কী চলছে টিভি নাটকে?
‘আমার অমুক নাটকের আজ দশ লাখ ভিউ হলো’, ‘ভালো লাগার খবর এক কোটি ভিউ হলো নাটকটার’, আজকাল ফেসবুকে অনলাইন হলেই টেলিভিশন মিডিয়ার পরিচালক-অভিনেতাদের এমন পোস্ট প্রায়শই দেখা যায়, দেখে খুব ভালো লাগে। যাক, মানুষ নাটক দেখছে।
টেলিভিশন মিডিয়াও এখন ইউটিউবের কল্যাণে ভিউ-এর গণনায় পৌঁছেছে। প্রায় প্রতিটা চ্যানেলের এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আছে। সেখানেও ভিউ কাউন্ট বা গণনা গুরুত্ব দেওয়া হয়। দারুণ ব্যাপার! অনলাইন মানেই তো সারাবিশ্বের কাছে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশের নাটক। গেছেও পৌঁছে। খুবই আনন্দিত হওয়ার মতো ঘটনা।
শুধু কী তাই! বর্তমানে ভিউ-এর গণনার ওপর নির্ভর করে অভিনয়শিল্পীরও দাম বেড়েছে। তাহলে কী দাঁড়াল? টেলিভিশন নাটকের অভিনেতাদের পাশাপাশি অনলাইন পোর্টালও ‘হিট’ অভিনেতা ঘরানা বা শ্রেণিকরণ করছে। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। প্রায় প্রতিদিন শুটিং থাকছে, শুটিং চলছে হাউজগুলোতে, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পাশাপাশি ব্যস্ত টেকনিক্যাল টিমও। ভীষণ ইতিবাচক ব্যাপার।
এতকিছুর পরও ‘কাজ নাই... কাজ নাই...’ রব শোনা যায় টেলিভিশন মিডিয়া অঙ্গনে। এদিকে বাংলাদেশের নাটক কোটির ঘর ছুঁলেও দর্শকেরা সন্ধ্যা ছ’টা থেকে দশটা পর্যন্ত ঘরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পশ্চিম বাংলার টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর ঘুরতে থাকে।
এই বাংলাদেশেরই আরেক শ্রেণির দর্শক ঘরে বড়পর্দা বা হোম থিয়েটার সেটআপ করে দেখতে থাকে নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম ইত্যাদি বিদেশি ওটিটি চ্যানেলের সিনেমা আর সিরিয়াল। এই সিরিয়াল বা সিনেমাগুলো কিন্তু হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষার। তাহলে প্রশ্ন আসে, আমাদের দেশের নাটকের অবস্থান কোথায়?
ক্লিফ হ্যাঙ্গার না বুঝেই যেখানে সেখানে শুরু হয় বিজ্ঞাপন। ফলে, দর্শকের মনোযোগ হয় নষ্ট। সময়কে মাথায় রেখে গল্পের গাঁথুনি না থাকায় দর্শককে আটকে রাখতে পারছে না বাংলাদেশের নাটক।
ক্রমশ আমাদের দেশের নাটক পৌঁছে যাচ্ছে অনিশ্চয়তায়। কারণ, বিশ্বায়নের যুগে আমরা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না নাটকের গল্প কী হওয়া উচিত? অভিনয়শিল্পী কাদের হওয়া উচিত?
নাটক মূলত ঐতিহাসিক, পারিবারিক, সামাজিক, মানবিক, মানসিক, প্রেমের, দ্রোহের, হাস্যরসাত্মক নাকি ট্র্যাজেডি? এতো এতো প্রশ্নের কয়টার উত্তর দিতে পারছি আমরা! ফলাফল, আমাদের দেশের নাটক ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে সংকট।
নাটক দেখলে বোঝা যায়, কোনো কিছু বিবেচনা না করেই আমরা নাটক বানিয়ে ফেলছি। এক নাটকের মধ্যে সকল কিছুর সমন্বয়ের ফলে মূল বক্তব্য হারিয়ে যায়। ধারাবাহিক নাটকগুলোর সময় ২০-২২ মিনিট, একক নাটক ৩৫-৪০ মিনিট, টেলিছবি ৫০-৬০ মিনিট।
ক্লিফ হ্যাঙ্গার না বুঝেই যেখানে সেখানে শুরু হয় বিজ্ঞাপন। ফলে, দর্শকের মনোযোগ হয় নষ্ট। সময়কে মাথায় রেখে গল্পের গাঁথুনি না থাকায় দর্শককে আটকে রাখতে পারছে না বাংলাদেশের নাটক। উল্লেখ্য, এখনও ইউটিউবে অল্প সময়ের জন্য হলেও বিজ্ঞাপন কিন্তু দেখা যায়।
নাটকে গল্প আগানোর একটা ছক আছে। দর্শক যখন টেলিভিশনের সামনে বসেন তাদের মনের পারদ ক্রমশ ওঠানামা করার মতো বিষয়বস্তু থাকতে হবে নাটকে, তবেই না দর্শক নাটক দেখার পর মনে রাখবে। বিস্ময়, হতাশা, আনন্দ, ঘৃণা, ক্রোধ এসব অনুভূতি কি আমাদের নাটক দেখে জন্মায়? প্রশ্নটা নিজেদেরকেই করি। সামাজিক দায়বদ্ধতা! তা উহ্য থাকুক।
দেশ জুড়ে কত গল্প, কত অনাচার, কত ধরনের মানুষ। অথচ মধ্যবিত্ত ঘরের টানাপোড়েনে থাকা ছেলেটির চরিত্র যখন আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখি তখন অভিনেতার পোশাক থাকে নামি ব্র্যান্ডের ইস্তিরি করা শার্ট, টি-শার্ট, হেয়ার জেল দেওয়া ভাঁজ না ভাঙা চুল, দুশ্চিন্তায় ক্লিষ্ট চোখের নিচে রাতজাগা কালি থাকে না মেকআপে। এটা কি হৃদয় ছোঁয়! যতই কোটির ঘর পৌঁছাক কেন ভিউ’র হিসাব।
মধ্যবিত্তের বয়স, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অল্পতেই চিন্তায়, চেতনায়, কথাবার্তায় বুড়িয়ে যায়। কিন্তু সেই চরিত্র কি আমরা দেখছি? দেখছি না। তাই তো নিজের গল্প হয়ে ওঠে না আমাদের নাটক।
কতিপয় অভিনয়শিল্পীর মধ্যে আটকে গেছে বাংলাদেশের নাটক। চরিত্রানুযায়ী কোনো শিল্পীকে আমরা দেখছি না। কষ্ট করে অভিনয়শিল্পীরা মধ্যবিত্ত ঘরের চরিত্র হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার চেহারা, বয়স, হাতের আঙুল, চলা, বলা কোনোটাতেই মধ্যবিত্তের ছাপ নেই। তাহলে! মধ্যবিত্তের বয়স, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অল্পতেই চিন্তায়, চেতনায়, কথাবার্তায় বুড়িয়ে যায়। কিন্তু সেই চরিত্র কি আমরা দেখছি? দেখছি না। তাই তো নিজের গল্প হয়ে ওঠে না আমাদের নাটক।
গল্প অনুযায়ী লোকেশন বা বাড়ি, স্থান, পরিবেশ ঠিক থাকে না— এটাও একটা দুর্বলতা। আর মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তোলার জন্য ভাষার ব্যবহার দিনকে দিন পরিবর্তিত হতে হতে কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভাষায় পরিণত হচ্ছে ‘বাংলা ভাষা’। মানুষ তো বুঝে, যথেষ্ট বোঝে, তবে কেন সব বুঝিয়ে দিতে হবে? দর্শক নিজেও মাথা খাটিয়ে একটু বুঝে নিক না।
ক্রমশ নাট্যকারহীন হয়ে পড়ছে বাংলা নাটক। আমরা ঘরের গল্পও যেমন বলতে পারি না, তেমন বাইরের গল্পগুলোও দেখার সময় হয় না আমাদের। ভিউ গুনতে গুনতে চারপাশের গল্প দেখার সময় পাই না আমরা। হাস্যরসাত্মক নাটক করতে গিয়ে ব্যঙ্গাত্মক নাটক বানানোর হিড়িক শুরু হয়েছে। জানি না কাকে, কেন, কী কারণে, কোন বিষয় উপস্থাপনার জন্য ব্যঙ্গ করছি। এটাও সংকট।
একসময় পার্শ্ববর্তী দেশ এন্টেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাংলাদেশের নাটক দেখার চেষ্টা করত। বিদেশে থাকা বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা ভিএইচএস ক্যাসেট বা ডিভিডিতে বাংলা নাটক দেখার জন্য অপেক্ষা করত। আর এখন খুব সহজে ইউটিউব সার্চ করলেই বাংলা নাটক দেখা যায়। তাই নির্মাতাদের সময় এসেছে কী নাটক বানাবেন বা বানাচ্ছেন, সেটা ভেবে দেখার।
নাট্যকারের সময় এসেছে, কোন গল্প নিয়ে, কী সংলাপ লিখছেন পাণ্ডুলিপিতে, তা নিয়ে সচেতন হওয়ার। অভিনয়শিল্পীদের কাজটা করার আগে চরিত্রায়ন নিয়ে ভাববার সময় দেওয়া উচিত বলেই বিশ্বাস করি। প্রযোজকদের ভাবা উচিত কোন ধরনের নাটকে অর্থলগ্নি করবেন। না হলে বাংলাদেশের নাটক সংকট শুধু প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পথে এগোচ্ছে।
ভালো নাটক অবশ্যই নির্মিত হচ্ছে। মনোযোগী নির্মাতা, অভিনেতাদের কাজ আমরা দর্শক হিসেবে দেখছি। কিন্তু সস্তা চিন্তার ভিড়ে ভালো কাজ চাপা পড়ে যাচ্ছে। এককভাবে সংস্কৃতিচর্চা হয় না। সকলকে সমন্বিত হয়ে দেশের সংস্কৃতি এবং ব্রডকাস্ট শিল্পের উন্নতি সাধনে সচেষ্ট হতে হবে।
বহুদিন যাবৎ ‘বাজেট নাই’ শব্দটি বলতে বলতে, শুনতে শুনতে একটা স্লোগানে পরিণত হয়েছে। এই ‘বাজেট নাই’ শব্দটি নিয়ে ফাইট করার এখনই উপযুক্ত সময়, নইলে আমাদের মিডিয়া শিল্প হোঁচট খেতে খেতে মুখ থুবড়ে এমনভাবে পড়বে যে, কোমর সোজা করে আর দাঁড়াতে পারবে না।
নাজনীন হাসান চুমকী ।। অভিনেত্রী, নাট্যকার ও পরিচালক