সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য ও তার মৃত্যুঞ্জয়ী গান
সম্প্রতি অমরত্বকে আলিঙ্গন করেছে বিশের অল্প কিছু বেশি বয়সী সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য। দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে মৃত্যুর ঠিক আগ দিয়ে দুজন কিডনি ফেইলিওর রোগীকে নিজের দুইটা কিডনি আর দুজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে নিজের কর্নিয়া দুটি দান করে মৃত্যুকে জয় করেছেন সারাহ।
অমরত্বের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরন্তন, অমরত্বের খোঁজে মিশরীয় সম্রাটরা এক সময় বানিয়েছেন আকাশ ছোঁয়া পিরামিড। যুগে যুগে এই এক অমরত্বের নেশাতেই কেউ গড়েছেন তাজমহল তো কেউ জিতেছেন দেশের পর দেশ। কিন্তু অতশত ঝুট ঝামেলায় পা মাড়াননি সারাহ।
তিনি মানুষের মধ্য দিয়েই এই পার্থিব পৃথিবীতে তার শরীরী অনুপস্থিতিতে জীবনকে এগিয়ে নেওয়ায় মনস্থ করেছেন। সারাহর এই মহান দান নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে অনেকে। মানুষের মনে বিষয়টি নিয়ে আগ্রহের সঞ্চার হয়েছে তার চেয়েও ঢের বেশি। বিষয়টি অবশ্য এমনই এবং তা অনেকগুলো কারণেই।
অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক দারুণ আশীর্বাদ। আমাদের শরীরের এমন অনেক দুরারোগ্য রোগ আছে যা ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে আমরা পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে পারি।
কর্নিয়া আর কিডনি ছাড়াও লিভার আর বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের কথা আমাদের অনেকেরই জানা। তবে আমরা বেশিরভাগ মানুষই জানি না হার্ট, ফুসফুস আর ইন্টেস্টাইন ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন (Intestine Transplantation)-এর কথা।
অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক দারুণ আশীর্বাদ। আমাদের শরীরের এমন অনেক দুরারোগ্য রোগ আছে যা ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে আমরা পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে পারি।
অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের ক্ষেত্রে বড় বাধা ডোনার খুঁজে পাওয়া। এজন্য প্রয়োজন হয় নানা ধরনের ম্যাচিংয়ের। সাথে আছে খরচাপাতির বিষয়ও। আর ডোনার, তিনি যত আপনই হন না কেন, ভয়কে জয় করে অর্গান ডোনেট করা সৎ সাহস সবাই সবসময় দেখাতে পারেন না।
ম্যাচিং হলেই বা সাহস করলেই তো চলবে না, এক লিভার আর কিডনি বাদ দিয়ে একজন জীবিত ডোনার আর অন্য কোনো অঙ্গই যে দান করতে পারেন না।
লিভার ডোনেশন তাও সম্ভব, কারণ শরীরে একটি মাত্র লিভার থাকলেও লিভারের একটি দারুণ ক্ষমতা হচ্ছে শরীরের নখ-চুলের মতো এটিও বড় হয়।
ডোনারের লিভারের অংশবিশেষ কেটে নিয়ে রেসিপিয়েন্ট বা অসুস্থ ব্যক্তির লিভার বাদ দিয়ে তার জায়গায় বসিয়ে দিলে, দেওয়া এবং নেওয়া এই দুটো লিভারই মাস খানেকের ভেতর তরতরিয়ে বড় হয়ে স্বাভাবিক লিভারে পরিণত হয়।
যিনি দিলেন আর যিনি নিলেন, তাদের কারোই আর কোনো সমস্যাই থাকে না। কিন্তু হার্ট বা ইন্টেস্টাইনের ক্ষেত্রে তো আর তেমনটি সম্ভব নয়। এজন্যই অতি কার্যকর একটি চিকিৎসা পদ্ধতি হলেও অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের জনপ্রিয়তা এখনো অনেক বেশি সীমিত।
এই জায়গায় ঘাটতি পূরণ করতে পারে ক্যাডাভেরিক অর্গান ডোনেশন (Cadaveric Organ Donation) অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির ব্রেন ডেথ (Brain Death) হয়ে গেলে তার পরিবারের সম্মতিক্রমে তার ট্রান্সপ্ল্যান্টযোগ্য অঙ্গগুলো একাধিক অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করে তাদের নতুন জীবন দান করা। এভাবে একজন ক্যাডাভেরিক ডোনারের কাছ থেকে লিভার, হার্ট, কিডনি, বোনম্যারো, কর্নিয়া, লাংস আর ইন্টেস্টাইন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে কমপক্ষে দশ থেকে বারোজন মুমূর্ষু মানুষ নতুনভাবে বাঁচতে শুরু করতে পারেন। তবে ব্রেন ডেথ ঘোষণা করার জন্য চাই আইনের সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান এবং যোগ্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয় কমিটি।
আমাদের স্বাস্থ্যখাতের জন্যও এই ঘটনা একটি অনন্য অর্জনের মাইলফলক হয়ে থাকল কারণ আমরা বিশ্বকে আরও একবার জানান দিতে পারলাম ‘আমরাও পারি’...
আমাদের দেশে এই জায়গায় আইনের একটা ঘাটতি বহুদিন ধরেই রয়ে গিয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্প্রতি এই আইনকে হালনাগাদ করে দিয়েছেন। আর এই কারণে দেশে প্রথমবারের মতো আমরা ক্যাডাভেরিক অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন হতে দেখলাম, যার মাধ্যমে সারাহই যে শুধু খুঁজে পেল অমরত্বের ঠিকানা তাই নয়, আরও চার-চারজন অসুস্থ মানুষ ফিরে পেলেন নতুন জীবন।
শুধু তাই-ই নয়, আমাদের স্বাস্থ্যখাতের জন্যও এই ঘটনা একটি অনন্য অর্জনের মাইলফলক হয়ে থাকল কারণ আমরা বিশ্বকে আরও একবার জানান দিতে পারলাম ‘আমরাও পারি’।
তবে তারচেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সারাহর এই দানে ভবিষ্যতে আরও অনেক মানুষ নিঃসন্দেহে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসবেন এবং এর মাধ্যমে নতুন জীবন ফিরে পাবেন তার চেয়েও আরও অনেক অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ।
এরই মধ্যে আরও একজন ক্যাডাভেরিক ডোনারের দুটো কর্নিয়া সংযোজন করে নতুন করে পৃথিবীকে দেখতে শুরু করেছেন আরও দুজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ।
সারাহর তাই তার অর্গান দান করে শুধু অমরত্বই অর্জন করেননি, তিনি গেয়ে গেছেন মৃত্যুকে হারানো মৃত্যুঞ্জয়ী গান। আসুন আমরাও আগামীতে সারাহর এই সুরে সুর মিলাই।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) ।। ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ