বিজয় নাকি অভ্র?
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের দুই শিক্ষার্থী। জুনিয়র-সিনিয়র। তাদের মধ্যে কথা হচ্ছে—
বড় ভাই : কত করে নিবি?
ছোট ভাই : মানে? কীসের কত করে নেবো?
বড় ভাই : আরে, তোর সফটওয়্যারের দাম কত করে রাখবি?
ছোট ভাই : দাম রাখবো কেন? ওটা তো ফ্রি। কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না।
জুনিয়রের কথা শুনে সিনিয়র এবার যারপরনাই অবাক।
আরও পড়ুন >>> ডিজিটাল ডিভাইস ও আগামীর শিশু
বড় ভাই : বলিস কী? বলা ছাড়া আর কোনো কিছুই বের হয়নি তার গলা দিয়ে। ওদিকে জুনিয়রের বরাবরের মতোই স্বাভাবিক উত্তর, ‘হ্যাঁ। ভাষার জন্য টাকা নেবো কেন?’
সিনিয়রের মুখ থেকে এবার আর কোনো কথা বের হয় না। আক্কেলগুড়ুম হয়ে যান। তিনি মনে মনে ভাবতে থাকেন, কী বলছে এই ছেলে? আর এদিকে আমি মনে মনে আঁকতে থাকি কয়েকজন মানুষের মুখ। মানুষগুলোর সাথে এই জুনিয়র ছেলের বেশ মিল খুঁজে পাই।
সালাম, রফিক, শফিক, বরকতসহ অনেকের মতো মিল খুঁজে পাই। ভাষাকে তারা ঠিক এই ছেলের মতো করেই ভালোবেসেছিলেন। ভাষার জন্য তাদের ঠিক এতটাই মমত্ববোধ ছিল বুকের বাঁ পাশে।
মনে মনে ভাবি, বহুদিন পর বাংলা আরেকজন ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পেল। স্বার্থের এই জগতে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর।
কম্পিউটারে বাংলা ভাষা লেখার জন্য প্রথম মাধ্যম ছিল ‘বিজয়’। সেটা মানুষ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। বিজয়-এর আবিষ্কারককে শ্রদ্ধা সম্মান ভালোবাসা সবই উজাড় করে দিয়েছেন দেশের মানুষ।
কম্পিউটারে বাংলা ভাষার ব্যবহার জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে মোস্তাফা জব্বারের ভূমিকা ঐতিহাসিক। কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহার, হরফের উৎকর্ষ শৈলী, প্রকাশনা শিল্পের যুগোপযোগী আধুনিকীকরণ, কম্পিউটার উপকরণের যুতসই ব্যবহারের প্রণোদনা দানে মোস্তাফা জব্বারের সুদীর্ঘ কর্মজীবনের অবদানের সঙ্গে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের ও ব্যবহারে জনসম্পৃক্তির মৌলিক আলোচনার এক গভীর যোগসূত্র আছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সরকারি ও বেসরকারি দাপ্তরিক কাজে ইংরেজি ব্যবহারের তীব্র সমালোচক জব্বার। ইংরেজি হরফে বাংলা লেখারও সমালোচনা করেন তিনি।
আরও পড়ুন >>> মুঠোফোনে আসক্তি বাড়ার কারণ কী?
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা তথা গবেষণাপত্র প্রকাশের গুরুত্বারোপ করেন তিনি। জব্বারের মতে, উচ্চ আদালতে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ব্যবহার প্রতিষ্ঠিত না হলে বাংলার বিজয় সম্পন্ন হবে না এবং একুশের চেতনা রক্ষা করা যাবে না।
তথ্য পাওয়ার অবারিত সুযোগ থাকার এই যুগে শুরুতেই স্বীকার করে নিই—উপরের তথ্যগুলো সবার জানা। জানা বিষয় আবারও সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করলাম শুধু।
গুগলে সার্চ দিলে এই বিষয়ে আরও অনেক লেখা পাওয়া যায়। তো, আমার লেখার মূল বিষয় এটি নয়। এটি মূল বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটা তথ্য কিংবা সংযুক্তি বলা যেতে পারে।
সব অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে বাংলা ‘বিজয় কি–বোর্ড’ ব্যবহার করতে হবে। ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, এমন নির্দেশনা দেয় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটিআরসি। গণমাধ্যমের সুবাদে তা দ্রুতই পৌঁছে যায় মানুষের কাছে। তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকেন বেশিরভাগ মানুষ।\
আরও পড়ুন >>> পাবজি : অনলাইন গেইমের রীতিনীতি ও অর্থনীতি
বর্তমান সময়ে কম্পিউটারে বাংলা লেখার সময়ও বেশিরভাগ মানুষ ‘অভ্র’ ব্যবহার করছেন—ব্যবহারের সহজবোধ্যতা বা সহজলব্ধতার কারণে। সেখানে সেলফোনে বিজয় কি–বোর্ড ব্যবহার করার নির্দেশনা দেওয়া কতটা যৌক্তিক তা নিয়েই মূলত আলোচনা সমালোচনা।
কম্পিউটারে বাংলা ভাষা লেখার জন্য প্রথম মাধ্যম ছিল ‘বিজয়’। সেটা মানুষ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। বিজয়-এর আবিষ্কারককে শ্রদ্ধা সম্মান ভালোবাসা সবই উজাড় করে দিয়েছেন দেশের মানুষ। কিন্তু পরে যখন এরচেয়েও বেশি ব্যবহার বান্ধব মাধ্যম ‘অভ্র’ এলো, এটি তখন প্রিয় হয়েছে মানুষের মাঝে।
প্রযুক্তির ব্যাপারটাই এমন। যত বেশি সহজ-ব্যবহারযোগ্য হবে তত বেশি জনপ্রিয় হবে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু সেখানে যদি কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়, নির্দেশনামূলক কিছু বলা হয়, তা ভোক্তা বা ব্যবহারকারীরা মনে করেন নির্বতনমূলক—গোল বাঁধে তখনই।
যেমন বেঁধেছে এবার। অবশ্যই শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, অফিস আদালত, তথ্য প্রযুক্তি—সব জায়গায় বাংলার প্রসার ঘটানো জরুরি। যেটাকে আমরা বলি—সবক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন করা। কিন্তু এটা করতে গিয়ে—সবক্ষেত্রে বিজয় কি-বোর্ডের প্রচলন করতে হবে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া আরও জরুরি?
মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার মানুষ। সেটা তিনি মন্ত্রী থাকলেও, না থাকলেও। তিনি মন্ত্রীর পদে থাকা অবস্থায় তার মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা এমন আদেশ দেয় কীভাবে? প্রশ্ন হলো, তিনি কি মন্ত্রীর পদ ব্যবহার করে নিজের সফটওয়্যারকে মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন?
আরও পড়ুন >>> টিকটক, লাইকি, পাবজিরই কি সব দোষ?
গণমাধ্যম বলছে, মোস্তাফা জাব্বার বলেননি—অ্যান্ড্রয়েড ফোনে বিজয় কি–বোর্ড ব্যবহারের নির্দেশ দিতে। বিটিআরসি নিজেরাই এটা দিয়েছে। এমনটা হলেও কিছু কথা থাকে। মানলাম বিটিআরসি’র কর্তারা নিজ উদ্যোগে এই কাজ করেছেন। কিন্তু এটা জানার পর মন্ত্রী কেন নিষেধ করলেন না?
গণমাধ্যম বলছে, আমদানি করা ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সব অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে বিজয় অ্যান্ড্রয়েড প্যাকেজ ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা দিয়ে বিটিআরসির নির্দেশনা প্রত্যাহারে আইনি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির পক্ষে এই নোটিশ পাঠিয়েছেন তার আইনজীবী।
মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার মানুষ। সেটা তিনি মন্ত্রী থাকলেও, না থাকলেও। তিনি মন্ত্রীর পদে থাকা অবস্থায় তার মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা এমন আদেশ দেয় কীভাবে?
সাতদিনের মধ্যে বিটিআরসি তার নির্দেশনা প্রত্যাহার না করলে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থার নেওয়ার কথা বলা হয়েছে (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২৩)। এখন দেখা যাক কী হয়! কোথাকার জল কোথায় গড়ায়! সাতদিন হতে যে কদিন বাকি, ততদিন অপেক্ষায় থাকি। শেষ করি একটা গল্প দিয়ে।
উচ্চ মাধ্যমিকে আমার ঐচ্ছিক বিষয় ছিল কম্পিউটার শিক্ষা। ক্লাসে নিতেন ফরহাদ মনজুর স্যার। ক্লাসে তিনি কম্পিউটারের বিবর্তনের ইতিহাস বলতেন। একদিন একটি ছবি দেখালেন ক্লাসে—পুরো ঘর জুড়ে ছড়িয়ে আছে একটি বিশাল যন্ত্র! স্যার জানালেন—এটি হলো কম্পিউটারের আদিপুরুষ। নাম—অ্যাবাকাস (Abacus)।
আরও পড়ুন >>> সাইবার অপরাধ : নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ ও আইন
মূলত গণনা যন্ত্র হিসেবে এটি আবিষ্কার হয় খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ সালে। আর প্রথম কম্পিউটার নাম—ম্যাকিন্টশ (Macintosh)। সেটিও বিশাল এক যন্ত্র। আর এখন কম্পিউটার ছোট হতে হতে মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।
হাতের মুঠোয় আসা প্রযুক্তির দিনে এখন কেন বিজয় নাকি অভ্র এই দ্বন্দ্ব চলবে? তা কতটা যৌক্তিক?
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি