ঈদ ট্যুরিজম : বিনোদনের বিকাশ ও পর্যটনের প্রসার
অনেক উন্নত-উন্নয়নশীল দেশের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নানাবিধ প্রয়োজনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে। বাঙালি জাতি ইতিমধ্যে ভ্রমণের প্রেমে পড়েছে। প্রাকৃতিক নৈসর্গে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে এর মনোরম ভ্রমণ গন্তব্য।
ঈদকে কেন্দ্র করে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের দেশ-বিদেশে ঘোরার জন্য আকর্ষণীয় সব ভ্রমণ প্যাকেজ অফার করেছে। দেশ ও দেশের বাইরে অপেক্ষাকৃত কম খরচে আপনজনকে নিয়ে ঘুরে আসার জন্য ট্যুর অপারেটর ও ট্রাভেল এজেন্সির বিভিন্ন রকম অফার চলবে।
পর্যটন মানুষের চিত্তকে প্রসারিত করে নানান রকম নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা থেকে দূরে রাখে। অভ্যন্তরীণ পর্যটন সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে জীবনযাত্রার মান, সুদৃঢ় হচ্ছে সম্প্রীতির বন্ধন কমছে আয়ের বৈষম্য এবং বিকশিত হচ্ছে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন।
আরও পড়ুন >>> ফেস্টিভ্যাল ট্যুরিজম : পর্যটনের নতুন সংযোজন
বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলায় রয়েছে তার নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রাচীন-ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শন। ঈদের ছুটিতে মানুষ প্রথমেই তার নিজ জেলার পর্যটন আকর্ষণগুলো ঘুরতে যায়, তাই জেলাভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় বিনোদন প্রেমীদের ভিড় বাড়ে।
এদেশের মানুষ ঈদের আনন্দে পরিবার পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ভ্রমণের আগ্রহ বেশি থাকে। নানা রকম সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার এদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ একত্রিত করেছে এক সম্প্রীতির বিন্দুতে। ঈদের সময় নানা রকম বিনোদন কার্যক্রমের সব উপাদান ফেস্টিভ্যাল ট্যুরিজম অন্তর্ভুক্ত।
মানুষ আজকাল বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে যোগদানের জন্য এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ভ্রমণ করে থাকে। তবে ঈদের সময় বাংলাদেশে অবকাশ যাপনের অনন্য এক সময় বিধায় ঈদের ছুটিতে শহর শূন্য থাকে আর গ্রাম হয়ে উঠে প্রাণবন্ত এবং গ্রাম আপন মহিমায় মহিমান্বিত হয়।
ঈদ ট্যুরিজম দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এক অনন্য অবদান রাখে কারণ মানুষের আয় বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে জীবনযাত্রার মান ও কর্মব্যস্ততা....
পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব মিলে একসঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য শহরের কর্মব্যস্ততা ও কৃত্রিম আবহের পরিবেশ ছেড়ে মানুষ নাড়ির টানে ছুটে চলে বাড়ি। ঈদের সময় দেশে আর্থিক লেনদেন অন্যান্য সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পায় যা অর্থনৈতিক বিবেচনায় আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈদকে কেন্দ্র করে পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য-সামগ্রী, উপহার সামগ্রী ও ঘরোয়া তৈজসপত্র কেনাবেচা বৃদ্ধি পায় বিধায় অর্থনীতির আরও বেশি তরান্বিত হয়।
ঈদ ট্যুরিজম দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এক অনন্য অবদান রাখে কারণ মানুষের আয় বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে জীবনযাত্রার মান ও কর্মব্যস্ততা তাই কর্ম-ব্যস্ত এই জীবনে বিনোদনের জন্য এখন প্রায় সবারই বাৎসরিক আলাদা একটা বাজেট থাকে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভ্রমণ ও অবকাশ যাপনের জন্য।
আরও পড়ুন >>> অর্থনীতি যখন উৎসবের অংশ
অনেকেই ঈদের ছুটিতে দেশের আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় ঘুরতে যায়। প্রতিযোগিতামূলক এই বাজারে প্রায় ৭০০ এর অধিক ট্যুর অপারেটর দেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে, তাই ঈদ উপলক্ষে সবচেয়ে কম খরচে দেশ ও বিদেশে ঘুরার জন্য বা সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার জন্য নানাবিধ ট্যুরিজম প্যাকেজের মাধ্যমে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চলছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বিশ্বায়নের এই যুগে কর্মব্যস্ত জীবনে বিনোদনের বিকল্প নেই, তাই ঈদের আনন্দকে আরও বেশি প্রাণবন্ত করতে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষ দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন আকর্ষণগুলোয় ভ্রমণ করে। পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য বিভিন্ন রকম ট্যুরিজম প্যাকেজ অফার করে থাকে।
ঈদকে কেন্দ্র করে আকাশপথে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে বিধায় চাহিদার ভিত্তিতে বাড়ছে বিমানের টিকেটের দাম। সময় যত যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ রুটগুলোয় এয়ারলাইন্সের টিকেটের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে সাতটি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে সরকারি ও বেসরকারি এয়ারলাইনসমূহ। তবে ঈদের ছুটি শুরু থেকে এখনো কিছুদিন বাকি থাকলেও ইতিমধ্যে এয়ার টিকেটের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে ঈদ যাত্রায় অধিক চাহিদার জন্য।
বিশ্বায়নের যুগে কর্মব্যস্ত জীবনে বিনোদনের বিকল্প নেই, তাই ঈদ আরও আনন্দময় করতে বাংলাদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণের সুযোগ বেড়েছে।
আরও পড়ুন >>> পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা
ট্যুর অপারেটররা দেশ ও বিদেশ ভ্রমণের আকর্ষণীয় প্যাকেজ অফার করে তার মধ্যে মধ্যবিত্ত সমাজের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশের কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, বান্দরবান, রাঙামাটি, সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কুমিল্লা ছাড়াও দেশের বাইরে ভারত (কলকাতা, শিমলা, মানালি), নেপাল, ভুটান।
উচ্চবিত্ত শ্রেণি মানুষের পছন্দ থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, মিসর, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশ। ঈদের ছুটিতে যেহেতু পর্যটক সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তাই বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ‘পর্যটন-ব্যবস্থাপনা’ গুরুত্ব পায়। বিনোদনপিপাসু মানুষ বাজেট প্যাকেজের সুযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে থাকে।
যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে এক দিনের ভ্রমণে যেতে আগ্রহী, তাদের কাছে ঢাকার নিকটবর্তী পর্যটনকেন্দ্র পদ্মা রিসোর্ট, গাজীপুরের ঢাকা রিসোর্ট, এলেঙ্গা রিসোর্ট, ড্রিমল্যান্ড রিসোর্ট, ড্রিম স্কয়ার রিসোর্ট, ভাওয়াল রিসোর্ট ও নড়াইলের অরুণিমা রিসোর্ট ও গলফ ক্লাবসহ অন্যান্য রিসোর্টে পর্যটক চাহিদা বেশি।
ঢাকার বাইরে দ্যা প্যালেস, গ্র্যান্ড সুলতান, দোসাই রিসোর্ট, ব্রিসা মেরিনা সিবিসি রিসোর্ট, ফয়েজ লেক রিসোর্ট, সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলাস, সি পার্ল বিচ রিসোর্ট, সায়মন বিচ রিসোর্ট, ডিভাইন ইকো রিসোর্ট, মমো ইন হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট উল্লেখযোগ্য। মূলত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটন সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন সমৃদ্ধ হবে।
মনোরম সৌন্দর্যের এই বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য পর্যটন আকর্ষণ। পর্যটন আকর্ষণগুলোর মধ্যে নিম্নোক্ত পর্যটন গন্তব্যগুলো পর্যটকদের নিকট আকর্ষণীয়।
বিশ্বায়নের যুগে কর্মব্যস্ত জীবনে বিনোদনের বিকল্প নেই, তাই ঈদ আরও আনন্দময় করতে বাংলাদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণের সুযোগ বেড়েছে।
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। পদ্মা সেতু সাগরকন্যা কুয়াকাটার নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। কাপ্তাই লেকের বুকে জেগে থাকা ছোট্ট একটি শহর রাঙামাটি। এই শহরের পরতে পরতে রয়েছে বৈচিত্র্যের ভাণ্ডার। স্বচ্ছ পানির লেকে ঝিরিঝিরি বাতাসে নৌকা ভ্রমণ ও পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দূর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব।
আরও পড়ুন >>> ঈদ ট্যুরিজম : সমৃদ্ধ হোক অর্থনীতি
বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল অঞ্চল চেরাপুঞ্জির খুব কাছেই অবস্থিত রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওড়। ‘ছয় কুড়ি বিল আর নয় কুড়ি কান্দা’র সমন্বয়ে পরিচালিত দৃষ্টিনন্দন বিলটির দৈর্ঘ্য ১১ ও প্রস্থ ৭ কিলোমিটার এর হাওর পর্যটকদের নিকট অধিক জনপ্রিয়।
ঈদের সময় পর্যটকেরা যেন নিরাপদে তাদের অবকাশ যাপন করতে পারে, তার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে টুরিস্ট স্পটে টুরিস্ট পুলিশ ও জেলা পুলিশের অতিরিক্ত নজরদারি থাকে পর্যটক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য, যা ঈদ পর্যটনের জন্য আশাব্যঞ্জক।
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। ছুটিতে মানুষ যখন পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজ জেলায় ঘুরতে যায় তখন জেলাভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় বিনোদন প্রেমীদের ভিড় বাড়ে। তাই জেলাভিত্তিক পর্যটন স্থাপনাগুলো উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা খুবই প্রয়োজন।
দেশীয় পর্যটনকে প্রসারের লক্ষ্যে দেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর তথ্য, ভিডিও, স্থিরচিত্র, ডকুমেন্টারি ও ট্রাভেল শো প্রচারের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি ভ্রমণেও উৎসাহিত করা সম্ভব।
আরও পড়ুন >>> উৎসবের সর্বজনীন অর্থনীতি
ঈদকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের জন্য আবাসন কক্ষগুলোর মূল্য, খাবারের দাম, পর্যটন পণ্যের মূল্য যেন অহেতুক বৃদ্ধি না পায় সেই লক্ষ্যে পর্যটন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার তদারকি প্রয়োজন। দেশের পর্যটন উন্নয়নে জেলাভিত্তিক পরিকল্পনা প্রয়োজন যা টেকসই পর্যটন উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পর্যটনের নতুন ধারণা PPCP (Private-Public-Community Partnership)-এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
পর্যটন শিল্পের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য প্রথমত চাহিদা নিরূপণ করা প্রয়োজন এবং সেই অনুযায়ী জোগান নিশ্চিত করার জন্য জেলাভিত্তিক সফট স্কিল ট্রেনিং প্রয়োজন। দেশীয় পর্যটকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও পর্যটন আকর্ষণগুলোর ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং করা প্রয়োজন।
অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার দেব ।। চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]