দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সাধ্যের মধ্যে কোনটা?
পণ্যমূল্যের লাগাম ছুটে গেছে বহু আগেই। এখন ছুটছে বল্গাহীন পাগলা ঘোড়ার মতো। মন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, মুরগির দাম সহসা কমবে না। ওদিকে আবার মুরগি খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক খামারি নাকি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন!
মাংসের দামে আগুন। বিক্রি হচ্ছে আড়াইশো গ্রাম করে। এটা নিয়ে আবার কেউ কেউ আদিখ্যেতা করছেন। কেন গ্রাম হিসেবে মাংস কিনতে হবে? এখানে আমার একটু দ্বিমত আছে। গ্রাম হিসেবে বিক্রি হওয়াকে আমি কোনো মতেই নেতিবাচক হিসেবে দেখি না। আমার কাছে আপত্তির বিষয় হলো—অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি।
আমরা শুধু পড়ে আছি মাংসের দাম নিয়ে। ওদিকে মাছের দামের অবস্থাও ভয়াবহ। আদতে কোন পণ্যটা কেনার মতো সামর্থ্য আছে মানুষের? নিত্যপণ্যের বাজারে যেমন আগুন। অন্য সব জায়গায়ও একই অবস্থা। কোথাও হাত দেওয়ার জায়গা নেই।
আরও পড়ুন >>> দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সংসার আর চলে না
কিছুদিন ধরেই মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন। কিন্তু সঞ্চয় মানুষ করতে পেরেছিলেন কীভাবে? কারণ জীবনযাপন কিছুটা হলেও সহজ ছিল। ফলে নিত্যদিনের সব চাহিদা মিটিয়ে মানুষ কিছুটা সঞ্চয় করতে পেরেছিলেন। এখন যেহেতু সঞ্চয় ভেঙেই খেতে হচ্ছে—সুতরাং নতুন করে সঞ্চয় করার কথা ভাবা অবশ্যই বাতুলতা!
আদতে কোন পণ্যটা কেনার মতো সামর্থ্য আছে মানুষের? নিত্যপণ্যের বাজারে যেমন আগুন। অন্য সব জায়গায়ও একই অবস্থা। কোথাও হাত দেওয়ার জায়গা নেই...
এরমধ্যে আসছে রমজান। রোজা এলে আমাদের পণ্যমূল্যের দাম এমনিতেই কয়েকগুণ বেড়ে যায়—এটা আমাদের বাজার ব্যবস্থার স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন >>> ঋণ করে যেন ঘি না খাই
প্রতি বছরই রোজার এক দেড় মাস আগে থেকে আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা জোর গলায় বলতে থাকেন সেই একই বুলি—প্রয়োজনীয় সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে। এবার কোনোভাবেই কোনো অসাধু চক্র অহেতুক দাম বাড়াতে পারবেন না। কিন্তু এসব বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কর্তাদের বক্তব্য এবং অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো দুটোই চলতে থাকে সমান্তরাল। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
কোনো পণ্যের দাম অতিরিক্ত বেড়ে গেলে সাধারণভাবে আমরা বলি—অমুক পণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে! কিন্তু কিছুদিনে যে হারে পণ্যের দাম বেড়েছে, এখন এটাকে আমরা কী বলব? পণ্যমূল্য তো এখন চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছেড়ে ছুটছে তো ছুটছে!
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, ৪৭ নিত্যপণ্যের মধ্যে ২৬টিরই দাম বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। একে অস্বস্তিকর বা অতিরিক্ত নয় বলছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী। অথচ তিনিই গত মাসে বিদ্যুতের দাম পাঁচ শতাংশ বাড়ার পর বলেছিলেন, সাধারণ মানুষের জন্য এটি চাপ নয়!
হ্যাঁ মানছি, গত কিছুদিনে বিশ্ববাজারেও বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে অনেক। কিন্তু সেই বাস্তবতা এদেশের মানুষ মানবেন কেন? মানুষকে তো অনেক গল্প শোনানো হয়েছে এত দিন! এখন হঠাৎ করে এই ধাক্কা মানুষ সইবেন কেমন করে? এছাড়া উন্নত দেশগুলোয় দাম বেড়েছে ঠিক আছে, কিন্তু তাদের যে রকম বাজার ব্যবস্থাপনা আছে, আমরা কি তার ধারে কাছেও যেতে পেরেছি? উল্টো নানা রকম কথা বলে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা মানুষের কাটা গায়ে নুনের ছিটে দিয়ে থাকেন।
আরও পড়ুন >>> আর কত চাপ সামলাবে?
সব মিলিয়ে মানুষের খুব নাজেহাল অবস্থা। মানুষ খুব কষ্টে আছেন। আমরা সবাই খুব কষ্টে আছি। প্লিজ আমাদের কথা ভাবুন একটু। সাধারণ মানুষের হাতে কোনো বিকল্প নেই। তারা বেগম পাড়া, সাহেব পাড়ার গল্প শোনেন কেবল। তারা চোখের সামনে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার গল্প শোনেন। তারা বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোমের গল্প শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
সাধারণ মানুষের হাতে কোনো বিকল্প নেই। তারা বেগম পাড়া, সাহেব পাড়ার গল্প শোনেন কেবল। তারা চোখের সামনে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার গল্প শোনেন....
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কালে সাধারণ মানুষের ভীষণ কান্না পায়। তারা কাঁদতেও পারেন না। শুধু পণ্যমূল্য কেন, দাম বেড়েছে আরও অনেক কিছুর। ক্রেতার যেমন নাভিশ্বাস, বিক্রেতারও তেমন একই কথা। দাম এতটা বাড়ার পরেও ব্যবসায়ীরা বলেন, লাভের গুড় পিঁপড়ে খাচ্ছে। তাদেরও নাকি ব্যবসায় মন্দা! আমার প্রশ্ন এত টাকা তাহলে যায় কই?
হ্যাঁ, দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির কালে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু মানুষের চাহিদার তুলনায় তা কি পর্যাপ্ত? এই পরিসর আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে কি? সরকারেরও নানা সীমাবদ্ধতা আছে, মানি। তাই সরকারের কাছে আকাশ কুসুম কিছু চাই না। শুধু চাই- সবকিছুকে একটু নিয়মের মধ্যে আনেন প্লিজ।
আরও পড়ুন >>> আইএমএফের ঋণ : স্বস্তির না শঙ্কার?
চুরি, দুর্নীতির লাগাম টানুন। টাকা পাচার রোধ করুন। কতিপয় মানুষের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া বন্ধ করুন। সব যদি নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে আসে, যদি চুরি দুর্নীতি বন্ধ হয়, অবৈধ মুজতদারি, চোরাকারবারি, সিন্ডিকেট বন্ধ হয়, উপরতলা নিচতলা সবাই যদি অন্যায্য সুবিধা নেয়া বন্ধ করেন—তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ, আপনাদের বৈশ্বিক বাজারের দোহাই মেনে নেব। কিন্তু কতিপয় অসাধু লোক সব লুটেপুটে খাবেন আর সাধারণ মানুষ তার খেসারত দেবেন, এটা হতে পারে না। এটা হতে দেওয়া উচিত না। দোহাই আপনাদের, এদের একটু থামান।
৫০ বছরে এই দেশটা এগিয়েছে অনেক। অনেক অসাধ্যকে সাধন করেছি আমরা। অনেক অধরাকে ধরেছি। কেন আমরা পারব না, চুরি বাটপারি, চোরাকারবারি, দুর্নীতি বন্ধ করতে? চাইলে আমরা অবশ্যই পারবো।
আমাদের শুধু দরকার সদিচ্ছা। আন্তরিক সদিচ্ছা। ইচ্ছে থাকলে আমরা পারবই। আমরা বড় আশা নিয়ে পথ চেয়ে আছি! আবারও বলছি, আমরা অবশ্যই পারব। আমাদের পারতেই হবে।
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি