বঙ্গবন্ধুর হাতেই স্থাপিত বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের মূলস্তম্ভ
স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলা হয় রাজনীতির কবি। তিনি শুধু স্বপ্নস্রষ্টা ছিলেন না, ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। স্বাধীনতার পরপরই তিনি একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, কপর্দকহীন দেশ গঠনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন এবং ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
দেশে তখন খাদ্য নেই, অর্থ নেই, ব্যাংক রিজার্ভ শূন্য, বিপর্যস্ত অর্থনীতি; সেই সঙ্গে রাস্তা-ঘাট, রেলপথসহ সব যোগাযোগের মাধ্যম এবং অবকাঠামোতে শুধু ধ্বংস আর ধ্বংসের চিহ্ন। প্রশাসনিক ব্যবস্থা এমনকি পুলিশ-সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী তখনও পুরোপুরি পুনর্গঠিত হয়নি।
এমনই একটি ভঙ্গুর এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে দেশ গঠনের দায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধু ব্যাপকভাবে জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন।
আজীবন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলার খেটে খাওয়া, গরিব-দুঃখীসহ সর্বস্তরের মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। তিনি এমন একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং সুখী-সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন, যেখানে বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে পাঁচটি মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুনিশ্চিত করা যাবে। আর এই মৌলিক অধিকারগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি তার রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং নীতিমালা প্রণয়নে সচেষ্ট হন। পাঁচটি মৌলিক অধিকারের অন্যতম স্বাস্থ্যসেবাকে তিনি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন এবং তা বাস্তবায়নে সুপরিকল্পিতভাবে কর্মযজ্ঞ শুরু করেন।
বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র আমানত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান-এর ১০ (ক)-এ চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার এবং ১৮(১)-এ জনগণের পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যকে রাষ্ট্রের কর্তব্য বলে ব্যক্ত করেন। তিনি তার আন্তরিকতা, বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতা দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জনগণের চিকিৎসা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করা অবশ্যই জরুরি।
বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যচিন্তা ছিল অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত, যুগোপযোগী, আধুনিক এবং জনকল্যাণমুখী। সত্যি বলতে কি, তারই চিন্তাপ্রসূত নীতিমালা এবং পরিকল্পনায় আজকের বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গোড়াপত্তন বা ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা, পরিকল্পনা ও শক্ত অবকাঠামো রেখে গেছেন, যার ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে আজকের বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিত্তি।
বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র আমানত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান-এর ১০ (ক)-এ চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার এবং ১৮(১)-এ জনগণের পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যকে রাষ্ট্রের কর্তব্য বলে ব্যক্ত করেন। তিনি তার আন্তরিকতা, বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতা দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জনগণের চিকিৎসা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করা অবশ্যই জরুরি।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রাম বাংলার আবহে, প্রান্তিক জনগণের মধ্যেই। তার সারা জীবনের রাজনীতি ছিল গরিব দুঃখী, খেটে খাওয়া ও মেহনতি মানুষের জন্য। সুখে, দুঃখে দেশের প্রতিটি মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিযুক্ত রাখাই ছিল তার সারা জীবনের অন্যতম সাধনা ও উদ্দেশ্য। স্বভাবতই বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন গ্রামবাংলার উন্নয়ন ও কৃষির বিকাশকে। সঙ্গে সঙ্গে তার আজন্ম স্বপ্ন ছিল, দেশের প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় এবং প্রান্তিক জনগণের জন্য ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া।
বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনা শুধু রাজধানী বা শহরকেন্দ্রিক ছিল না। বরং জেলা, থানা, ইউনিয়ন এবং গ্রামসহ তৃণমূল পর্যায়ে সেই সুযোগ নিশ্চিত করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। দেশের একজন মানুষও যেন চিকিৎসার আওতার বাইরে না থাকে, এমনকি কাউকে যেন অর্থের অভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতে না হয়-এই ছিল তার দর্শন। আর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে তিনি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, মহকুমা হাসপাতাল, থানা হেলথ কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুবিন্যস্ত স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা প্রণয়নের পথ দেখিয়েছিলেন।
পরে তার উত্তরসূরি এবং সুযোগ্যা কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই পূর্ণতা পায় এই কমিউনিটি ক্লিনিক ভিত্তিক চিকিৎসাসেবা, যা বর্তমানে প্রান্তিক জনগণের ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসার প্রধান আশ্রয়স্থল হিসেবে স্বীকৃত এবং ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। আজ বিশ্বের দরবারে এই কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থা একটি রোল মডেল।
• স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে থানা পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ছিল খুবই দুর্বল। সেখানে একদিকে যেমন ডাক্তার, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য-কর্মীর অভাব ছিল, তেমনি সার্বিক অবকাঠামো ছিল খুবই নড়বড়ে। বঙ্গবন্ধুই এসবের উন্নতির লক্ষ্যে থানা হেলথ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রায় প্রতিটি থানায় স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করেন।
• ১৯৭২ সালে সব জেলায় পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল ছিল না, এমনকি দেশে সর্বসাকুল্যে হাসপাতাল ছিল মাত্র ৬৭টির মতো। এই অবস্থায় তিনি প্রতি জেলায় একটি করে জেলা হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজ প্রতিটি জেলায় সদর হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে।
• একই সময়ে তিনি চিকিৎসক সংকট মোকাবিলায় দ্রুততম সময়ে তৎকালীন মিটফোর্ড হাসপাতালকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পরিণত করেন এবং প্রথম ব্যাচেই ১৫০ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিশ্চিত করেন।
• তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশে চিকিৎসকদের এম.বি.বি.এস পরবর্তী উচ্চ শিক্ষার এবং প্রশিক্ষণের তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না, এমনকি কোনো প্রতিষ্ঠানও ছিল না। তাদেরকে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন বা বিদেশের অন্য কোনো দেশে যেতে হতো। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সে সুযোগও বন্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু দেশেই উচ্চ প্রশিক্ষিত ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং তৎকালীন ‘শাহবাগ হোটেল’-কে ‘আই.পি.জি.এম অ্যান্ড আর’ বা ‘পিজি হাসপাতালে’ রূপান্তরিত করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই পূর্ণাঙ্গ এবং দেশের সর্বপ্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সেই প্রতিষ্ঠানটি আজ দেশ-বিদেশের চিকিৎসকদের বিভিন্ন বিষয়ে স্পেশালিস্টসহ উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বুকে স্বমহিমায় দেশের গৌরব বৃদ্ধি করে চলেছে।
• এছাড়াও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিকমানের আরও বিশেষজ্ঞ তৈরির প্রয়োজনে ১৯৭২ সালের জুন মাসে অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) প্রতিষ্ঠা করেন, যা ‘ব্রিটেনের রয়েল কলেজ অব ফিজিসিয়ানস্ অ্যান্ড সার্জনস্’-এর আদলে গড়ে তোলা। মেডিকেল উচ্চশিক্ষার এই দুটি বিদ্যাপীঠ থেকে প্রতিনিয়ত অসংখ্য চিকিৎসক বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে উচ্চতর ডিগ্রি (যেমন: FCPS, MD, MS, Diploma) নিয়ে দেশের জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
• স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর মেডিকেল ছাত্রদের পাশাপাশি প্যারামেডিকেল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে মেডিকেলের বিভিন্ন বিষয়ে টেকনিশিয়ান এবং নার্সিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে নার্সদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুর সময়েই শুরু হয়েছিল।
• স্বাধীনতার পরপরই অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা সেবার জন্য বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিদেশে পাঠান। তাছাড়া দেশে অবস্থানরত অসংখ্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের যথাযথ সুচিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন বা নিটোর-যা বর্তমানে পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত। আহতদের দেশেই চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য তিনি বিখ্যাত আমেরিকান অর্থোপেডিক সার্জন ডা. গ্রাস্ট তার স্ত্রী ডা. মেরিকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানান। তাদের নেতৃত্বেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা হয়।
• দেশি ডাক্তাররা যেন এই চিকিৎসার হাল ধরতে পারেন, সে লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠানের অধীনেই দেশে সর্বপ্রথম এম.এস ও ডি. অর্থো নামক উচ্চতর কোর্স ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেন।
• আহত রোগীদের অন্যান্য চিকিৎসার পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি নিশ্চিত করতে তিনি ১৯৭২ সালে উচ্চতর কোর্স ও চিকিৎসা সেবা চালু করেছিলেন। একই সময়ে অর্থোপেডিক সার্জারির পাশাপাশি প্লাস্টিক সার্জারি এবং পুড়ে যাওয়া রোগীদের সেবার জন্য প্লাস্টিক সার্জারিরও কার্যক্রম শুরু হয়। ঐ সময়ের সেই বিচক্ষণ উদ্যোগের পরিপূর্ণ ফলশ্রুতিই আজকের ‘শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি’।
• এছাড়াও তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, বিশেষায়িত সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং দেশের তৎকালীন একমাত্র কলেরা হাসপাতালকে আইসিডিডিআর,বি হিসেবে রূপান্তরিত করেন।
• শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যের দিকেও বঙ্গবন্ধুর সজাগ দৃষ্টি ছিল। আর এই লক্ষ্যেই তিনি ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।
• পাশাপাশি মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তিনি মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সারা দেশে শিশুস্বাস্থ্য ও মাতৃস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য অসংখ্য শিশু ও মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
• তাছাড়া জমি দেওয়ার মাধ্যমে বারডেম হাসপাতাল ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গোড়াপত্তন করেন, যা বর্তমানে সুনামের সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু ধোলাইখালে এক বিশাল জনসভায় ঘোষণা দেন যদি বাংলাদেশ কোনোদিন স্বাধীন হয় তিনি ঢাকা ন্যাশনাল হাসপাতালকে বাঁচাবেন। স্বাধীনতার পর তিনি প্রতি বছর ন্যাশনাল হাসপাতালকে ৫০ হাজার টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করেন।
• ‘প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধ শ্রেয়’-এ নীতিকে বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি ১৯৭৪ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন বা নিপসম প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে বাংলাদেশে প্রিভেনটিভ মেডিসিনের মহীরুহ হিসেবে কাজ করে চলেছে।
• পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষণার প্রচলন, মান নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বা বি.এম.আর.সি প্রতিষ্ঠা করেন।
• আবার দেশের সব মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। ভবিষ্যতে জনবিস্ফোরণের বিষয়টি উপলব্ধি করে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং সে লক্ষ্যে তিনি পরিবার পরিকল্পনা বোর্ডকে রাজস্বখাতে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর স্থাপন করেন এবং তখন থেকেই এই বিভাগের অধীনে ডাক্তার নিয়োগের ব্যবস্থা করেন।
• ১৯৭৪ সালে ‘জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান’ এবং এরই ধারাবাহিকতায় ‘বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ’ গঠিত হয় তার নির্দেশনায়। ক্ষতিকর, অপ্রয়োজনীয় ও বেশি দামি ওষুধ আমদানি বন্ধ এবং ওষুধের যৌক্তিক ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন।
এভাবে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য গবেষণা এবং অবকাঠামোর যে অনন্য সাধারণ উৎকর্ষ জাতির জনকের পদক্ষেপে হয়েছিল, তা অনস্বীকার্য এবং চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
• তখন সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চিকিৎসক হওয়ার আগ্রহ থাকলেও পাস করার পর তাদের চাকরির কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। নবীন চিকিৎসকদের জন্য এম.বি.বি.এস পাসের পরপরই তিনি সর্বপ্রথম ইনসার্ভিস ট্রেনিং বা ইন্টার্নশিপ নামক বৈতনিক প্রশিক্ষণ চালু করেন। শুধু তাই নয়, তাদের প্রশিক্ষণকালীন সময়কে নিয়মিত চাকরির অন্তর্ভুক্ত করেন এবং এক বছর প্রশিক্ষণ শেষ করার পর পরই সরকারি চাকরির অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে স্থায়ী চাকরি হিসেবে পদায়ন করার ব্যবস্থা করেন।
• শুধু ডাক্তারদের কাজের অনুমোদন এবং মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭২ বাংলাদেশ মেডিকেল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। যা ১৯৭৩ সালের পার্লামেন্টে পাস করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশ মেডিকেল এবং ডেন্টাল কাউন্সিল বা বি.এম.ডি.সি প্রতিষ্ঠা পায়।
• আবার ডাক্তারদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুই তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা থেকে প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড মর্যাদা দেন। শুধু ডাক্তার নয়, তিনি নার্সদেরও যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে জনগণকে নার্সদের প্রতি যেকোনো ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আহ্বান জানান। নার্সিং সেবার সুযোগ ও মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট নার্সিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও নানামুখী পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রাম বাংলার আবহে, প্রান্তিক জনগণের মধ্যেই। তার সারা জীবনের রাজনীতি ছিল গরিব দুঃখী, খেটে খাওয়া ও মেহনতি মানুষের জন্য। সুখে, দুঃখে দেশের প্রতিটি মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিযুক্ত রাখাই ছিল তার সারা জীবনের অন্যতম সাধনা ও উদ্দেশ্য।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন আই.পি.জি.এম অ্যান্ড আর-এর কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে দীর্ঘ বক্তব্য দেন-
”……যে রক্ত সংরক্ষণ কেন্দ্র আপনারা খুলেছেন, এটা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। গবেষণার দিক দিয়ে এর অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। ….স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন স্তরের লোকজন জীবন দিয়েছেন। এ পর্যন্ত যে নাম আমরা পেয়েছি, তাতে ৫০ জন ডাক্তার শহীদ হয়েছেন (পরবর্তী সময়ে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৪)। এত জন ডাক্তার তৈরি করতে কী লাগে, তা আপনারা জানেন।…….”
শহীদ ডাক্তারদের প্রতিও তার অগাধ শ্রদ্ধা আর সম্মান প্রকাশিত হয়েছিল ভাষণে। শহীদ ডাক্তারদের নামের তালিকা প্রণয়নের এবং তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু এ সময় আইপিজিএম অ্যান্ড আরের তৎকালীন ডাইরেক্টর প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলামকে বলেন- ‘দেশের স্বাধীনতার জন্য চিকিৎসকরা এত বেশি শাহাদতবরণ করেছেন, আর কোনো পেশার লোক স্বাধীনতার জন্য এত বেশি শাহাদতবরণ করেনি। প্রফেসর ইসলাম, আমি আপনাকে অনুরোধ করব যেসব শিক্ষক, চিকিৎসক শাহাদতবরণ করেছেন তাদের নাম লিখে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করুন।’ তার সেই নির্দেশনার বাস্তবরূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক ভবনের প্রবেশমুখের সামনের দেয়ালে তা লিপিবদ্ধ করা আছে, যা আজও দৃশ্যমান।
ভাষণে তিনি আরও বলেন,…….আমাদের একটা ইনস্টিটিউটের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। আমি অন্যান্য দেশে দেখেছি। আপনারা সেটা করেছেন। এটা নিয়ে জাতি গৌরববোধ করতে পারে। যদি আরও কিছু প্রয়োজন হয় সরকার নিশ্চয়ই সেদিকে নজর রাখবে।
কিন্তু শুধু পয়সা দিয়ে কিছু হয় না, সেটা আপনারা বোঝেন। পয়সার সঙ্গে সঙ্গে যেটা দরকার সেটা হলো মানবতাবোধ। আমরা যেন মানবতাবোধ হারিয়ে ফেলেছি।
…………বড় ডাক্তার যারা আছেন, যারা স্পেশালিস্ট আছেন, তারা গ্রামের দিকে কেন যেতে চান না? গ্রামে তো শতকরা ৯৫ জন বাস করে। তারাই তো সম্পদ দিয়ে আমাদের সবকিছু করেছেন। নতুন নতুন শহর দেখেন, আপনাদের দোতলা অফিস দেখেন, মেডিকেলের পোস্ট গ্রাজুয়েট দেখেন, যেখানেই যান সবকিছুই তো এই বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের পয়সায়। তাদের দিকে কেন নজর দেবেন না? সাদা পোশাকের কোনো লোক দেখলে আপনারা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেন আর গরিব, দুঃখী কোনো লোক এলে চিৎকার করে বাইরে বসতে বলেন কেন? এই মনোভাবের পরিবর্তন আনতে হবে।
………..বিদেশে আমাদের অনেক ডাক্তার ও প্রফেসরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমাকে দেখতে এসেছিলেন তারা। তাদের বলেছি, আপনারা সবাই দেশে ফিরে আসুন। দেশ আপনাদের, দেশ আপনাদের দাবি করতে পারে। কারণ যে মেডিকেলে পড়েছেন, সে মেডিকেল কলেজগুলোতে জনগণের টাকা থেকে আপনাদের সাহায্য করা হয়েছে। আর আপনারা লেখাপড়া শিখে বিদেশে গিয়ে বড় ডিগ্রি নিয়ে সেখানেই বেশি টাকা উপার্জন করতে চান, সেটা বড় অন্যায়। কারণ আপনারা যে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তার পেছনে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তা এ দেশের দুঃখী মানুষের ট্যাক্সের টাকা থেকে। বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে আরও বলেছিলেন, ‘কার টাকায় তুমি ডাক্তার, কার টাকায় তুমি ইঞ্জিনিয়ার?...’
………আপনারা ডাক্তার যারা আছেন, তাদের অনেকেই তো বিদেশে ঘুরে এসেছেন। বিদেশে যা শিখে এসেছেন তা আমাদের দেশে কেন চালু করেন না। এখানে আসলে আপনারা মনে করেন যে, আপনারা বড় ডাক্তার সাহেব হয়ে গেছেন… আর নার্সরা কিছুই না। কিন্তু ওখানে ডাক্তার নার্সের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সমীহ করে কথা বলে। ইজ্জতের সঙ্গে কথা বলে। যে কাজই করুক না কেন সে কাজের জন্য তার সম্মান আছে।
এছাড়া তিনি ওয়ার্ড বয়, ক্লিনার এবং সুইপারদের কাজের কথাও উল্লেখ করেন। তাদেরও সম্মান দিয়ে সবার কথা বলা উচিত। কারণ সবাই সেবক। সবার সম্মিলিত কাজ ছাড়া উন্নত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শুধু নিজেদের পেটের তাগিদে তারা কাজ করে না, সমাজের প্রয়োজনেও তারা কাজ করে।
বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন এসব বক্তব্য থেকেই উপলব্ধি করা যায়, জাতির পিতা চেয়েছিলেন চিকিৎসকরা গরিবের সেবা করুক, জনগণের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখুক এবং তাদের মধ্যে একটি মানবিকবোধ জাগ্রত হোক। বঙ্গবন্ধু সেদিন আরও যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-
• মানবতাবোধ, মনুষত্ব ও সৎ থেকে ডাক্তার-নার্স-কর্মচারীদের চিকিৎসার মতো মহান পেশায় যুক্ত থাকতে সবাইকে আহ্বান জানান।
• চিকিৎসক-নার্সদের দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত রোগীদের চিকিৎসা দিতে আন্তরিক হওয়ার জন্য বার বার তাগিদ দেন।
• কঠোরভাবে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে গুরুত্ব দেন।
• পরিবার-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
• প্রতিটি থানায় ১ বছরের মধ্যে ২৫ বেডের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেন।
• হাসপাতালে ওয়ার্ড তৈরি করার জন্য সমাজের বিত্তবানদেরকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধু তার অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও প্রশাসনিক দূরদর্শিতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে যদি সঠিক উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে হয় তা হলে এমন কাউকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ে দায়িত্ব দিতে হবে যিনি স্বাস্থ্যের আদ্যোপান্ত জানেন, বোঝেন এবং অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবেন, সে কারণেই স্বাধীন বাংলার প্রথম স্বাস্থ্য সচিব হিসেবে বঙ্গবন্ধু একজন চিকিৎসক ডা. টি হোসেন সাহেবকে সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সচিবের দায়িত্বও পালন করেন একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষক।
জাতির পিতার স্বাস্থ্য ভাবনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল জনগণের সার্বিক কল্যাণ। তিনি চেয়েছিলেন প্রচুর ডাক্তার হবে, ডাক্তাররা মর্যাদাবান হবে, তাদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত হবে, আর এই ডাক্তাররাই সর্বস্তরের জনগণকে সেবা দেবে। রাষ্ট্র সব নাগরিকের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করবে, আর এজন্যই তিনি এক সুবিন্যস্ত বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা এঁকেছিলেন।
শুধু তাই নয়, রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নয়নকল্পে গবেষণা, এমনকি ওষুধ নীতি-সবমিলিয়ে কী ছিল না তার পরিকল্পনা ও কর্মযজ্ঞে! প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে তিনি যে রূপরেখা দিয়ে গিয়েছিলেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, আজও সেগুলোর বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। জনগণ যতটুকু স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন, তা তারই কর্মপরিকল্পনা এবং কর্মের ধারাবাহিক ফসল বলা চলে।
বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও আগেই অনেক দূর এগিয়ে যেত। দেশ স্বাধীনের পর তিনি সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের স্বাস্থ্যখাতকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করে যেতে পারেননি।
জাতির পিতা দেশকে নিয়ে যে চিন্তা করতেন, তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনে আত্মনিয়োগ করে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন
বঙ্গবন্ধুর আজন্ম স্বপ্নের স্বাস্থ্যসেবার সফল এবং স্বার্থকভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার সুযোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া বাস্তবভিত্তিক ও ব্যাপক কার্যক্রম দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে এবং আগামীতে একটি পূর্ণাঙ্গ, সুপরিকল্পিত ও সুদূরপ্রসারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে, এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ।। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক