অ্যালেন গিন্সবার্গ ও মুক্তিযুদ্ধ
কবি আরউইন অ্যালেন গিন্সবার্গকে এই প্রজন্ম কি চেনে? গুটিকয়েক লোক চিনলেও সবার চেনার কথাও নয়। তিনি কলকাতায় আসেন ১৯৬১-৬২ সালে। আমারও তখন জন্ম হয়নি। কিন্তু ততদিনে তিনি বিখ্যাত হয়ে গেছেন আমেরিকায়।
১৯৫৬ সালে তার কবিতা ‘হাউল’ প্রকাশিত হয়। তিনি মার্কিন পুঁজিবাদী শক্তিকে আক্রমণ করে, তার বিট প্রজন্মের বন্ধুদের বরণ করে, সাম্রাজ্যবাদের নিন্দা করে এই কবিতাটি লেখেন। তাকে বলা হয় বিট প্রজন্মের কবি। কিন্তু এরা কারা?
বিট জেনারেশন বা বিট প্রজন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেখকদের একটি সংঘ, যারা ১৯৫০-এর দশকে প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করে; এবং ‘বিট জেনারেশন’ নামে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা করে। বিট সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় বা প্রধান উপাদানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—স্বীকৃত মানদণ্ড প্রত্যাখ্যান, বিশেষ করে নতুন শৈলীর প্রবর্তন, ড্রাগ পরীক্ষণ, বিকল্প যৌনতা, প্রাচ্য ধর্মের প্রতি আগ্রহ, বস্তুবাদকে প্রত্যাখ্যান এবং মানব-অবস্থার স্পষ্ট উপস্থাপন। এই বিট প্রজন্ম যে ক’জন কবি-লেখকের হাত ধরে সূচিত হয়েছিল, অ্যালেন গিন্সবার্গ তাদের একজন।
আরও পড়ুন >>> জর্জ হ্যারিসন : মুক্তিযুদ্ধ ও কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
অ্যালেন গিন্সবার্গ ছিলেন মার্কিন কবি, দার্শনিক ও গীতিকার। তিনি মার্কিন সামরিকতন্ত্র, অর্থনৈতিক বস্তুবাদ এবং যৌন নিপীড়ন বিষয়ে জোরালোভাবে বিরোধিতা করেন।
এই কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর আমেরিকায় যতই খ্যাতি বা অখ্যাতি থাক, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে বন্ধুর ভূমিকা নিয়েছিলেন তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এই প্রসঙ্গে অসংখ্য নিবন্ধ ও স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হয়েছে যে যাই বলবে তা হয়তো সেই সব নিবন্ধের চর্বিত চর্বণ হয়ে যাবে।
অ্যালেন গিন্সবার্গ ছিলেন মার্কিন কবি, দার্শনিক ও গীতিকার। তিনি মার্কিন সামরিকতন্ত্র, অর্থনৈতিক বস্তুবাদ এবং যৌন নিপীড়ন বিষয়ে জোরালোভাবে বিরোধিতা করেন।
তাই আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে শোনা কিছু কথাকেই মূল উপজীব্য করে এগোব। সুনীলদা এই বন্ধু কবিকে ‘অ্যালেন’ বলেই উল্লেখ করতেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন অ্যালেন। এসে উঠলেন সুনীলদার বাসায়।
সুনীলদার কাছে শুনলেন পূর্ববাংলার নিদারুণ সংকটের কথা, দেশজোড়া শরণার্থী আর যুদ্ধের বিপ্লবীদের কথা। কাজেই চলো সীমান্তে। তখন সবেমাত্র আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দিয়েছেন সুনীলদা। তার মধ্যে লিখে ফেলেছেন ‘১৯৭১’ কবিতাটি যা তখন ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
যুদ্ধ চলাকালে তিনি প্রায়শই বনগাঁ আর সাতক্ষীরা সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যেতেন। আর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিয়ে যেতেন ওষুধপত্র ও খাবার-দাবার। কাজেই অ্যালেনের সাথে চললেন বনগাঁ।
আরও পড়ুন >> মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
দমদম পেরোতেই অ্যালেনের চোখে পড়ল রাস্তার ধারে সারি সারি ছাউনি। ওরা শরণার্থী। সেই বছর তুমুল বৃষ্টিতে রাস্তার পাশের নয়ানজুলিগুলো ভরভরন্ত। অমানবিক পরিস্থিতি ছাউনিগুলোর। এগোতে এগোতে দেখতে দেখতে চোখে জল চলে এসেছে অ্যালেনের। পকেটের টুকরো প্যাডে নোট নিচ্ছেন। বনগাঁর মুখে আটকে গেলেন তারা। গাড়ি যাবে না। তবে? নৌকোতে যাবেন অ্যালেন।
অ্যালেন বাধাকে ভয় পান না। এর আগে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতায় ১৯৬৫ সালের ১৬ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে শহর থেকে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের এক বিশাল মিছিল নিয়ে তিনি যুদ্ধবিরোধী গান গাইতে গাইতে ওকল্যান্ডে যান। সেদিন আন্দোলনকারীরা গাইছিল কান্ট্রি জো অ্যান্ড ফিস ব্যান্ডের ‘আই এম ফিক্সিন টু ডাই’ গানটি।
পথিমধ্যে কয়েক হাজার পুলিশ তাদের পথরোধ করে। পুলিশের বাধার মুখে আন্দোলনকারীরা সেখানে দাঁড়িয়ে গান গাইতে থাকেন। কিন্তু বিপদটা আসে পেছন দিক থেকে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের যেমন বিরোধী পক্ষ ছিল, তেমনি ছিল কিছু পক্ষের লোকজনও। এমনি একটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ছিল হেল’স অ্যাঞ্জেল গ্রুপ।
কট্টর যুদ্ধবাজ এই গোষ্ঠীর লোকজন বাইকে করে চলাফেরা করতো আর বিভিন্ন স্থানে মারপিট ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে বেড়াত। সেদিনও এই গ্রুপটি যুদ্ধবিরোধী মিছিলের পেছনে চলে আসে এবং পেছন থেকে বিক্ষোভকারীদের গালিগালাজ করতে থাকে।
এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং শুরু হয় মারপিট। আর এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ হিসেবেই কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ সৃষ্টি করেন তার অমর শব্দবন্ধ ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’।
আরও পড়ুন >>> প্যারী মোহন আদিত্য : অল্পশ্রুত মহান দেশপ্রেমিকের প্রতিকৃতি
ফুলের শক্তিমত্তার বিষয়টি তিনি তুলে ধরলেন তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘হাউ টু মেক অ্যা মার্চ’-এ। এখানে তিনি সারা আমেরিকার আন্দোলনকারীদের পরামর্শ দিলেন, আন্দোলনে ফুলের ব্যবহার করতে হবে। তিনি সবাইকে আহ্বান জানালেন, ফুল নিয়ে রাজপথে নামুন।
পুলিশ বা হেলস অ্যাঞ্জেল যারাই আন্দোলনে বাধা দিতে আসবে তাদের হাতে তুলে দিন সৌন্দর্যের প্রতীক ফুল। এছাড়া তিনি পুলিশ সাংবাদিক এবং মিছিল দেখতে আসা জনতার জন্য ফুলের পাশাপাশি ক্যান্ডি, চকলেট, বাচ্চাদের খেলনা ইত্যাদি উপহার নিয়ে আসতে বললেন আন্দোলনকারীদের।
গিন্সবার্গের এই আহ্বানে ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। সারা আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এই ফুলের আন্দোলন। সারাবিশ্ব অবাক হয়ে দেখল ফুলের কী শক্তি! এই ফুলেল শক্তির আন্দোলনের প্রথম মিছিলটি বেরিয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কেলে থেকে। আর সেই মিছিলে সামনে থেকে ফুল হাতে নেতৃত্বে ছিলেন ফুলেল শক্তির আবিষ্কারক কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ।
অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর আমেরিকায় যতই খ্যাতি বা অখ্যাতি থাক, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে বন্ধুর ভূমিকা নিয়েছিলেন তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
এহেন অ্যালেন নৌকোয় যাবেন এটাই তো স্বাভাবিক। কিছুদিন আগে সেপ্টেম্বরে রোলিং স্টোনের কিথ রিচার্ডস কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলেন গিন্সবার্গের হাতে; পূর্ববঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে, হাজার হাজার বাঙালি শরণার্থী বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে, অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার তারা সেখানে—অ্যালেনের কাজ হবে সরেজমিনে ওই যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদন লেখা। কিন্তু তিনি নন, প্রতিবেদন লিখেছিলেন তার সফরসঙ্গী বিবিসি’র গীতা মেহতা। আর তিনি যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোয় বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করে লিখলেন এক দীর্ঘ কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।
যশোর রোডের পাশে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবির এবং এপার থেকে ওপারে যাত্রা করা হাজার হাজার নিরীহ মানুষের নির্মম হাহাকারের প্রতিধ্বনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায়।
আরও পড়ুন >> ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস
যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যদের সহায়তায় এই কবিতাটি তিনি গানে রূপ দিয়েছিলেন। কনসার্টে এই গান গেয়ে তারা বাংলাদেশি শরণার্থীদের সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।
‘দ্য ফল অব আমেরিকা’ বইয়ের সেরা কবিতাটি নিঃসন্দেহে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। ডেট্রয়েটে ১৯৭১ সালে জন লেনন এবং ইয়োকো ওনো ‘Free John Sinclair’ শোভাযাত্রার আয়োজন করেন। অ্যালেন সেখানে গিটারিস্ট গ্যারী গেযকে সাথে নিয়ে ‘Jessore Road’ আবৃত্তি করেন। এই কবিতা পরে ১৯৮৩ সালে Milky Way Theater রেকর্ড করা হয়। শিল্পী ছিলেন অ্যালেন নিজেই।
এই কবিতার মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি তার একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং আমেরিকায় ফিরে গিয়ে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘পণ্ডিত রবিশঙ্কর’ ও জর্জ হ্যারিসন আয়োজিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ অংশগ্রহণ করেন।
এই কনসার্টে জর্জ হ্যরিসন, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজসহ আমেরিকার আরও অনেক জনপ্রিয় শিল্পীই সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও অপর ভারতীয় কিংবদন্তী গায়ক আলি আকবর খানও পারফর্ম করেন এই কনসার্টে এবং এখান থেকে প্রায় আড়াই লাখ ডলার সংগৃহীত হয় শরণার্থীদের সাহায্যে।
এই কনসার্ট সারাবিশ্ব নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিল। সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা এবং বাঙালির গৌরবান্বিত স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। এরপর থেকে জনমত গড়তে থাকে এবং বিশ্ব অপেক্ষা করে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের জন্য।
‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি ১৯৯৯ সালে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তার ‘মুক্তির কথা’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। প্রথমে অকাল প্রয়াত কবি খান মোহাম্মদ ফারাবীর (১৯৫২ – ১৯৭৪) অনুবাদ করা কবিতাটি গান হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।
‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি ১৯৯৯ সালে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তার ‘মুক্তির কথা’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। প্রথমে অকাল প্রয়াত কবি খান মোহাম্মদ ফারাবীর (১৯৫২ – ১৯৭৪) অনুবাদ করা কবিতাটি গান হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কবিতার মাত্রা ও গানের মিটারে হয়তো কিছু পার্থক্য হয়ে যাচ্ছিল। তাই এটাকে গান করার দায়িত্ব পড়ে তারেক মাসুদের বন্ধু প্রখ্যাত গায়িকা মৌসুমী ভৌমিকের ওপর।
তিনিই এই কবিতার ভাবানুবাদ করেন এবং সুরারোপ করেন। এই গানটি তারেক মাসুদ তার অপর চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’-এ ব্যবহার করার জন্য অ্যালেনের অনুমতি নেন। কিন্তু মুক্তির গান চলচ্চিত্রের ফাইনাল এডিটিং-এর সময় এই কবিতা বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন >> বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও স্মৃতি সংরক্ষণ কতদূর?
যেসব বিদেশি বন্ধু মানবিক ও নৈতিক সহায়তা করেছেন, বাংলাদেশ সরকার তাদের সবার প্রতি আনুষ্ঠানিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ পদক প্রদান করে অ্যালেন গিন্সবার্গকে। কিন্তু ততদিনে অ্যালেন চলে গেছেন আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
বাংলাদেশের পরম বন্ধু অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৯৭ সালের ৫ এপ্রিল নিউইয়র্কে পরলোকগমন করেন। আজ বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের কেউ কেউ এই প্রাপ্ত স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, অনেকটা নিজের মা’কে প্রমাণ দিতে বলা যে তিনি তার মা। জানি না তারা অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা পড়েছেন কি না যেখানে অ্যালেন বলছেন—
‘শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল,
যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল।
কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ি দেশ,
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ।
শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কলকাতা চলে....’
অমিত গোস্বামী ।। কবি ও কথাসাহিত্যিক