সাংবাদিকতার আকাল
দেশে সাংবাদিকতার আকাল চলছে। এটা ঠিক এক যুগে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। গণমাধ্যমের সংখ্যা বিচারে যেমন যুগান্তকারী, আবার সাংবাদিকতার হারিয়ে যাওয়ার বিচারেও অবশ্যই যুগান্তকারী।
চারদিকে এখন গণমাধ্যমের জোয়ার। সেই জোয়ারে ভেসে গেছে সাংবাদিকতা। পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন, রেডিওর সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। আর সামাজিক মাধ্যমের সর্বগ্রাসী দাপটের স্রোতেও ভেসে যেতে বসেছে সাংবাদিকতা।
একসময় ভাবা হচ্ছিল, প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যৎ বুঝি শেষ। অনলাইন এসে দখল করে নেবে। কিন্তু সেই আশঙ্কা সত্যি হয়নি। অনলাইন যুগ এসেছে বটে, তবে ফুরিয়ে যায়নি প্রিন্ট মিডিয়ার দাপট। বরং বাংলাদেশে নতুন নতুন দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে; নতুন অবয়বে, ভিন্ন আঙ্গিকে।
প্রিন্ট মিডিয়া অভিযোজন প্রক্রিয়ায় নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে। এখন একটি দৈনিক পত্রিকার ছাপার অংশটুকু ছাড়াও আরও অনেক ব্যাপ্তি আছে। অনলাইন, ভিডিও প্লাটফর্ম, এমনকি রেডিওর মতো নিউজ শোনাও যায়।
প্রিন্ট মিডিয়া অভিযোজন প্রক্রিয়ায় নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে। এখন একটি দৈনিক পত্রিকার ছাপার অংশটুকু ছাড়াও আরও অনেক ব্যাপ্তি আছে। অনলাইন, ভিডিও প্লাটফর্ম, এমনকি রেডিওর মতো নিউজ শোনাও যায়।
ছাপা অংশের চেয়ে অন্য অংশের আয় বেশি। অনেক পত্রিকা ছাপার লস কমাতে চাহিদার চেয়েও কম পত্রিকা ছাপে। শুধু পত্রিকাওয়ালারাই চালাক তাই নয়, অনলাইন বা টেলিভিশন মিডিয়াও যুগের সাথে তাল মেলাতে নিজেদের বদলে নিয়েছে।
অনেক স্যাটেলাইট টেলিভিশনের দর্শক টেলিভিশন পর্দার চেয়ে ফেসবুক বা ইউটিউবে বেশি। অনেক টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের চেয়ে ইউটিউব থেকে বেশি আয় করে।
টেলিভিশন মানে শুধু টেলিভিশন নয়; সাথে অনলাইন, ইউটিউব, ফেসবুক ফ্রি। অনলাইন প্লাটফর্মগুলোরও ছাপা পত্রিকা ছাড়া আর সবই আছে। গণমাধ্যমের এই বহুমুখী, বহুমাত্রিক বিকাশে সাংবাদিকদের চাকরির ক্ষেত্র বেড়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে আয় বেড়েছে। কিন্তু আমার খালি আফসোস, এই সবকিছুর সাথে যদি আরও বেশি সাংবাদিকতা থাকতো!
এখন চলছে প্রেস রিলিজ আর উন্নয়ন সাংবাদিকতার যুগ। মহান ব্যক্তিরা যা বলেন, আমরা তাই প্রচার বা প্রকাশ করি। ‘তিনি বলেন’, ‘তিনি আরও বলেন’, ‘তিনি জোর দিয়ে বলেন’ ব্যস সাংবাদিকতা খতম।
উন্নয়ন সাংবাদিকতায় ব্যক্তিগতভাবে সাংবাদিকদেরও আয়-উন্নতি হয় বটে, খালি হারিয়ে যায় সাংবাদিকতা। কোথাও কোনো প্রশ্ন নেই। টেলিভিশনের ফুটেজ থাকার পরও মন্ত্রীরা নিজেদের কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু আর তাদের পাল্টা প্রশ্নে ‘বিব্রত’ করতে চাই না, কেউ ভুলে প্রশ্ন করে ফেললে তাদের চেয়ে আমরা বেশি বিব্রত হই।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায়শই উল্টাপাল্টা কথা বলে নিজের বিপদ ডেকে আনেন। দুইদিন পর সব দোষ সাংবাদিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে হাঁসের মতো গা ঝাড়া দিয়ে পরিষ্কার হয়ে যান। যদিও তার বক্তব্যের রেকর্ড থাকে, তারপরও সাংবাদিকরা সব দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা মন্ত্রীদের বিপদমুক্ত করেন।
ওবায়দুল কাদের হিরো আলমকে নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। সেগুলো প্রচারও হয়েছে। পরে যখন হিরো আলম তাকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলো, অমনি তিনি সুর পাল্টালেন, ‘আমি তো হিরো আলমকে নিয়ে কিছু বলিনি, আমি শুধু মির্জা ফখরুলের কথার জবাব দিয়েছি।’ অথচ ওবায়দুল কাদের যে হিরো আলমকে নিয়ে কথা বলেছেন, সেটা গণমাধ্যমে যেমন রেকর্ড আছে তেমনি ইউটিউবে গেলে এখনো তা পাওয়া যাবে। আমরা কেউ তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে 'বিব্রত' করিনি। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন তো নয় যেন তোষামোদির সম্মেলন।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বন্ধ হয়েছে বটে, তবে তার আগে র্যাব-পুলিশ বছরের পর বছর হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করেছে।
আমরা শুধু র্যাব-পুলিশের পাঠানো প্রেস রিলিজ ফলো করে অস্ত্র উদ্ধারের গল্প ছেপেছি। কোনোদিন প্রশ্ন করিনি, হেফাজতে থাকা ব্যক্তির মৃত্যু তো আপনাদের ব্যর্থতা। তারপরও আপনারা বারবার অস্ত্র উদ্ধারে যান কেন?
আমরা মুক্ত গণমাধ্যম, নির্ভীক সাংবাদিকতার কথা মুখে বলি বটে; কিন্তু বাস্তবে এটি অমাবস্যার চাঁদ। গণমাধ্যম মুক্ত হবে কীভাবে, এর তো পায়ে পায়ে শিকল।
সরকারের প্রকাশ্য ও গোপন নিয়ন্ত্রণ, মাস্তানদের হুমকি, বিজ্ঞাপনদাতাদের আবদার তো আছেই; সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রণ তো ঘরের ভেতর। বড় বড় ব্যবসায়ী একেকটা মিডিয়া খুলেছে, সাংবাদিকতা ভালোবেসে নয়, নিজেদের ব্যবসা বা স্বার্থ পাহারা দেওয়ার জন্য। সাংবাদিকরা যেন ব্যবসায়ীদের লাঠিয়াল।
…এতকিছুর পরও যদি অনলাইনে ঢুঁ মারতেই চান, ঢাকা পোস্ট ডটকম-এ ক্লিক করতে পারেন। ঢাকা পোস্ট ভালো। অন্তত মরার আগেই কুমার বিশ্বজিৎ-এর ছেলেকে মেরে ফেলে না।
তবে সরকার, বিজ্ঞাপনদাতা বা মালিক নন; সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রক তারা নিজে। সেলফ সেন্সরশিপেই হারিয়ে যায় সাংবাদিকতার মূল সুর। এই প্রসঙ্গে সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস উদ্ধৃত করছি, ‘মানবজমিন পত্রিকার ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে একজন গুরুত্বপূর্ণ এমপির সাথে কথোপকথন—
এমপি: ডেইলি স্টারে আপনার লেখাটা পড়লাম। ভালো লেগেছে।
আমি তো সরকারের কার্যক্রম ক্রিটিক্যালি দেখি।
এমপি: তাই তো দেখা উচিত। সবাই তাবেদার হয়ে গেলে তো চলবে না।
কিন্তু আপনারা তো প্রায় সবাইকে তাবেদার বানিয়ে ফেলেছেন।
এমপি: আমরা তো বানাতে চাইবই। আপনারা হচ্ছেন কেন?
সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম, এমপি সাহেব শতভাগ সঠিক বলেছেন।’
আমিও একমত। সরকারি দল তাবেদার বানাতে চাইলেই আমাদের তাবেদার হতে হবে কেন? আসলে আমরা আগে থেকেই তাবেদার। নতুন করে বানাতে হয় না।
শেষ করছি ছেলেবেলায় বাবার কাছে শোনা একটি গল্প দিয়ে। কুমিল্লার লাকসামের দিকে একসময় খুব জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড ছিল 'মামুন বিড়ি'। তো এই বিড়ি কোম্পানির মালিক প্রতিবছর একটা ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করতো।
একবার এক হুজুর এসে ওয়াজে ধূমপানের ক্ষতিকর দিকের বিশাল ফিরিস্তি দিলেন। ধর্ম, স্বাস্থ্য, সামাজিকতা—সব মিলিয়ে ধূমপানের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।
আয়োজকরা খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেন। তবে চতুর হুজুর ওয়াজ শেষ করলেন দারুণ নাটকীয়তায়, ‘আপনারা সবাই তো নামে মুসলমান। উপরওয়ালার আদেশ মানেন না। নিয়মিত নামাজ পরেন না, ঘুষ খান, মিথ্যা কথা বলেন, দুর্নীতি করেন, মানুষ ঠকান। তো আপনারা যখন উপরওয়ালার কথাই শোনেন না, আমার কথা কি আর শুনবেন? ঠিকই ওয়াজ শুনে বাড়ি ফেরার সময় বিড়িতে টান দিবেন। যদি টানই দেন, তবে মামুন বিড়িতেই টান দিয়েন। মামুন বিড়ি ভালো বিড়ি।’
সেই গল্পের মতো এতকিছুর পরও যদি অনলাইনে ঢুঁ মারতেই চান, ঢাকা পোস্ট ডটকম-এ ক্লিক করতে পারেন। ঢাকা পোস্ট ভালো। অন্তত মরার আগেই কুমার বিশ্বজিৎ-এর ছেলেকে মেরে ফেলে না।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ