ChatGPT : চ্যাটজিপিটি : যা জানা দরকার
চ্যাটজিপিটির জন্ম
বিশ্বখ্যাত ফরচুন ম্যাগাজিনের ফেব্রুয়ারি-মার্চ সংখ্যার প্রচ্ছদ গল্প হতে যাচ্ছেন ওপেনএআই (OpenAI)-এর সিইও এবং সম্প্রতি টেক জগতে আলোড়ন জাগানো ব্যক্তি স্যাম অল্টম্যান (Sam Altman)। ওপেনএআই একটি আমেরিকান সংস্থা যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবতার কল্যাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence) গবেষণা ও বিকাশ।
সান ফ্রান্সিস্কোতে ২০১৫ সালে এলন মাস্ক (Elon Musk), স্যাম অল্টম্যান (Sam Altman) এবং পিটার থেইল (Peter Thiel)-এর মতো আরও অনেক এক্সপার্ট টেক উদ্যোক্তাদের মালিকানায় অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম।
২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর কোম্পানি চ্যাটজিপিটি (ChatGPT) নামক একটি Natural Language Processing সফটওয়্যার Tool চালু করে। যেটি মূলত একটি Chatbot (কৃত্রিম আলাপচারিতা), যা চালু হওয়ার পর থেকেই ঝড় তৈরি হয়েছে টেক দুনিয়ায়।
আরও পড়ুন >>> বিজয় নাকি অভ্র?
চ্যাটবট সফটওয়্যারগুলোর ধারণা খুব নতুন নয়। এই ধরনের সফটওয়্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে। যেখানে আগে থেকেই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ডাটাবেজে জমা থাকে এবং ব্যবহারকারীর প্রয়োজন মতো উত্তর বাছাই করে প্রতিক্রিয়া প্রদান করা হয়।
চ্যাটবট আর চ্যাটজিপিটির পার্থক্য
অহরহ আমরা বিভিন্ন ফেসবুকঅ্যাপসগুলোয় এই ধরনের চ্যাটবট দেখতে পাই। প্রশ্ন জাগতে পারে, একটি সাধারণ চ্যাটবটের সাথে এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী চ্যাটজিপিটির পার্থক্য কোথায়?
চ্যাটজিপিটি হলো সুপারভাইজড মেশিন লার্নিং এবং রিইনফোর্সমেন্ট মেশিন লার্নিং-এর এক চমৎকার বাস্তবায়ন। এর ডাটাবেজে প্রথমে অনেক বিষয়ের তথ্য সংযোজন করা হয়েছে।
সংক্ষেপে এর উত্তর দেওয়া যায় এভাবে—শক্তিশালী মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম এবং বিশাল ডাটাবেজ। সহজভাবে মেশিন লার্নিং বলতে কম্পিউটারকে কোনো কিছু শেখানো বোঝায়। এই শেখানো পদ্ধতি যত ভালোভাবে হবে, মেশিনও তত চমৎকার উত্তর দেবে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি শিশুকে যদি একটি কালো রঙের কলম কিংবা একটি পাকা আম প্রথমবার এবং একবারই দেখানো হয়, সে হয়তো পরে সেই কালো কলম কিংবা পাকা আমটি ভুলে যেতে পারে। কিন্তু, যদি অনেক রকমের কালো কলম এবং অনেক রকমের পাকা আম বারবার শিশুকে দেখানো হয় এবং সেগুলোর নাম শেখানো হয়, তাহলে খুব সহজেই কয়েকদিন পরে সে কলম এবং আম চিনতে পারবে। মেশিন লার্নিং-এর ক্ষেত্রে এই ধরনের শেখানোর ব্যবস্থাকে আমরা বলি সুপারভাইজড (Supervised) মেশিন লার্নিং।
আরও পড়ুন >>> ডিজিটাল ডিভাইস ও আগামীর শিশু
এক পর্যায়ে শিশুর মস্তিষ্কের নিউরনে জিনিসগুলোর স্মৃতি খুব পাকাপোক্তভাবে স্থান নেওয়ার পরে তাকে যদি কালো কলমের পরিবর্তে লাল কলম কিংবা পাকা আমের পরিবর্তে কাঁচা আম দেখানো হয়, তাহলেও হয়তো সে সঠিকভাবেই বলে দিতে পারবে সেটি আম না কি কলম।
এই লাল কলম কিংবা কাঁচা আম শিশুটি কিন্তু নিজে নিজেই শিখলো, তাকে আলাদাভাবে শেখানোর দরকার হয়নি। এই বিষয়কে যে অ্যালগরিদম দিয়ে মেশিনকে শেখানো হয় আমরা তাকে বলি সেলফ লার্নিং (Self Learning) অ্যালগরিদম।
এবার ধরে নেই, শিশুটি কোনো কারণে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে একটি লাল কলমকে লাল পেন্সিল বলে ফেললো। এক্ষেত্রে তাকে যদি আমরা সংশোধন করে আবার শেখাই এবং পেন্সিল ও কলমের পার্থক্যটা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলি, তাহলে পরবর্তীতে শিশুটি হয়তো আর ভুল করবে না।
মেশিন লার্নিং-এর ক্ষেত্রে এই ধরনের শেখানোর ব্যবস্থার অ্যালগরিদমকে আমরা বলি রিইনফোর্সমেন্ট (Reinforcement) লার্নিং অ্যালগরিদম। শক্তিশালী মেশিন লার্নিং-এর ক্ষেত্রে এমনই কিছু অ্যালগরিদম সমূহের বাস্তবায়ন করা হয়, যাতে করে কম্পিউটার নিজে নিজেই শিখতে পারে, ভুলগুলো থেকে নিজেকে সংশোধন করতে পারে এবং প্রয়োজনমতো বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
আরও পড়ুন >>> মুঠোফোনে আসক্তি বাড়ার কারণ কী?
শিশু আরেকটু বড় এবং সবকিছুতে অভ্যস্ত হওয়ার পরে আমরা যদি তাকে একটি আম কিংবা কলমের বর্ণনা করতে বলি, সে খুব সাবলীলভাবেই আম অথবা কলম সম্পর্কে বেশকিছু লাইন বলতে পারবে। এটা সম্ভব, কেননা মানুষের মস্তিষ্কের লক্ষ লক্ষ নিউরন সেলফ লার্নিং এবং রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং-এর মতো এক ব্যবস্থার মাধ্যমে শিখতে পারে অনবরত। মেশিন লার্নিং-এর অ্যালগরিদমগুলো মূলত মানুষের মস্তিষ্কের নিউরনের কার্যপদ্ধতিরই অনুকরণ।
চ্যাটজিপিটি কী?
চ্যাটজিপিটি হলো সুপারভাইজড মেশিন লার্নিং এবং রিইনফোর্সমেন্ট মেশিন লার্নিং-এর এক চমৎকার বাস্তবায়ন। এর ডাটাবেজে প্রথমে অনেক বিষয়ের তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। তারপর অনবরত সেলফ লার্নিং এবং রিইনফোর্সমেন্ট মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের সাহায্যে শেখানো হয়েছে এবং হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বর্তমানে তার ডাটাবেজের আয়তন এবং ব্যবহৃত অ্যালগরিদমগুলো এতই শক্তিশালী যে এখন তাকে একটি বিষয় সম্পর্কে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে সে প্রায় শতভাগই মানুষের মতো করে উত্তর কিংবা তথ্য প্রদান করতে সক্ষম।
আরও পড়ুন >>> পাবজি : অনলাইন গেইমের রীতিনীতি ও অর্থনীতি
শুধু তাই নয়, তার ডাটাবেজে রয়েছে লক্ষ লক্ষ সংগীতের নোটেশন, কবিতা, রূপকথা, গল্প এবং নানাবিধ রচনা। যার কারণে সে এখন নিজে থেকেই যেকোনো কনন্টেন্ট তৈরি করতে পারে সেই সব বিষয়ের। আপনি কোনো বিষয় সম্পর্কে একটি রিপোর্ট লিখতে চান, চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করুন।
টেক বিশেষজ্ঞরা তাই আশঙ্কা করছেন আগামী দুই বছরের মধ্যেই হয়তো সার্চ ইঞ্জিনগুলো মানুষ আর ব্যবহার করবে না। প্রশ্ন আসতে পারে যে,চ্যাটজিপিটি যা তৈরি করে তা শতভাগ ঠিক কিংবা বিশ্বাস করা যায় কি না?
চ্যাটজিপিটি ইন্টারনেট এবং তার নিজস্ব ডাটা সেটের লক্ষ লক্ষ রিপোর্ট অ্যানালাইসিস করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজেই তৈরি করে হাজির করবে কাঙ্ক্ষিত রিপোর্ট। আপনি কোনো বিষয়ে একটি কবিতা চান, চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করুন। কবিতা রচনার প্রায় সব কাঠামো মেনে চলেই সে আপনার সামনে হাজির করবে তার রচিত কবিতা।
এমনকি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে যেকোনো ছোটোখাটো প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যারের কোডও লিখে দিতে পারে এটি। এ যেন সত্যিকারের এক বিস্ময়!
গুগল বনাম চ্যাটজিপিটি
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মানুষের আর খেটেখুটে কোনো আর্টিকেল তৈরি করার দিন শেষ। গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনগুলো যেখানে কেবলমাত্র ইন্টারনেটের বিভিন্ন স্থানের তথ্যগুলো খুঁজে আমাদের সামনে এনে দেয়, চ্যাটজিপিটি সেখানে আমাদের সামনে পুরোদমে কাঙ্ক্ষিত একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট হাজির করে।
আরও পড়ুন >>> টিকটক, লাইকি, পাবজিরই কি সব দোষ?
টেক বিশেষজ্ঞরা তাই আশঙ্কা করছেন আগামী দুই বছরের মধ্যেই হয়তো সার্চ ইঞ্জিনগুলো মানুষ আর ব্যবহার করবে না। প্রশ্ন আসতে পারে যে, চ্যাটজিপিটি যা তৈরি করে তা শতভাগ ঠিক কিংবা বিশ্বাস করা যায় কি না?
উত্তরে বলা যায়, যেহেতু সফটওয়্যারটি ডাটাবেজ এবং তাকে কীভাবে শেখানো হচ্ছে সে সব অ্যালগরিদমের উপর নির্ভরশীল, সেহেতু সবসময় সঠিক তথ্য আশা করাটা ঠিক নয়।
চ্যাটজিপিটির ভবিষ্যৎ
ওপেনএআই নিজেরাই স্বীকার করেছে যে চ্যাটজিপিটি অনেকসময় অসত্য ও অসংবেদনশীল তথ্য দেয়। পৃথিবীর অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং গবেষক ইতিমধ্যেই এর ব্যবহার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
শিক্ষক হিসেবে আমি নিজেও একটু শঙ্কিত। কারণ এর মাধ্যমে হয়তো খুব সহজে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরিতে অসদুপায় অবলম্বন করা যাবে। এর সমাধান হিসেবে, আমাদের একটু ভিন্ন পদ্ধতি চিন্তা করতে হবে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি এবং মূল্যায়নের ক্ষেত্রে। এটি ছাড়া আমি আর তেমন কোনো অসুবিধা দেখি না।
আরও পড়ুন >>> সাইবার অপরাধ : নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ ও আইন
পানি যেমন আমাদের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়, আবার সেই পানিই হতে পারে ক্ষতির কারণ; নির্ভর করছে আমি কীভাবে পানি ব্যবহার করছি। সব মিলিয়ে বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্পূর্ণ এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে পৃথিবী। এটি মানব সভ্যতার জন্য কতটুকু সুফল বয়ে আনবে সেটি সময়ই বলে দিবে।
ড. ইমন কুমার দে ।। সহযোগী অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়