ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ
পৃথিবী এখন ডিজিটালাইজড। অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমা, শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব সেক্টরেই কম্পিউটার বা সফটওয়্যার ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হয়। কাজের গতিশীলতা, গুণগত মানের উৎকর্ষতা, আধুনিকীকরণ, স্বচ্ছতা ও সহজীকরণের জন্য ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার না করার কথা চিন্তাই করা যায় না। মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞান নিত্যনতুন আবিষ্কার করছে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপরাধীচক্র। তারা সংঘটিত করছে বিভিন্ন সাইবার অপরাধ।
ডিজিটাল ডিভাইস হ্যাকিং করে হ্যাকাররা নানা রকম অপরাধ করছে। হ্যাকাররা মেলওয়্যার (Malware)-এর মাধ্যমে কম্পিউটার সিস্টেম ধ্বংস করে দিচ্ছে। সকল ডিভাইস বিকল করে দিতে পারে। ক্রেডিট কার্ডের টাকা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে তাদের চরিত্র হনন করা হচ্ছে। ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে। গুজব ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে শুরু করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানছে। অশ্লীল ছবি প্রচার করে যুবকদেরকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে।
সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ এবং সাইবার ক্রাইমের বিচারের জন্য বিভিন্ন দেশে আইন আছে। ২০১৮ সালে আমাদের দেশেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়েছে। জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এই আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের কেউ কেউ প্রথম থেকেই আপত্তি তুলেছিলেন। তাদের বক্তব্য, এই আইনের মাধ্যমে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। বিশেষ করে সাংবাদিকরা মুক্তভাবে কোনো কিছু লিখতে পারছেন না।
এই আইনকে সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ কালো আইন বলে আখ্যায়িত করছেন। মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার বলছেন তারা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না, এই আশ্বাস সরকার দিয়েছিল। কিন্তু সাংবাদিকদের অভিযোগ, আইন পাস হওয়ার পর প্রায় ৪৬ জন সাংবাদিককে এই আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। লেখক মুশতাক ও কার্টুনিস্ট কিশোরকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে দশ মাস জেলে রাখা হয়েছিল। শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। ছয়বার জামিন চেয়েও জামিন মেলেনি। শেষ পর্যন্ত লেখক মুশতাক জেলে মৃত্যুবরণ করেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আইন বাতিলের দাবি উঠেছে। এই আইনকে সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ কালো আইন বলে আখ্যায়িত করছেন। মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার বলছেন তারা। তাই এই আইন বাতিল চান।
মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ছবি চাঁদে দেখা গিয়েছে প্রচার করে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটানো হয়েছিল; ২০১৩ সালে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত ইসলামের সদস্যদের বিতাড়িত করার সময় হত্যার গুজব ছড়ানো হয়েছিল; কক্সবাজারের রামু ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে তাণ্ডব ঘটানো হয়েছিল ভুয়া ছবি ও তথ্য প্রচার করে। বাড়িঘর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর এবং পোড়ানো হয়েছিল। এই সকল অপরাধের জন্যই এই আইনের ২৫ ধারা প্রয়োগের প্রয়োজন।
ধারা ২১-এ মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড; ধারা ২৮-এ ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত; ধারা ২৯-এ মানহানির তথ্য প্রকাশ, প্রচার; ধারা ৩১-এ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো এবং ধারা ৩২-এ সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের জন্য দণ্ডের বিধান রয়েছে।
পুলিশের কাছে সচরাচর এসকল সাইবার অপরাধের অভিযোগ আসছে। সমাজে এ ধরনের অপরাধ অহরহ হচ্ছে বিধায় আইনে এই ধারাগুলো সংযোজন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। বাকিগুলো নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই।
পুলিশ প্রশাসনের সকল স্তরে তদারকি সেল গঠন, আইন প্রয়োগের স্বচ্ছতা, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা, ইচ্ছাকৃত অপপ্রয়োগে শাস্তির বিধান রেখে আইনের অপপ্রয়োগ রোধ সম্ভব।
যিনি সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছেন তার মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক ক্ষতি কতটুকু হয়েছে তা কেবল তিনিই বুঝতে পারেন। আন্দোলনকারীদের মধ্যে কিংবা আইনটি বাতিলের দাবি যারা করেন, তাদের কেউ কিংবা তাদের ঘনিষ্ঠ কেউ সাইবার ক্রাইমের শিকার হলে আমার বিশ্বাস তিনি বা তারা নিশ্চয়ই এই আইনের কঠোর প্রয়োগ চাইবেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনোক্রমেই সংবিধান বা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি কালো আইন নয়। তবে এই আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে না, এ কথা বলা যাবে না। অপপ্রয়োগের যে অভিযোগ উঠছে, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে।
আইনের যেসব অস্পষ্টতা আছে তা আইনের ৫৯ ধারা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ আছে। এই ধারার ক্ষমতা বলেই আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশ প্রশাসনের সকল স্তরে তদারকি সেল গঠন, আইন প্রয়োগের স্বচ্ছতা, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা, ইচ্ছাকৃত অপপ্রয়োগে শাস্তির বিধান রেখে আইনের অপপ্রয়োগ রোধ সম্ভব।
এ কে এম শহীদুল হক ।। সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ