মুক্তি রাণী বর্মণের ঘটনায় বাস্তবতা কি বদলাবে?
নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলায় স্কুলছাত্রী মুক্তি রাণী বর্মণকে কুপিয়েছে হত্যাকারী মো. কাউছার মিয়া। তাকে আটক করেছে পুলিশ। কিন্তু মুক্তি আর ফিরবে না তার পরিবারের কাছে।
২ মে ২০২৩ দিনেদুপুরে বাড়ির পাশে দা দিয়ে ১৬ বছরের কিশোরী মুক্তি বর্মণকে কোপাতে শুরু করে ওই যুবক। এই সময় মুক্তির চিৎকারে লোকজন এসে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে নেত্রকোণা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
এই ঘটনায় সংবেদনশীল নাগরিক মাত্রই শিউরে উঠেছেন। কিন্তু এসব আর থামছে না। প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে নানা প্রান্ত থেকে নারী ধর্ষণ, খুন আর নিগ্রহের খবর আসছে। এগুলো এখন অতি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন >>> নারী মরে গেলেও কেন কুৎসা থামে না?
মুক্তি রাণী মারা গেছেন। অনেকে অপমান আর আঘাতের দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন। ব্যক্তিগত আঘাত বা যন্ত্রণাকে কখনো মাপা যায় না।
চিকিৎসার খরচ, মামলার খরচ, এসব অঙ্ক অর্থমূল্যে মাপা সম্ভব। কিন্তু নারীদের প্রতি সহিংসতার দাম, এমন অঙ্কের হিসাব তো বের করা যাবে না। এসব হিংসার জেরে সমাজের প্রত্যেককেই আসলে কত দাম দিতে হয় তা কোনো গণিতবিদই বের করতে পারবেন না।
নারী নিগ্রহের প্রবণতা হঠাৎ এত বেশি হয়ে গেছে এমনটা বলা যাবে না। বরং আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তি রাণীর খুনিকে দ্রুতই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর আগেও বেশকিছু ঘটনায় নারী ধর্ষণ ও নিগ্রহের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা তৎপর হয়ে অভিযুক্ত অপরাধীদের গ্রেফতার করেছে। আবার অনেক ঘটনায় তাদের নিষ্ক্রিয়তা মানুষকে হতাশ করেছে।
চিকিৎসার খরচ, মামলার খরচ, এসব অঙ্ক অর্থমূল্যে মাপা সম্ভব। কিন্তু নারীদের প্রতি সহিংসতার দাম, এমন অঙ্কের হিসাব তো বের করা যাবে না।
যখনই কোনো ঘটনা আলোচনায় আসে তখন সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে আশ্বাস দেওয়া হয় নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। শাস্তির দাবিও উঠে নানা স্তর থেকে। কিন্তু কোনটা আসলে বেশি জরুরি? নির্যাতনের শাস্তি নাকি নারীর সুরক্ষা?
বিপন্ন নারীরা বা তার পরিবার খুব কম ক্ষেত্রেই মামলা করতে চান। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, নির্যাতনের শিকার বেশিরভাগ নারী ও তাদের পরিবার ঘটনা চেপে যান। ফলে গণমাধ্যমে যেসব খবর আসে সেগুলো অনেক ঘটনার কয়েকটি মাত্র।
আরও পড়ুন >>> যার জঠরে জন্ম শিশুর
মুক্তি রাণীর বড় বোনও এই একই বখাটে কর্তৃক নিপীড়িত হয়েছিল, বিচার দিয়েও বিচার পায়নি পরিবারটি। প্রকৃত নির্যাতনের ঘটনায় থানায় মামলা করাও কঠিন।
নিম্ন আদালতের উকিলদের একাংশ ও পুলিশের আচরণ কখনোই এসব ক্ষেত্রে নারীদের পক্ষে থাকে না। তারা নানা আচরণে বারবার বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে নারীদের একটু-আধটু দোষ না থাকলে কী করে এসব ঘটনা ঘটে?
প্রেমে সাড়া না দিলেই এসিড ছুড়ে মারা, চাপাতি দিয়ে কোপানো, মেরে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার ঘটনা অনেকদিন ধরেই দেখছি আমরা। যেন প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে মানেই, পুরুষের ডাকে সাড়া দিতেই হবে। যে এলাকায় ঘটনা ঘটে, কখনো কি আমরা দেখার চেষ্টা করেছি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কী ভূমিকা রাখছে এসব ব্যাপারে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না, বা তাদের কোনো ভূমিকা চোখে পড়ে না।
আসলে আমাদের সামাজিক প্রথাই এমন যে এখানে অপরাধ করে পার পাওয়া যায় বা নেতাও হওয়া যায়। এই খুনি কাউছার মিয়াও হয়তো তেমনটাই ভাবছিল। এবং সেটা ঘটছেও আমাদের এখানে।
যে এলাকায় ঘটনা ঘটে, কখনো কি আমরা দেখার চেষ্টা করেছি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কী ভূমিকা রাখছে এসব ব্যাপারে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না, বা তাদের কোনো ভূমিকা চোখে পড়ে না।
নারীর প্রতি অশালীন উক্তি করে পদস্থ হওয়া যায়। আক্রান্ত মহিলাকে পোশাকবিধির শিক্ষা দিয়ে হিংসাকে সমর্থন জানায় যে মানুষ তাকে সামাজিক কত অনুষ্ঠানেই না প্রধান অতিথি হিসেবে দেখা যায়। নারীর প্রতি সহিংসতা উসকে দিয়েও নেতা বৃহত্তর, উন্নততর নেতায় পরিণত হওয়া যায়।
মূল অভিযুক্ত যেমন আইনের চোখে দণ্ডের যোগ্য, নারীর প্রতি সহিংসতাকে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করে নিজের দায়বদ্ধতা পালন না করে অথবা কর্তব্যের সীমা লঙ্ঘন করে, তাদেরও প্রাপ্য অপরাধীর শাস্তি ও জনমানস থেকে নির্বাসন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। কারণ আইন আর ক্ষমতা তাদের হাতেই।
সমস্যাটা বড় ও জটিল, তাই সরকার নানা সময় নানা আইন করেছে। কিন্তু শুধু আইন কি কিছু করতে পারে? নজরদারি সংস্থা, নির্দেশিকা, অনেক কিছু করা দরকার।
আরও পড়ুন >>> ২০২২ সাল নারীর জন্যে কেমন ছিল?
ভাবতে হবে, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় নারী সংগঠনগুলো সঙ্গে নিয়ে এগোতে পারে কি না। কিংবা দেখা দরকার নারী নিগ্রহের ক্ষেত্রে থানায় কখন, কোন আইনে অভিযোগ দায়ের করা যাবে, কোন ক্ষেত্রে কীভাবে এগোনো যাবে। এসবের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করা জরুরি।
কর্মক্ষেত্রে নারীর হেনস্তা রুখতে যেমন কমিটি গড়তে হয়, তেমনই সামাজিক সহিংসতা রোধে কেন সারা দেশে কয়েক নজরদারি কমিটি থাকবে না?
পাড়ায় পাড়ায় নাগরিক কমিটির মতো নারী সুরক্ষা কমিটি তৈরি হোক। তবে দেখতে হবে যাতে এই সব কমিটি পুলিশগিরির ফাঁদে না পড়ে, রাজনীতির বৃত্তে আটকে না যায়।
কেবল আইন ও বিচার নয়, সমাজের নিজের নজরদারি দিয়েই লড়াইটা করতে হবে। মুক্তি রাণীর ঘটনা বাস্তব। আরও অনেক এমন ঘটনা আছে। আমরা বাস্তব থেকে রাশি রাশি উদাহরণ দেব, বাস্তবটা বদলাবে কীসে?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন