যমদূত কি আমাদের সাথেই ঘুরছে?
ঢাকাসহ সারা দেশে অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ ও ভবনধসের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। এসব ঘটনায় আহত ও নিহত হচ্ছেন অনেক শ্রমিক, কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ। ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই নিরপরাধ।
শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, ছোট-বড় প্রায় ২৫০টি কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, ভবনধস, বয়লার বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন ঘটনায় ৫ হাজারের বেশি শ্রমিকের মৃত্যু এবং ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক আহত, পঙ্গুত্ববরণ করে মৃত্যুযন্ত্রণায় ধুঁকছে (দৈনিক কালবেলা, ৯ মার্চ ২০২৩) । কেমন এমন হয়? এর উত্তর কি কারও জানা?
ধরুন, আপনি আপনার সন্তান এবং পরিবার নিয়ে ঘরে খুব আরাম করে ঘুমিয়ে আছেন। যেহেতু আপনারা সকলেই সুস্থ, সেক্ষেত্রে ঘরে খুব একটা বিপদের আশঙ্কা নেই বললেই চলে। কিন্তু হঠাৎ করে বিকট শব্দে আপনার ঘরের দেয়াল ভেঙে পড়ল, কিছু বোঝার আগেই আপনার সাজানো গোছানো সংসার ধূলিসাৎ হয়ে গেল।
আরও পড়ুন >>> স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নাই
কিংবা ধরুন, আপনি খুব সাবধানে চারপাশ সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করেই ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। হঠাৎ করে বিকট এক বিস্ফোরণ আপনাকে উড়িয়ে নিয়ে রাস্তার অপর পাশে নিয়ে ফেলল।
বা ধরুন, আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন। উপর থেকে গার্ডার পড়ে আপনার প্রাণ কেড়ে নিল। এসব চিন্তা করা যায়?
কয়েকদিন ধরে যা ঘটছে, এটি আমাদের শহরে নতুন কিছু নয়। আগেও ঘটেছে, কিন্তু আমরা পাত্তা দেইনি। আর পাত্তা দেইনি বলেই আজ আমাদের এই অবস্থা।
সিনেমার মতো মনে হলেও এইরকম ঘটনা কিন্তু ঘটছে। সবক্ষেত্রেই আপনি নিজে সচেতন থাকলেও অন্যের ভুলের মাশুল আপনাকেই দিতে হচ্ছে।
এই শহরে বাসিন্দাদের প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কিত থাকতে হয়, এই বুঝি যমদূতের সাথে দেখা হয়ে গেল। স্বাভাবিক মৃত্যুর যেন কোনো গ্যারান্টিই নেই।
গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেই সময় যে ছেলেটি তার মায়ের জন্য ইফতারি নিতে এসেছিল, সেই ছেলেটি কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানত না, আমাদের শহর তার জন্য কি মৃত্যুফাঁদ পেতে রেখেছিল? আর তা না হলে কয়েকদিনের জন্য দেশে ঘুরতে এসে কাউকে সরাসরি পরপারে চলে যেতে হয়? তার মায়ের জন্য কী উত্তর আছে আমাদের কাছে?
আরও পড়ুন >>> এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!
তার কিছুদিন আগে সায়েন্সল্যাব এলাকার তিন তলার একটি ভবনে হঠাৎ বিস্ফোরণে তিন তলার দুই পাশের দেয়াল পর্যন্ত লন্ডভন্ড হয়ে যায়। বিস্ফোরণে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
৬ মার্চ, সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণে নিহত হয় ৭ জন। ১৯ ফেব্রুয়ারি, গুলশান–২ নম্বরের বহুতল ভবনে আগুন লেগে কয়েকটি তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ জানুয়ারি, রাজধানীর মগবাজার এলাকায় ওষুধের দোকানের সামনে একটি প্লাস্টিকের ড্রামে বিস্ফোরণ ঘটনায় ৩-৪ জন আহত হয়।
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় শোয়ার ঘরে আগুনে পুড়ে মা ও দুই শিশুসন্তানের মৃত্যু হয়েছে। আরও কত কত যে ঘটনা ঘটেছে, যার বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না।
কয়েকদিন ধরে যা ঘটছে, এটি আমাদের শহরে নতুন কিছু নয়। আগেও ঘটেছে, কিন্তু আমরা পাত্তা দেইনি। আর পাত্তা দেইনি বলেই আজ আমাদের এই অবস্থা।
এই ঘটনাগুলো থেকে কি শিক্ষা গ্রহণ করছি আমরা? যেদিন ঘটনা ঘটছে, তার ১-২ দিন আমরা একটু হা-হুতাশ করে, আবার সব ভুলে যাচ্ছি।
আরও পড়ুন >>> শহর যেন মৃত্যুফাঁদ
সবগুলো ঘটনা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে খুব সহজ-সরল বিষয় জানা যায়, তা হচ্ছে আমাদের সচেতনতার অভাব এবং নিয়মকানুন মেনে না চলার অভাব।
সবগুলো ঘটনা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে খুব সহজ-সরল বিষয় জানা যায়, তা হচ্ছে আমাদের সচেতনতার অভাব এবং নিয়মকানুন মেনে না চলার অভাব।
সবকিছুতেই আমাদের খুব অবহেলা, সব বিষয়েই গা-ছাড়া ভাব। নিজের স্বার্থ হাসিল হয়ে গেলে, এতে অন্যের কী হলো, তাতে আমাদের হয়তো কিছুই যায় আসে না।
তাহলে জাতি হিসেবে আমরা খুবই স্বার্থপর, যারা শুধু নিজের বুঝটাই বোঝে? একটু সচেতন এবং নিজের বুঝটা একটু কম বুঝলেই কিন্তু অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
কোনো নিয়ম মেনে না চলার যে দর্পে আমরা ঘুরে বেড়াই, সেই দর্প যতদিন না খণ্ডিত হবে, ততদিন আমাদের এই দুর্ভোগ যাবে না।
আরও পড়ুন >>> দুর্ঘটনা নাকি খুন?
আরেকটা কাজ করতে পারি। ‘আগে আমি’ এই দুটি শব্দের পরিবর্তে যদি ‘আগে আপনি’ এই শব্দ দুটি আমরা শিখতে পারি, তাহলে হয়তো অনেক বিপদ থেকেই রক্ষা পাওয়া যায়। কারণ সবকিছুতেই আমাদের খুব তাড়াহুড়ো এবং নিজের স্বার্থটা সবার আগে।
স্বার্থপর সমাজের জন্য হয়তো প্রকৃতির আশীর্বাদও একটু কম থাকে।
শুভাশীষ ভৌমিক ।। কান্ট্রি ডিরেক্টর, অস্ট্রেলিয়ান মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি