মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনা ধর্মনিরপেক্ষতা
ধর্মনিরপেক্ষতার (Secularism) বিশ্বাস ও প্রত্যয় খুবই পুরোনো। প্রথমত ব্যক্তি জীবনে তার চর্চা শুরু হয়। পরে পরিবার ও সমাজ জীবনে তার প্রসার ঘটে। তবে এই বিশ্বাস ও প্রত্যয় শব্দবন্ধ প্রথম ব্যবহার করেন ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ লেখক-চিন্তাবিদ জর্জ জ্যাকব ইলিয়ক।
তিনি প্রথম রানি এলিজাবেথের সময়কালে সৃষ্ট চার্চ পার্টি, পরবর্তীকালের কোর্ট পার্টি, কান্ট্রি পার্টি, হুইগ পার্টি, টোরি পার্টি ইত্যাদির জন্ম ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস পাঠ করে ক্ষুব্ধ হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। তার এই ধারণা সেই সময়ে রানি ভিক্টোরিয়া এবং লর্ড জন রাসেলের মন্ত্রিসভা কর্তৃক মৌন সমর্থন লাভ করে।
ব্রিটেনের রাজনৈতিক দল লেবার পার্টি (১৯০৬) ইলিয়কের এই ধারণা রাজনৈতিক বিশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করে। তাদের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনৈতিক প্রত্যয় প্রসারিত হয়। সেই ছায়ায় প্রভাবিত হয় অবিভক্ত ভারতে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি এবং বিভক্ত পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ।
আরও পড়ুন >>> এই দুঃখ কোথায় রাখি?
প্রতিষ্ঠাকালে আওয়ামী লীগ নিজ নামে মুসলিম শব্দটি ব্যবহার করলেও পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। এবং এই দলের প্রধান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বাসে দল এবং দলের সর্বস্তরের অধিকাংশ কর্মী ধর্মনিরপেক্ষ ধারণায় উজ্জীবিত হন।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত ৬ দফা জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে যেসব জনজমায়েত হয় এবং বঙ্গবন্ধু যেসব জমায়েতে বক্তব্য রাখেন তার প্রত্যেকটি তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বিনির্মাণের আহ্বান জানান।
দলের প্রধান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বাসে দল এবং দলের সর্বস্তরের অধিকাংশ কর্মী ধর্মনিরপেক্ষ ধারণায় উজ্জীবিত হন...
বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোয় সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত ধর্মনিরপেক্ষতার মর্মবাণী পরাধীন বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যায়। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব, দৃষ্টিগোচর হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ধারণা জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়।
আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার দ্বৈরথ
বঙ্গবন্ধুসহ জননন্দিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা জনমানসে দৃঢ়মূলে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। যার কারণে যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বাচিত আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা করে তখন ক্ষুব্ধ বাঙালি স্বাধীনতাকামী প্রত্যয়দীপ্ত জাতিতে রূপান্তরিত হয়। এবং তারা সাম্যময় ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের জন্য লড়াই শুরু করে।
এই লড়াইয়ের পূর্বপ্রস্তুতিতে বঙ্গবন্ধু বারবার ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন। ১৯৬৯ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকা জেলা বার সমিতিতে প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন ইসলামকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
১৯৬৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে বঙ্গবন্ধু ৬ দফার রাজনৈতিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য কারও ইসলামের নাম ব্যবহার করা উচিত নয়।
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি তেজগাঁওয়ে প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যেসব বক্তব্য-বিবৃতি প্রদান করেছেন তার অধিকাংশই তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক গুরুত্বে উপস্থাপন করেছেন।
আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান
যেহেতু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পূর্ববাংলার বাঙালি অবিসংবাদিত নেতা এবং তার উচ্চারণের সঙ্গে ছিল বাঙালির অচ্ছেদ্য সংহতি তাই তিনি যখন বারবার বলেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার কথা তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পূর্বেই বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষ জনজাতিতে রূপান্তরিত হয়। (যদিও ব্যতিক্রমও কম ছিল না) এই জনজাতি যখন মুক্তিযুদ্ধ করে তখনই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রত্যয়ই করে এবং হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসী সবাই ধর্ম-গোত্র-বর্ণ বিভেদহীনভাবেই যুদ্ধ করে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ প্রত্যয় প্রসূত জনজাতির ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র লড়াই।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মীমাংসিত সেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবারই উচ্চারণ করেছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম বিদেশ সফরে ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে কলকাতায় তিনি সুস্পষ্ট করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন।
তিনি প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। যার কারণে ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি করা হয়। বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় হয় ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদের সমাপনী ভাষণে সংবিধানে যুক্ত ও জনমানসে প্রসারিত ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নেই।
আরও পড়ুন >>> ধর্মের রাজনীতি নাকি রাজনীতির ধর্ম
হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।
২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, বেইমানি, অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার এই বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র বিষয়। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই বক্তব্যের মাধ্যমে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের চিত্র। তিনি রাষ্ট্রকে যেমন ধর্মনিরপেক্ষ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলেন তেমনি বাংলাদেশের অধিবাসীদেরও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি কোথায়?
তিনি বুঝেছিলেন মানুষকে ধর্মনিরপেক্ষ করার জন্য আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। থাকতে হবে রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ও অঙ্গীকার। তিনি আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের এই মৌলচেতনা ধর্মনিরপেক্ষতার মর্মবাণী বিচ্যুত হননি। তিনি অবিরাম চেষ্টা করে গেছেন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বিনির্মাণের।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোয় সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত ধর্মনিরপেক্ষতার মর্মবাণী পরাধীন বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যায়। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব, দৃষ্টিগোচর হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে...
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মহান ও মহত্তম চেতনা ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিচিত্র কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। জনমানসের সাংস্কৃতিক রূপান্তরের কর্মযজ্ঞ সামর্থ্যরে সবটুকু নিয়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিককর্মীরা পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাঙালিরা প্রথমত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম থেকেই বেনামে সক্রিয় ছিল দেশবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীসমূহ।
আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়
তারা বাংলাদেশকে অকার্যকর প্রমাণ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে। তারা ধর্মীয় জলসা, পাকিস্তানি কাওয়ালি ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষদের ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক করে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি গ্রহণ করে।
বিদেশি সাহায্যপুষ্ট এরা পাকিস্তানি ভাবধারায় বাঙালি মানস গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতির আধিপত্য তারা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম না হলেও ভেতরে ভেতরে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ তারা রোপণ করে ফেলে।
এর মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর যারা ক্ষমতায় বসেছেন তারা ছিলেন পাকিস্তানপন্থী।
আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?
তারা পরিকল্পিতভাবে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা অপসারণ করে এবং বাঙালিকে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক জাতিতে রূপান্তর করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধ কর্মসূচি গ্রহণ করে। তাদের সেই দেশবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের মৌল প্রত্যয় বিপক্ষ কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতি হলো ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার সামাজিকীকরণ।
স্বাধীনতা দিবসে এসে আমরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধির উৎকর্ষ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের গৌরব করছি। স্পর্ধিত উচ্চারণে সোচ্চার হয়েছি। কিন্তু প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতো আমাদের ছেয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনা বিরোধী ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার। সেই অন্ধকার থেকে মুক্তি মিলবে কবে?
অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী ।। শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার