মশা মারতে কামান!
‘মশা মারতে কামান দাগানোর’ প্রবাদটি সবারই কম বেশি জানা। যার অর্থ 'তুচ্ছ কাজে বেশি শক্তি প্রয়োগ।’ প্রবাদ বাক্যের মতো কামান ব্যবহার করা না হলেও মশার উৎস খুঁজতে ২০২১ সালে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করে উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনও ব্যাঙ, হাঁস ও গাপ্পি মাছ থেকে শুরু করে সবকিছুই ব্যবহার করেছে। প্রয়োগ করা হয়েছে ‘শক্তিশালী’ ওষুধও। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
প্রতি বছরই ঢাকার দুই নগর পিতা নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন মশা নির্মূলের জন্য। মশা নিধনে নতুন আবিষ্কৃত, ড্রোন, ব্যাঙ, হাঁস, গাপ্পি মাছ কিংবা চিরুনি অভিযানেও কোনো সফলতা পাওয়া যায়নি। এসব কাজে ব্যয় হয়েছে শত কোটি টাকা। এজন্য হয়তো নতুন তত্ত্বের দিকে তাকিয়ে আছে সিটি কর্পোরেশন। সব শক্তি প্রয়োগ করেও যেখানে সিটি কর্পোরেশন ব্যর্থ, তখন উত্তরের নগর পিতার সরল স্বীকারোক্তি ‘এসবই ছিল ভুল’!
আরও পড়ুন >>> স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?
অপর দিকে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে ও পরে দক্ষিণের বর্তমান নগর পিতা ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, আগে মশা মারার লোক দেখানো কার্যক্রম হতো। দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি আগের সব কৌশল বাদ দিয়ে দেন। কমিয়ে ফেলেন অনেক মশক নিধন কর্মীও। ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কারখানাও সশরীরে পরিদর্শন করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং বেড়েছে মশা ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব।
২০১৯ সালে যখন রাজধানীতে প্রথম ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকে তখন উত্তর সিটি আতিকুল ইসলাম প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতা শহরের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এছাড়া তৎকালীন দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনও সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অভিজ্ঞতা নেন। এদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেন তারা। সব সংস্থা থেকে নিয়েছেন বিস্তর অভিজ্ঞতা। মশা নিধনে বিশেষ ফ্লাইটে বিদেশ থেকে ওষুধ ও জরুরি যন্ত্রপাতি আনা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং বছর বছর বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। সঙ্গে বেড়েছে মানুষের মৃত্যুও।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, '৯ বছরে দুই সিটি কর্পোরেশন ব্যয় করেছে ৬৩৬ কোটি টাকা। তবে এর সুফল পায়নি নগরবাসী। এ নিয়ে প্রতিবছরই সমালোচনার মুখে পড়তে হয় দুই মেয়রকে।
সম্প্রতি উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, মশা নিধনে এত দিন যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে, তা ছিল ভুল। কিন্তু ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক এর পেছনে ব্যয় হয়েছে নাগরিকের ট্যাক্সের বিপুল অঙ্কের টাকা। সঙ্গে ঝরেছে কয়েক শত তাজা প্রাণ।
আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ কেন?
২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। ওই বছর ডেঙ্গুতে মারা যান ৯৩ জন। এরপর ডেঙ্গুর সবচেয়ে বড় প্রকোপ দেখা দেয় ২০১৯ সালে। ওই বছর মারা যান ১৭৯ জন।
করোনা মহামারি শুরুর বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে মারা যান ৭ জন। ২০২১ সালে মারা যান ১০৫ জন। পরের বছর ২০২২ সালে মারা যায় প্রায় ২৮১ জন। চার বছরে শুধু সরকারি হিসাবে মারা গেছে অন্তত ৫৭২ জন।
এবার এসবই বাদ দিয়ে উত্তরের মেয়র অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য গিয়েছে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে। দেশের মিয়মি সিটি কর্পোরেশন কীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করছে সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করে তিনি সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন—‘আমরা এতদিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। তাতে মশা তো ধ্বংস হয়নি; বরং অর্থের অপচয় হয়েছে। মিয়ামিতে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা ঢাকায় মশা নির্মূলে কাজে লাগাতে চাই। দ্রুত সময়ের মধ্যে মশার প্রজাতি চিহ্নিত করতে একটি ল্যাব স্থাপন করবে ডিএনসিসি।’
আরও পড়ুন >>> মশার আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ
আজকাল জনপ্রতিনিদের ভুল স্বীকার না করার প্রবণতার মধ্যে মেয়র আতিকুল ইসলাম দারুণ সততা দেখিয়েছেন। তার এই সহজ স্বীকারোক্তির জন্য হয় তো তিনি মানুষের সরল মনোযোগ বা সহানুভূতি পাবেন ঠিকই, কিন্তু এরমধ্যে রাষ্ট্রের অপচয় কিংবা সাধারণ নাগরিকের যে প্রাণহানি হয়েছে তার ক্ষতি কি কোনোভাবেই তিনি পুষিয়ে দিতে পারবেন? সেই দায়িত্ব কি এড়াতে পারেন তিনি?
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আয়োজনে দেশের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের কমার্শিয়াল ল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (সিএলডিপি) আমন্ত্রণও অর্থায়নে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধিদল ফ্লোরিডা সফর করে।
প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। সফরকালে মশক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশের অভিজ্ঞতা হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন মিয়ামি ডেড কাউন্টির বিশেষজ্ঞরা। আর মশা নিয়ন্ত্রণে যুক্ত রাষ্ট্রের এই সফল কার্যক্রম ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র।
কর্মশালায় তুলে ধরা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের মিয়ামি শহরে প্রায় ৫২ প্রজাতির মশার অস্তিত্ব রয়েছে। ফলে বছরের ৩৬৫ দিনই মশাবাহিত রোগ, যেমন―ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায় শহরে।
আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গু : এত ভয়াবহ আকার ধারণ করল কেন?
রাজধানী ঢাকার আবহাওয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা স্টেটের মিয়ামি ডেড কাউন্টির বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। সেখানকার তাপমাত্রা গড়ে ১৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রিতে ওঠানামা করে। মাঝে মাঝে ভারী বৃষ্টিপাতও হয়ে থাকে। ফলে এডিসবাহিত ডেঙ্গুসহ সব ধরনের মশাবাহিত রোগের উর্বর ক্ষেত্র হতে পারত মিয়ামি। কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে মশাবাহিত রোগ পুরোটাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে মিয়ামি ডেড কাউন্টি কর্তৃপক্ষ।
মিয়ামিতে মশা ধ্বংস করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে মশার প্রজাতি নির্ণয়। কেননা মশার ধরন বুঝে ওষুধ স্প্রে করতে পারলেই কেবল মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব। অন্যথায় প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা ফগার স্প্রে করে কোনোভাবেই মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে মিয়ামি ডেডকাউন্টি কর্তৃপক্ষ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের মিয়ামি শহরের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ডিএনসিসিতে কাজে লাগাতে চান তিনি। বলেন, ‘আমরা এত দিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। তাতে মশা তো ধ্বংস হয়নি বরং অর্থের অপচয় হয়েছে। তাই অতিদ্রুত ডিএনসিসি মশার প্রজাতি চিহ্নিত করতে একটি ল্যাব স্থাপন করতে চাই। মিয়ামি থেকে যে জ্ঞান অর্জিত হয়েছে সেটির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ডিএনসিসিকে মশকমুক্ত রাখতে চাই।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে তাদের সিডিসির সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আমাদের দেশের কীটতত্ত্ববিদদের নিয়ে একটি সভার আয়োজন করব। তারা আসলে কীভাবে সফল সেটি কীভাবে ঢাকাতে প্রয়োগ করা যায় তার কর্মপদ্ধতি ঠিক করা হবে।’
আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, সাবধানতা ও সচেতনতা
ডিএনসিসি মেয়র আরও বলেছেন, ‘প্রয়োজনে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলাপ করে তাদের ল্যাবেই মশার জীবন প্রকৃতি নির্ণয়ে কাজ করা যেতে পারে। আর ফগিংয়ে অর্থ অপচয় না করে লার্ভিসাইডিং মনোযোগী হতে হবে।
আমরা দেখেছি মিয়ামি আর ঢাকার আবহাওয়া এবং মশার ধরন একই। তাই তারা সফল হলে অবশ্যই আমরা সফল হবো। এখন আর পিছিয়ে থাকার সময় নেই। উন্নত দেশ তাদের পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে ঢাকাকেও মশামুক্ত করা সম্ভব।’
মশা চিহ্নিত করার জন্য ল্যাব স্থাপনের সিদ্ধান্ত কিন্তু এই প্রথম নয়। আমার সেবা খাতের রিপোর্টিংয়ের অভিজ্ঞতা বলছে, মিয়ামি থেকে উত্তরের মেয়র যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন সেই অভিজ্ঞতা আগেও পেয়ে ছিলেন তিনি। এই অভিজ্ঞতা ২০১৯ সালে কলকাতা পৌর সংস্থা থেকে তিনি প্রথম অর্জন করেন।
এছাড়া তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন সিঙ্গাপুরে গিয়ে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সি থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন সেই আলোকে ‘কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট’ নামে একটি আলাদা দপ্তর তৈরি করার জন্য একটি কৈশলপত্র প্রণয়ন করে ছিলেন।
আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট : এইবারও কি ব্যর্থ হব?
বিষয়টি নিয়ে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সংসদে কথা বলেছিলেন। এজন্য ২০১৯ সালের ৭ জুলাই নিজের অনুমোদনর পর একটি প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও জমা দিয়েছিলেন সাঈদ খোকন। কিন্তু আজও তা আলোর মুখ দেখেনি। হয়তো বছর অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন সেই অভিজ্ঞতা তাদের স্মৃতিভ্রম হয়েছে। মন্ত্রণালয়ও ভুলে গেছে সব।
জনগণের করের টাকা ব্যয় করে বিস্তর অভিজ্ঞতা অর্জন করা হয়। কিন্তু তার বাস্তব রূপ দেওয়া হয়নি। এখন আবারও একই অভিজ্ঞতা অর্জন করা হচ্ছে সময় ও অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু তারও বাস্তব রূপ মিলবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ হতেই পারে। এরমধ্যে জনগণের যা ক্ষতি হওয়ার তা কিন্তু হয়েই গেছে।
যেসব পরিবার তাদের স্বজনদের হারিয়েছেন তারা আর তাদের ফিরে পাবেন না। এখন মেয়রের সহজ স্বীকারোক্তির আলোকে বলাই যেতে পারে, ‘ভুল, সবই ছিল ভুল?’
শাহেদ শফিক ।। সাংবাদিক
[email protected]