বাংলালিপি : উৎস ও বিবর্তন
লিপি প্রাচীনকাল থেকেই এই ভূখণ্ডে প্রচলিত। বেদ-বেদাঙ্গের অসংখ্য স্থানে বর্ণ-লিপির কথা আছে। বর্ণের বিশুদ্ধ উচ্চারণ এবং প্রয়োগের জন্যেই তৈরি হয় প্রত্যেক বেদের সাথে যুক্ত শিক্ষা এবং প্রাতিশাখ্য গ্রন্থগুলো। বৈদিক এই গ্রন্থগুলোয় বর্ণ, স্বর, মাত্রা ইত্যাদির যথাযথ উচ্চারণ ও প্রয়োগবিধি লিপিবদ্ধ করা আছে।
ভারতবর্ষের পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ হিসেবে প্রাচীনতম লিপি হলো সিন্ধুসভ্যতার আবিষ্কৃত লিপিমালা ( আনু : ৫০০০ -৩০০০ খ্রিস্ট পূর্ব)। যদিও এই সিন্ধুলিপি এখনো পুরোপুরি পাঠোদ্ধার করা যায়নি।
অবশ্য ইদানীং অনেকে দাবি করছে তারা সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার করেছেন। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে ভারতবর্ষের অধিকাংশ ভাষার লিপিগুলো ব্রাহ্মীলিপি থেকে উৎপন্ন। যেমন—বাংলা, উড়িয়া, আসাম, ওঝা, কণাড়ী, গুজরাটি, গুরুমুখী, গ্রন্থম, তামিল, তেলেগু, তিব্বতি, নেপালি, মণিপুরি, সিংহলী, সিন্ধি ইত্যাদি প্রায় ৪২টির অধিক ভারতীয় ভাষা। এছাড়া বার্মা, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনের ভাষাসহ আরও অসংখ্য ভাষার লিপি ব্রাহ্মীলিপি থেকে জাত।
আরও পড়ুন >>> সংস্কৃতি খাতে বাজেট এত কম কেন?
অবশ্য ব্রাহ্মীলিপি ছাড়াও ভারতবর্ষে আরেকটি প্রধান লিপি হলো খরোষ্ঠী এবং খরোষ্ঠী ও গ্রিক লিপির মিশ্রণে ব্যকট্রিয় লিপি নামক একটা মিশ্রলিপি।
ব্রাহ্মীলিপি পারস্যের পূর্বাংশ থেকে তিব্বত হয়ে লাওস—ফিলিপাইনের প্রায় সকল লিপির জননী। বাংলালিপিরও জননী। আমাদের হাতে পাওয়া পুরাতাত্ত্বিক তথ্যের ভিত্তিতে ব্রাহ্মীলিপি থেকে বাংলালিপির বিবর্তনের চিত্রটি তুলে ধরছি—
১. কোনো অনির্ণীত সুদূর প্রাচীনকালে ব্রাহ্মীলিপির উৎপত্তি হলেও খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর পূর্বে কোনো ব্রাহ্মীলিপির নিদর্শন আমরা পাই না। এর উদাহরণ প্রথম পরিলক্ষিত হয় অশোকলিপি বা মৌর্যলিপি।
ভারতবর্ষের পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ হিসেবে প্রাচীনতম লিপি হলো সিন্ধুসভ্যতার আবিষ্কৃত লিপিমালা। যদিও এই সিন্ধুলিপি এখনো পুরোপুরি পাঠোদ্ধার করা যায়নি।
২. ব্রাহ্মীলিপির বিবর্তনে দ্বিতীয় স্তর হলো কুষাণলিপি। ১০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কণিষ্ক, হুবিস্ক, বাসুদেব প্রভৃতি কুষাণ রাজাদের বিভিন্ন অনুশাসনে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
৩. এরপরে এই লিপিই উত্তরী ও দক্ষিণী নামে দুই প্রকারে ভাগ হয়ে যায়। এর উত্তরীলিপিই পরবর্তীতে চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে এসে গুপ্তযুগে গুপ্তলিপিতে পরিণত হয়ে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পায়।
৪. ব্রাহ্মীলিপির বিবর্তনের ইতিহাসে গুপ্তলিপির পরে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পায় কুটিললিপি। এই লিপি কোনো রাজ বংশের প্রভাব ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে সাধারণজনের লিপিতে পরিণত হয়।
৫. বাংলালিপির বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপটি লক্ষ্য করা যায় একাদশ দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দে। সেন যুগের শেষ দিকে এসে লিপি পরিবর্তনের এই রূপরেখা আমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
আরও পড়ুন >>> মিলিত প্রাণের কলরবে ‘সংক্রান্তি ও বৈশাখ’
বারো শতকের পরে বাংলায় আর কোনো সেই রকম উল্লেখযোগ্য তাম্রলিপি পাওয়া যায়নি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। এসব পাণ্ডুলিপি থেকে বাংলা লিপির পূর্ণাঙ্গ রূপ ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই পূর্ণাঙ্গ রূপটিই ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর পাণ্ডুলিপিতে এবং অভিলেখতে স্থায়ী রূপ পেয়ে বিদ্যাসাগরের এবং পঞ্চানন কর্মকারের হাত গলিয়ে আজ বর্তমানের বাংলালিপি।
প্রায় ছয়শ থেকে হাজার বছর পূর্বে ব্রাহ্মীলিপি কুটিল লিপি হয়ে বাংলালিপির সুস্পষ্ট রূপটি দেখা যায় প্রাপ্ত বিভিন্ন লিপিতে। এই লিপিগুলোর মধ্যে পাণ্ডুলিপি, রাজাদের অভিলেখ এবং মূর্তিলিপিও আছে। এর কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলো—
১. বিশ্বরূপ সেনের সাহিত্য পরিষদ লিপিতে বাংলালিপির দৃশ্যমান উপস্থিতি দেখা যায়।
২. এরই ধারাবাহিকতায় বল্লালসেনের পুত্র লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া তাম্রশাসনে বাংলালিপির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়।
৩. ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দে ডোম্মনপালের সুন্দরবন তাম্রানুশাসন লিপিটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ বাংলা অক্ষরেই উৎকীর্ণ।
আরও পড়ুন >>> সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ
৪. ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ত্রয়োদশ শতাব্দীর পাণ্ডুলিপি ‘বজ্রায়নেসাধনাঙ্গানি’তে বাংলালিপির দৃশ্যমান উপস্থিতি দেখা যায়।
৫. চতুর্দশ শতকে রচিত বড়ু চন্ডীদাসের কাব্য যা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে বিখ্যাত, এই কাব্যে বাংলালিপির চূড়ান্ত রূপটি সহজেই ধরা পড়ে।
৬. পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত বৌদ্ধ সহজিয়াদের লেখা বোধিচর্যাবতারের পাণ্ডুলিপিতে বাংলা লিপির আরও পরিণত রূপ দেখা যায়।
৭. বর্ধমান জেলার বেগুনিয়ায় গণেশ মন্দিরের দরজায় উৎকীর্ণ পনেরো শতকের লিপিতে বাংলালিপির পূর্ণাঙ্গরূপ পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাভাষার অক্ষয় রত্নাকর থেকে জন্ম নেয় বাঙালির স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদ। একটা স্বাধীন ভূখণ্ড, স্বাধীন রাষ্ট্র, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
এছাড়া রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহে রক্ষিত ‘পঞ্চরক্ষা’ ও ‘গূহ্যাবলীবিবৃতি’ প্রভৃতি পাণ্ডুলিপিতে বাংলালিপির সুস্পষ্ট এবং পরিণত উপস্থিতি লক্ষ করা যায় এবং এভাবেই বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেড়িয়ে ব্রাহ্মীলিপি থেকে কুটিল লিপির ধারাবাহিকতায় আজ বাংলা লিপির উদ্ভব।
আরও পড়ুন >>> সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা : চেতনা জাগুক মনে
বাংলাভাষার অক্ষয় রত্নাকর থেকে জন্ম নেয় বাঙালির স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদ। একটা স্বাধীন ভূখণ্ড, স্বাধীন রাষ্ট্র, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সেই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে বাংলা ভাষা এবং লিপি পায় চিরস্থায়ী স্বরূপ; রাষ্ট্রীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। এই ভাষা আমাদের ভালোবাসার ধন, গর্বের ধন। সাধক কবি অতুলপ্রসাদ সেনের ভাষায়—
‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!
কি যাদু বাংলা গানে!- গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
(এমন কোথা আর আছে গো!)
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।।
ঐ ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা,
(মরি হায়, হায় রে!)’
এই সাতসমুদ্র সেঁচাধন বাংলালিপির জন্য, অক্ষরের জন্য, ভাষার রক্ষার জন্য যুগে যুগে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, কত জানা-অজানা বাংলা মায়ের কৃতি সন্তানেরা।
আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন
বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্যে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফাগুনের রক্তাক্ত পলাশের দিনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অসংখ্য ভাষা শহীদ ভাষার জন্যে হাসিমুখে প্রাণ আত্মাহুতি প্রদান করেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদের রক্ত এবং আত্মাহুতি বৃথা যায়নি। এরই ধারাবাহিকতায়, মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে তীব্রতর জনমত গড়ে উঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রস্ফুটিত হতে থাকে। পরবর্তীতে পাকিস্তানি গণপরিষদে মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে প্রথম জোরালো দাবি উত্থাপন করেন বাংলা মায়ের কৃতি সন্তান কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়