বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিক সহযাত্রী
প্রাঞ্জল। স্বচ্ছ, সরল ও সহজবোধ্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘আমার দেখা নয়াচীন (২০২০)’ বইটি পড়ার পর এই শব্দগুলোই বারবার মনে এসেছে। বইটি একেবারেই সাদাসিধে, সহজ বর্ণনার অনন্য এক সুখপাঠ্য স্মৃতিকথা। যে স্মৃতিকথা অবগাহনে যেকোনো পাঠকের হৃদয়ে আনন্দ খেলা করবে।একজন রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমানের বাইরে পরিচিত হবেন সংবেদনশীল এক লেখক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে।
শেখ মুজিবুর রহমান একজন আজন্ম রাজনীতিবিদ। তাই তিনি এই স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে অত্যন্ত সরলভাবে স্বীকার করেছেন তার ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কথা। তিনি বলেছেন, ‘আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লেখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন।’ [পৃ: ২১]
বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান চীন সফরে গিয়েছিলেন দুইবার। প্রথম দফা ১৯৫২ সালে (পিকিং শান্তি সম্মেলন) আর দ্বিতীয় দফা ১৯৫৭ সালে (চীন সরকারের আমন্ত্রণ)। প্রথম দফা চীন সফরের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সাবলীলভাবে তিনি লিখতে শুরু করেন ১৯৫৪ সালে, কারাগারে বন্দি অবস্থায়
মাত্র ১৪ দিন স্থায়ী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিলের পর ১৯৫৪ সালের ৩০ মে আটক হয়ে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন তিনি। এই সময়ে লেখা উপভোগ্য ও মুগ্ধতা ছড়ানো এই ভ্রমণ কাহিনির খাতাতে সেই সময়কার কারারক্ষী ও গোয়েন্দাদের নানা ধরনের সিল ছিল। যা থেকে ১৯৫৪ সালের সময়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।
১৯৫২ সালে তিনি চীন সফরে গিয়েছিলেন পাকিস্তান শান্তি কমিটির পক্ষে। এই দলে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে তার সফর সঙ্গী ছিলেন পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান খান, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, ইউসুফ হাসান ও দৈনিক ইত্তেফাকের তফাজ্জল হোসেন, যিনি মানিক মিয়া নামেই সবার কাছে পরিচিত।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতা অনুধাবন করা যায়। এই সম্মেলনে যাওয়ার প্রস্তুতি পর্বের একপর্যায়ে মানিক মিয়া সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অর্থের অভাবে। এছাড়া এ সময় ইত্তেফাক কীভাবে চলবে তা নিয়ে মানিক মিয়ার ছিল দুশ্চিন্তা। ইত্তেফাক সংবাদপত্রটির প্রতিষ্ঠাতা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হলেও একপর্যায়ে এর সার্বিক দায়িত্ব চলে আসে মানিক মিয়ার ওপর। কালের পরিক্রমায় মানিক মিয়া আর ইত্তেফাক প্রায় সমার্থক হয়ে ওঠে।
মানিক মিয়া শুধু সম্পাদকই ছিলেন না ‘মোসাফির’ নামে নিয়মিত কলামও লিখতেন। মানিক মিয়াই ছিলেন ইত্তেফাকের সবকিছু। বিষয়টি উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মানিক ভাই ইত্তেফাকের শুধু সম্পাদক নন, লেখক, প্রকাশক থেকে শুরু করে পিয়নও বটে। দুনিয়ার যাবতীয় কাজ তার প্রায় একলারই করতে হয়।’ [পৃ:২১]
নয়াচীনে মানিক মিয়ার প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। মানিক মিয়া ছিলেন ভোজন রসিক মানুষ। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় মানিক মিয়ার ভোজনের কথা তুলে ধরেছেন। তাদের দলটি ট্রেনে করে হংকং থেকে নয়াচীনের মূল ভূখণ্ডে যাচ্ছিলেন। এই ট্রেনেই তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা ছিল। আয়োজন ছিল যথেষ্ট। হংকং থেকে ক্যান্টনগামী এই সংক্ষিপ্ত ট্রেন ভ্রমণে বঙ্গবন্ধু আবিষ্কার করেন আরেক মানিক মিয়াকে। তিনি লিখেছেন, ‘মানিক ভাই ভাল লেখতে পারেন, কিন্তু এত যে খেতে পারেন তা আগে জানতাম না। সমানে খেতে শুরু করলেন মনে হলো ২/৩ ঘণ্টা খেয়েই চললেন।’ [পৃ: ২১]
মানিক মিয়া সম্পর্কে বইটিতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। মানিক মিয়া ছিলেন প্রখর স্মরণশক্তির এক মানুষ। তার কোনো কিছুই নোট করতে হতো না। স্মৃতি থেকেই তিনি লিখতে পারতেন অনবদ্য সব লেখা।
‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ বঙ্গবন্ধু নয়াচীনের সাংবাদিকতাও দর্শন করেছেন। দর্শন শব্দের দুটি আলাদা অর্থ রয়েছে। দর্শন অর্থ দেখা, অবলোকন করা আর দর্শন অর্থ চিন্তা বিষয়ক শাস্ত্র বা Philosophy। বঙ্গবন্ধু একটি ঘটনায় তার প্রখর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়ে নয়াচীনের সাংবাদিকতাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
নয়াচীনে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা অনুযায়ী, চীনের স্বাধীনতা দিবস ১ অক্টোবর। সে সময় দেশটির ৬০ কোটি মানুষ এই দিনটি বিশেষভাবে উদযাপন করত। তাদের জন্য দিনটি আনন্দের, উদযাপনের। পিকিং শহরে এই দিনটির উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহযাত্রীরা। এই অনুষ্ঠানে ছিল মিলিটারি প্যারেড, নৌ-প্যারেড, বিমান বাহিনীর প্রদর্শনী, অশ্বারোহী, সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর বিশেষ মহড়া। তারা সবাই চীনা বিপ্লবের মহান নেতা মাও সে তুং’কে সালাম জানায়। এরপর শুরু হয় শোভাযাত্রা। মহিলা ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরাও শোভাযাত্রায় অংশ নেন। সবার হাতে ছিল শান্তির পতাকা আর কবুতর। এরপর এই আয়োজনে ছিল কৃষকদের শোভাযাত্রা। পিকিং শহরের এই আয়োজন ছিল অনেক বড়। ব্যাপ্তি ছিল বিশাল।
এই আয়োজনে ঠিক কত মানুষ অংশ নিয়েছিলেন তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার দলের সদস্যদের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। কেউ বলেছেন আয়োজনে মানুষ ছিল ৫০ লাখ, কেউ বলেছেন মানুষ ছিল ৪০ লাখ। আবার কেউ বলেছেন ৩০ লাখ তো হবেই। বঙ্গবন্ধুর ধারণা সমাবেশে মানুষ ছিলেন ১৫ লাখ। যা নিয়ে আতাউর রহমান খান আপত্তি জানিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, লোকসংখ্যা নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ধারণাই নেই! তখন শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘এই সমাবেশে মানুষের সংখ্যা যে কত তা কাল সকালে সংবাদপত্রেই ঠিকঠাক জানা যাবে।’ তবে এ সময় সংবাদপত্র নিয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের অভ্যাস, সরকারি কাগজে যদি এক লক্ষ লোক লেখা হয় আমরা ধরে নেব ২৫ হাজার। কারণ, তার বেশিতো হবেই না। ওটা আমাদের দেশের কাগজআলারা লেখেই থাকে। আমাদের দেশের সরকারি প্রেসনোটেই মাঝে মাঝে লেখে।’ [পৃ: ৫৬]
কিন্তু সমাবেশের পরদিন সংবাদপত্রে এ নিয়ে প্রকাশিত তথ্য বঙ্গবন্ধুকে বিস্মিত করেছিল। সংবাদপত্রে লেখা হয় সমাবেশে ছিলেন মাত্র ৫ লাখ মানুষ। অর্থাৎ ৫ লাখ মানুষের শোভাযাত্রা। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘সকালে উঠে দেখি হায় হায়! কম্যুনিস্ট দেশের সরকারি কাগজ সত্য কথা লেখে! একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম। লিখেছে ৫ লক্ষ লোকের শোভাযাত্রা। কোথায় আমরা বলি ২৫ লক্ষ! আর সরকারি কাগজ লেখে ৫ লক্ষ। আশ্চর্য হলাম। মিছাই কি এ দেশের জনসাধারণ সরকারকে ভালোবাসে?’ [পৃ: ৫৬]
নয়াচীনের সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল। আর এর মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সরকারের যে অত্যন্ত সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা উল্লেখ করতেও ভুল করেননি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়