ঈদ উৎসব : ‘বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে’
আশি-নব্বই দশকেও ঈদুল ফিতরের এক দুইদিন আগেই একটা টানটান অনিশ্চয়তা বিরাজ করতো। এবার ঈদ কবে হবে! উনত্রিশ রোজার পরে, নাকি ত্রিশ রোজার পরে! ভাবনার যেন শেষ নেই। কিন্তু সব ভাবনার অবসান ঘটাবে চাঁদ; এক ফালি অতি চিক্কন রেখার হলুদাভ চাঁদ। এজন্য ছেলেবুড়ো বিকেল থেকে অবস্থান নিতো গ্রামের প্রধান সড়কের ওপর।
সবার দৃষ্টি পশ্চিম আকাশে। চাঁদ যদি দেখা যায় তবে রাত পোহালেই ঈদ। আর যদি আজ দেখা না যায় তবে রোজা আরও একদিন বাড়বে। চাঁদও পরের দিনই উঠবে। তা যেন ধৈর্যের পরীক্ষা।
চাঁদ প্রতিমাসেই ওঠে। কিন্তু একে ঘিরে এত চোখ, এত ঔৎসুক্য বছরের আর কোনো সময় দেখা যায় না। এত বড় পশ্চিম আকাশের কোথায় উঠেছে একটি বাঁকা রেখার চন্দন-চাঁদ তা খুঁজতে অগণিত চোখ হয়রান হয়ে যেত সন্ধ্যার আকাশে। হিংগুল, কালো, নীলাভ মেঘের ভাঁজে ভাঁজে চলতো এক চিলতে চাঁদ খোঁজাখুঁজির মচ্ছব।
আরও পড়ুন >>> ঈদ ও উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে অনলাইন ব্যবসার প্রসার
একজন একবার দেখতে পারলেই হলো! কই! কোথায়, কোন মেঘের আঁড়ে, কোন সেই কোনায়! কোন গাছের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে সেই স্বর্ণাভ চাঁদ! কে দেখল প্রথম! সে তো নায়কের বাড়া। তাকে মাথায় করে একটা ছোটখাটো নাচও হয়ে যেত। যেন সে-ই ঈদের বারতা এনে দিল। সে চাঁদ না দেখলে কী করে ঈদ হতো!
মানুষ কি এখন আর এভাবে নিজেরা চাঁদ দেখে নিজেরাই ঈদ নিয়ে আসার আনন্দ পায়! আজকাল মানুষ চাঁদ দেখে মোবাইলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অথবা রেডিও-টিভিসহ গণমাধ্যমে। মানুষ এইসব দায়িত্ব যেন ছেড়ে দিয়েছে কিছু মানুষের ওপর, রাষ্ট্রের ওপর, বিভিন্ন সংঘের ওপর। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। যা বলবে তাই। কোনো রা’ হবে না।
প্রাকৃতিকভাবে চাঁদ দেখার সাথে মানুষের যে-অকৃত্রিম আনন্দের কথা বললাম তা বাংলাদেশের আশি ও নব্বইয়ের দশকের। কিন্তু এরপর থেকে আনন্দ ও উপভোগের এই ধরনটা ক্রমে উৎখাত হতে থাকে।
এই তো সেদিনও পাশাপাশি এলাকার মধ্যে অনেক সময়ই ঈদের দিনের ভিন্নতা দেখা যেত। কারণ ওই চাঁদ। কোনো কোনো গ্রামের মানুষ চাঁদ দেখেছে। কোনো কোনো এলাকার মানুষ দেখেনি। তাই ঈদের দিনের এই ভিন্নতা।
আজকাল তো একথা ভাবাই যায় না। কারণ মানুষ এখন একছাতার নিচে চলে এসেছে। পুঁজি নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীতে সব মানুষ ভার্চুয়ালি এক হয়ে গিয়েছে! মানুষও ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক পুঁজির ঘাড়গোঁজা নফরে পরিণত হয়েছে। মানুষ চাঁদ চাক্ষুষ করার ঝামেলার মধ্যে নেই। ওগুলো রাষ্ট্র, সংঘ, বিজ্ঞান দেখবে। মানুষ বরং বাজারের কোন পণ্য কীভাবে কতটা ভোগ করবে সেটা নিয়েই বেশি ব্যস্ত ও চিন্তিত থাকে। যদিও একটা শ্রেণির কাছে আবার এগুলোও ভাববার বিষয় নয়। কারণ ভোগে, বিলাসে, ব্যসনে, আদিখ্যেতায় প্রতিদিনই তাদের ঈদের দিন।
আরও পড়ুন >>> ঈদ আনন্দ : আসুক সবার ঘরে
প্রাকৃতিকভাবে চাঁদ দেখার সাথে মানুষের যে-অকৃত্রিম আনন্দের কথা বললাম তা বাংলাদেশের আশি ও নব্বইয়ের দশকের। কিন্তু এরপর থেকে আনন্দ ও উপভোগের এই ধরনটা ক্রমে উৎখাত হতে থাকে। তাহলে কি এই উৎখাত হওয়া আনন্দ মানুষ আবার ফিরিয়ে আনবে? না, মানুষ চাইলেও আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না।
‘কেঁদেও পাবে না তাকে’। কারণ কালের ধর্ম এই যে, তা সবকিছুকে পাল্টে দেয়। চোখ ও মনের রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলে। এটাই মানব জীবনের ট্রাজেডি যে, সেই অতীতে ফিরে যেতে পারে না। শুধু সাসমনের দিকে ধাবমান হতে হয়। এটা গেল ঈদের আনন্দধারার এক ধরনের পরিবর্তনের কথা। কালের বিবর্তনে আরেক ধরনের পরিবর্তনও হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
কেমন সেই পরিবর্তন? অনেকে মনে করেন, আগের দিনের ঈদের উৎসবে অনেকদূর পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানের মিলন ঘটত। বর্তমানে এটি কমে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এই ধারণাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিসরে উৎসবের আনন্দ বলি আর অন্যান্য সামাজিক-মানবিক লেনদেন বলি সবই বোধকরি জল-অচল নয়। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিসরে হিন্দু ও মুসলমানের আদান-প্রদানটা বেশ চালু আছে। আগেও ছিল।
মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক যেমন কেবল সতর্ক বাছাই-বাট্টার ব্যাপার না, তেমনি উৎসবও কখনো বেছে বেছে মানুষ নিয়ে করা যায় না।
তবে একথা সত্য যে, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা অংশ চিন্তাচেতনার দিক থেকে ক্রমাগত একটা বাইনারির দিকে ধাবিত হচ্ছে; সাদাকালোর দিকে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এই রকম একটা বাইনারি-মানসিকতা বিরাজ করলে সমাজে আদান-প্রদানের পরিসরটা কমে যায়। বর্তমান বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি যে কিছুটা তৈরি হয়নি তা নয়। কিন্তু প্রাত্যহিক সামাজিক পরিসরে সম্ভবত তা এখনো আসন গেড়ে বসেনি।
আরও পড়ুন >>> ঈদ সংখ্যার সংস্কৃতি
বর্তমানের বাইনারি মানসিকতার বিষয়টা কেমন? বর্তমান সমাজে সংস্কৃতির ধারণা নিয়ে শুধু হিন্দু আর মুসলমান দুইভাগ হচ্ছে তা নয়। এই দ্বন্দ্বে তো বাঙালি মুসলমানও দুইভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
একভাগ অবস্থান নিচ্ছে ‘চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি’র পক্ষে। অন্যভাগ নিচ্ছে ‘বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি’র পক্ষ। এবং এইসব কূটক্যাচালের মধ্য দিয়ে সমাজটা ক্রমাগত গঙ্গা আর যমুনার ধারার মতো দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এই ভাগ দেখেই বোধকরি অনেকের ধারণা হয়েছে ঈদে মুসলমানদের আনন্দে আর আগের মতো হিন্দু জনগোষ্ঠী শামিল হয় না। আসলে ব্যাপারটা তা নয়।
তাহলে ওই যে কূটক্যাচাল বা বাইনারি চিন্তা তার কী ব্যাখ্যা? এটা কি তবে ষোলো আনা মিছা! না, ষোলো আনা মিছা না। কিন্তু এরও একটা চরিত্র আছে। এই বাইনারি অবস্থান আসলে ক্ষমতার হিস্যার ব্যাপার; রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের ব্যাপার। সুবিধা-অসুবিধা ভোগের আকাঙ্ক্ষার ব্যাপার। এই ব্যাপারগুলোই প্রকাশিত হয় হিন্দু সংস্কৃতি, বাঙালি সংস্কৃতি বনাম মুসলিম সংস্কৃতির জামা পরে; ছদ্মাবরণে। এগুলোর সাথে ব্যক্তিক-সামাজিক পরিসরে হিন্দু-মুসলমানের মেলামেশার কোনো সম্পর্ক নেই।
কারণ, মানুষ যাপনে ও বাস্তবতায় শেষ পর্যন্ত কিন্তু সেক্যুলার বা ইহলৌকিক। যৌথজীবনের একটা সমাজে একজন হিন্দুর মুসলমানকে যেমন দরকার হয় তেমনি একজন মুসলমানেরও আবশ্যিকভাবে হিন্দুকে প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজন সবসময় বস্তুগত নাও হতে পারে। অবস্তুগত সম্পর্কেরও প্রয়োজন হয়। আর সংস্কৃতির কথা বলে যে চল-অচল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলে তার মধ্যেও একটা গলদ আছে। কারণ পৃথিবীতে বিশুদ্ধ সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। সব সংস্কৃতিই পৃথিবীর তাবৎ ভাষার মতোই মিশ্রতায় ভরা থাকে।
আরও পড়ুন >>> মহররম থেকে দুর্গোৎসব : সম্মিলন ও শক্তি
মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক যেমন কেবল সতর্ক বাছাই-বাট্টার ব্যাপার না, তেমনি উৎসবও কখনো বেছে বেছে মানুষ নিয়ে করা যায় না। ধর্মীয় আচারের জায়গাটুকু ছাড়া সব ধর্মের উৎসব আগেও কমবেশি বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে নিত, এখনো নেয় এবং ভবিষ্যতেও নেবে। কারণ মানুষ শুধু ধর্মীয় প্রাণী নয়, মানববাদীও বটে; আনন্দবাদী তো বটেই। ঈদের আনন্দই বলি অথবা সংস্কৃতির কথাই বলি সব জায়গাই বিচিত্র মানুষ এক জায়গায় হবেই। এই অর্থেই মানুষমাত্রই প্রগতিবাদীও বটে।
ড. কুদরত-ই-হুদা ।। প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক
[email protected]