পাকিস্তানের নেই।
আরও পড়ুন >>> টিপ পরছোস ক্যান : ব্যক্তি স্বাধীনতা কোথায়?
পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের কোনো জাতি উত্তরপথের জাতিগুলোর তুলনায় এতটা এগিয়ে যায়নি। পূর্ব ভারত চিরকাল উত্তর ভারতকে অনুকরণযোগ্য মডেল মনে করে এসেছে। মহাভারতে বলা হয়েছে, পূর্বভারতের পুণ্ড্রনগরের (বগুড়া) বাসুদেব উত্তর ভারতের শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেবের নকলে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম ধারণ করতেন এবং স্রেফ সেই স্পর্ধার শাস্তি হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ পৌণ্ড্র বাসুদেবের শিরোচ্ছেদ করেছিলেন।
পূর্ব ভারতের বেশিরভাগ দেবদেবীর চেহারা-গাত্রবর্ণ উত্তর ভারতের লোকজনের মতো। উত্তর ভারতের পোলাও-বিরিয়ানি, শেরোয়ানি, হিজাব-নিকাব, হিন্দি নাচা-গানা এখনো পূর্বভারতের মন-পছন্দ। তবুও পূর্বভারতের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ কোনো কোনো ক্ষেত্রে উত্তর ভারতের রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে নতুন বটে।
রাজনীতি-বিজ্ঞান শাস্ত্রে ‘পাকিস্তান’ একটি বিষয় হিসেবে পড়ানো উচিত। ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করতে ব্যর্থ হয়ে একটি রাষ্ট্র কীভাবে ধীরে ধীরে ব্যর্থতার পথে অগ্রসর হয়, পাকিস্তান তার উদাহরণ। কীভাবে কিছু ভণ্ড রাজনীতিক ও সেনানায়ক ধর্মের মিথ্যা জিকির তুলে নিজ নিজ আখের গোছায় এবং দেশ ও জনগণকে যুগের পর যুগ ধরে ধোঁকা দিয়ে যায়, তার উদাহরণও পাকিস্তান।
জাতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার লক্ষ্য অর্জনে একটি জনগোষ্ঠী কীভাবে স্বদেশকে খামখেয়ালিভাবে ভাগ করে, হাজার হাজার লোকের দেশত্যাগ ও হত্যার হোলিখেলায় মেতে ওঠে এবং কীভাবে অনতিবিলম্বে সেই একই জনগোষ্ঠী জাতি ও রাষ্ট্র এই উভয় লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়, পাকিস্তান তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ভূতের পা পেছন দিকে থাকে বলে জনবিশ্বাস এবং এই কারণে নাকি এগোতে গিয়েও ভূত পিছিয়ে যায়। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো দেশেরও ঠিক একই দশা।
আরও পড়ুন >>> পাকিস্তানপ্রেমী বাংলাদেশি!
ভাগ্য-স্বভাব-চেষ্টা ব্যক্তি ও জাতির উন্নতির তিন প্রধান নিয়ামক। এই তিনের যেকোনো একটিতে ঢ্যাঁড়া বা ক্রস পড়লে উন্নতি করা মুশকিল। বাঙালি জাতির ‘ভাগ্য’ ভালো, কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় বাঙালিই একমাত্র জাতি যে যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হয়েছে।
জাতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার লক্ষ্য অর্জনে একটি জনগোষ্ঠী কীভাবে স্বদেশকে খামখেয়ালিভাবে ভাগ করে, হাজার হাজার লোকের দেশত্যাগ ও হত্যার হোলিখেলায় মেতে ওঠে এবং কীভাবে অনতিবিলম্বে সেই একই জনগোষ্ঠী জাতি এবং রাষ্ট্র এই উভয় লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়, পাকিস্তান তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বাঙালি খণ্ডিত হয়েছে আবার স্বাধীনও হয়েছে। পাঞ্জাবিরা খণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান উভয় অংশে পরাধীন হয়ে রয়েছে। কিন্তু ভাগ্য ভালো হলে কী হবে, ‘স্বভাব’ যদি খারাপ হয়, ধর্মনিরপেক্ষ জাতি গঠনের ‘চেষ্টা’ যদি না থাকে, তবে বাংলাদেশেরও পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য হতে দেরি হবে না।
মানসিকতার দিক থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সিংহভাগ মানুষ হয়তো পাকিস্তানের মানুষের মতোই। স্রেফ অর্থনীতিটা ঠিকঠাক চলছে বলে হয়তো এখনো গণহারে অনার কিলিং বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গণপিটুনি কিংবা মসজিদে আত্মঘাতী বোমাবাজির মতো নৈরাজ্য শুরু হয়নি বাংলাদেশে।
‘আশা হেরি দিন গুজারি’। এক লোভী ব্যাঙ মাঠে চরতে থাকা এক বলদের রক্তিম অণ্ডকোষের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, ফলটি কবে নাগাদ তার ব্যাদিত মুখে ঝরে পড়বে।
আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশিদের এত পাকিস্তান প্রেম কেন?
হাজার চেষ্টা করেও বাঙালিদের একাংশের মাথা থেকে পাকিস্তানের ভূত নামানো যাবে না। আশা করে আছে তারা, কবে বাংলাদেশ আবার পাকিস্তান হয়ে যাবে। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর যে বাঙালি মেয়েটি নিজের গালে ‘কিস মি আফ্রিদি, মেরি মি!’ লিখে স্টেডিয়ামে গিয়েছিল, তারই পুত্র-পৌত্রেরাই তো বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের একাংশ।
পাকিস্তান তাদের জীবন-মরণের আরাধ্য, পাকিস্তানই তাদের হক মওলা, গুরু। পাকিস্তান যদি অতলে ডুবেও যায়, পাকিস্তানকে আঁকড়ে ধরে তারাও সটান ডুববে, ‘কোই পরোয়া নেহি’। ‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়, তথাপিও মোর গুরু নিত্যানন্দ রায়।’
শিশির ভট্টাচার্য্য ।। অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়