বইমেলা ও প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ
বইমেলা শুরু হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে নির্ধারিত সময়ের পরে শুরু হয়েছে বইমেলা। মেলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই লেখক-পাঠকদের মধ্যে একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করে। বইমেলার বিশাল প্রাঙ্গণ, ধুলো ছুঁয়ে সারা বইমেলায় লেখক-পাঠকের ঘোরাঘুরি, অনেক ঘোরাঘুরি আড্ডার পর নিদেনপক্ষে একটা বই কেনা— এসব বইমেলা আসার আগেই বইপ্রেমীদের মাথায় ঘুরতে থাকে। বইমেলা এখন রীতিমতো একটা উৎসব। এই উৎসবে আমি শামিল হই বটে, কিন্তু কেন যেন বুকের ভেতরটা খচখচ করে।
কিন্তু কেন? আনন্দের মাঝে বিষাদ কেন? বিষাদের কারণটা খুব সহজ। আমার বাবা প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের জীবনের আনন্দের একটি অংশই ছিল এই বইমেলা। পুরো সময় জুড়ে তিনি বইমেলায় থাকতেন। তিনি সামাজিক মানুষ ছিলেন না। দেশ-বিদেশে ঘোরাঘুরির নেশা একেবারেই ছিল না।
ভালোবাসতেন কেবল বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতে। বারো মাসই চলত তার লেখালেখি আর পড়াশোনা। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বাবার কর্মব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। লিখতেন একের পর এক বই। নিজেই কম্পোজ করতেন। প্রুফ রিডিং হয়ে আসার পর আবার সেটা চেক করতেন। প্রচ্ছদের বিষয়ে খুব বেশি খুঁতখুঁতে ছিলেন। প্রচ্ছদ শিল্পীর সঙ্গে প্রচ্ছদ নিয়ে বারবার আলোচনা করে একটা ফাইনাল প্রচ্ছদ দাঁড় করাতেন।
পরিবারের কারো সঙ্গে বই বের হওয়ার আগে তিনি আলোচনা করতেন না। নিজের পড়ার কক্ষে মাঝে মাঝে একা একা তার নিজের বই থেকে আবৃত্তি করতেন। এরপর চলে আসত বাবার বারো মাসের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মাস- ফেব্রুয়ারি।
বইমেলা শুরু হওয়ার পরের দিনই পেতাম বাবার অটোগ্রাফসহ বই। বাবা বই দেওয়ার পর বলতেন, ‘বই পড়ে বলিস তো, তোর কেমন লেগেছে?’
বাবা সাধারণত কোথায় যাচ্ছেন তা বাসায় কাউকে বলে যেতেন না, আমরা নিজেরা অনুমান করে নিতাম। বইমেলার সময় আমাদের অনুমান করতে অসুবিধা হতো না যে তিনি কোথায় আছেন। আমরা নিশ্চিত থাকতাম, বিকেল থেকেই তিনি আছেন বইমেলায়। মাঝে মধ্যে আমার মনে হতো বইমেলায় তিনি কেন এতো আনন্দ পান? এই সময় তাকে অন্য কোথাও কেন নেওয়া যায় না?
তিনি ঝলমলে কোনো পার্টিতে যেতে চাইতেন না। গণ্যমান্যদের মাঝেও তিনি থাকতে চাইতেন না। এককথায়, এক ডাকে যেতে রাজি ছিলেন কেবল বইমেলাতেই। আসলে আমিই বোকা ছিলাম। বাবাকে বুঝতে পারিনি। একজন লেখক যিনি অবিরাম নানা বিষয়ে লিখছেন, তার কাছে বইমেলা ছাড়া প্রিয় স্থান আর কী-ই-বা হতে পারে? বাবা তো তথাকথিত জনপ্রিয় লেখক ছিলেন না! কিন্তু তার ছিল অসংখ্য অনুরাগী। তার কারণ একটাই ছিল, তার সত্য ভাষণ।
যতই সমালোচিত হোন না কেন সত্য বলতে ও লিখতে তিনি কখনো দ্বিধা করতেন না। বইমেলা মানেই হলো প্রচুর তরুণ পাঠকের মুখোমুখি হওয়া, বই নিয়ে তাদের সঙ্গে তর্কে মেতে যাওয়া। বাবাকে দেখেছি সেসব উপভোগ করতে। প্রথম দিকে তিনি সারা বইমেলা হেঁটে বেড়াতেন, কিন্তু একটা পর্যায়ে নিয়মিত আগামী প্রকাশনীর স্টলে বসতেন। বইমেলাকে আরও বিস্তৃত পরিসরে (তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা হতো না) দেখতে চাইতেন। রাতে যখন একা হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরতেন, তখন হাতে থাকত বইমেলায় প্রকাশিত তার ও অন্যদের বই। বইমেলা শুরু হওয়ার পরের দিনই পেতাম বাবার অটোগ্রাফসহ বই। বাবা বই দেওয়ার পর বলতেন, ‘বই পড়ে বলিস তো, তোর কেমন লেগেছে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বইমেলার প্রাঙ্গণকে খুব বেশি নিরাপদ স্থান মনে করতেন তিনি। সাহস তো তার বরাবরই একটু বেশি ছিল, তাই ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি ইত্তেফাকে বের হওয়ার পর অনেকে তাকে সাবধান করেছিলেন তিনি তা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। হিংস্র মানুষরূপী পশুগুলো সে সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছিল।
২০০৪ সালের পর থেকে বাবা আর বইমেলার কোথাও নেই। এখন বইমেলা গেলেই মনে হয়, ‘ওই বুঝি বাবা ঝাঁকড়া চুলে হাত দিয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আগামীর স্টলে ঢুকছেন।’ বুঝতে পারি পুরোটাই আমার কল্পনা।
২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বাবাকে না ফেরার দেশে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল তারা। বাবার রক্তে লাল হয়েছিল বইমেলার সামনের সড়ক। বাবা সেদিন বই দিয়েই নিজের মাথাটিকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। রক্তে ভেসে গিয়েছিল তার শরীর, কিন্তু তিনি কাঁদেননি, ভয় পাননি, পুলিশের গাড়িতে হাসপাতালেও যেতে চাননি। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেননি তিনি।
২০০৪ সালের পর থেকে বাবা আর বইমেলার কোথাও নেই। এখন বইমেলা গেলেই মনে হয়, ‘ওই বুঝি বাবা ঝাঁকড়া চুলে হাত দিয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আগামীর স্টলে ঢুকছেন।’ বুঝতে পারি পুরোটাই আমার কল্পনা। মনে মনে ভাবি, সত্যিই কি বাবা নেই এখানে? বাবা সশরীরে বইমেলায় নেই বটে, কিন্তু তার বইগুলো আর তার গভীর চিন্তাগুলো তো বইয়ে আছেই। চিন্তাগুলো ছড়িয়ে পড়ছে তার পাঠকদের মধ্যে।
‘লাল নীল দীপাবলি’, ‘বুক পকেটে জোনাকিপোকা’, ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা’ বইগুলো পাঠক যখন পরম আগ্রহ নিয়ে হাতে তুলে নিচ্ছেন, তখন আমার মনে হয় তার বইয়ের মাধ্যমেই তৈরি হচ্ছে লাখো হুমায়ুন আজাদ। বাবা যে মৃত্যুর পরেও এভাবেই বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। মহামারি যেমন বইমেলাকে বন্ধ করতে পারেনি, ঠিক তেমনি বাবাও মিশে থাকবেন বইমেলার প্রতিটি কোনায় কোনায়।
মৌলি আজাদ ।। হুমায়ুন আজাদের মেয়ে