ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার দিন
৮ জানুয়ারি ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু খুনি-হানাদার পাকিস্তানীদের কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১০ জানুয়ারি সকালেই তিনি দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সারিবদ্ধ লাখো মানুষ।
বাংলাদেশ বেতার থেকে সরাসরি ধারাবিবরণী দেওয়া হচ্ছিল। বিমানবন্দর ও রাস্তার দু’পাশে ছিল অপেক্ষমাণ জনতা। অন্যরকম উত্তেজনা সবার চোখেমুখে। বাঙালির মহান নেতা আসছেন। লাখো মানুষের ভিড় রাজপথ জুড়ে। কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ। বঙ্গবন্ধু এলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দেশের মাটিতে পা দিয়েই আবেগে কেঁদে ফেলেন। বিমানবন্দরে অস্থায়ী সরকারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা সবাই অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের এই বরপুত্রকে।
আরও পড়ুন
তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান অবতরণ করার পর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। সেদিনকার রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৯ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যা ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে যারা দালালি ও সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ, মুক্তিবাহিনী, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, এসব বিষয়সহ বিভিন্ন দিক নিয়ে নির্দেশনা।
বাঙালি জাতির প্রতি অবিচল আস্থা ছিল তার। স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে সেদিন বলেছিলেন, ‘এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা, এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ।’
তিনি ডাক দিলেন দেশ গড়ার সংগ্রামে। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত মন্ত্রমুগ্ধ জনতা দু’হাত তুলে সেই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
যাদের প্রাণের ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সিপাই, পুলিশ, জনগণ, হিন্দু, মুসলমানকে-যাদের হত্যা করা হয়েছে। তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমি আপনাদের কাছে দুই একটা কথা বলতে চাই।’
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মা-বোনেরা ইজ্জত ও কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণতা হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’
আরও পড়ুন
দেশের উন্নয়নের জন্য ডাক দিলেন এভাবে—‘যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন, আমি সমস্ত জনগণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙে গেছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দেও। আমি চাই জমিতে যাও, ধান বোনাও, কর্মচারীদের বলে দেবার চাই, একজন ঘুষ খাবেন না, আমি ক্ষমা করব না।’
রেসকোর্সের জনসভায় মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ভাষণে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তুমি দেখে যাও, তোমার আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ ৭ কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। হে বিশ্বকবি তুমি আজ জীবিত থাকলে বাঙালির বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে নতুন কবিতা সৃষ্টি করতে।”
ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, ‘আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালি একবার মরে দুইবার মরে না।’ আমি বলেছিলাম, ‘আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাব। আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করে যাব না। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা। বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।’
...ভাষণটি ছিল সংক্ষিপ্ত। এই সংক্ষিপ্ত ভাষণেই বাঙালি জাতি ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেন বঙ্গবন্ধু।
বাঙালি জাতির প্রতি অবিচল আস্থা ছিল তার। স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে সেদিন বলেছিলেন, ‘এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা, এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র, এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ।’
তিনি জনগণকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেন, "আমি দেখায় দিবার চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।"
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে অকুণ্ঠ চিত্তে স্মরণ করে ভারত, ভারতের জনগণ এবং ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান। এবং সাথে সাথে কৃতজ্ঞতা জানান ব্রিটেন, জার্মান, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে। আবার বঙ্গবন্ধু মার্কিন জনগণকে ধন্যবাদ জানান, সরকারকে নয়।
যুদ্ধাপরাধীদের গণবিরোধী ভূমিকা পালন করার ফলে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর প্রতিহিংসাপরায়ণ বশে অনেক সহিংস ঘটনা ঘটে। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু সর্তকবাণী উচ্চারণ করেন, "আজ আমার কারও বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নাই, একটা মানুষকে তোমরা কিছু বলো না, অন্যায় যে করেছে তাকে সাজা দেবো। আইনশৃঙ্খলা তোমাদের হাতে নিও না।"
আরও পড়ুন
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেদিন সবাইকে দেশ গড়ার আহ্বান জানান। সেদিনের ভাষণটি হচ্ছে নতুন দেশ পুনর্গঠন করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা। পূর্বপ্রস্তুতিহীন এই সংক্ষিপ্ত ভাষণে বিভিন্ন বিষয়ের বঙ্গবন্ধু দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যা রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে তাৎপর্য বহন করে।
পাশাপাশি বহন করে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র নায়কোচিত দূরদৃষ্টির। ভাষণটি ছিল সংক্ষিপ্ত। এই সংক্ষিপ্ত ভাষণেই বাঙালি জাতি ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেন বঙ্গবন্ধু।
সেই ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাখ লাখ অনুরাগীর ভালবাসায় সিক্ত হন। বাংলাদেশের জনগণ এদিনই প্রাণভরে বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ উপভোগ করেন।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলার মানুষ তখনো জানত না ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জীবিত আছেন কি না? তাই বিজয়ের মধ্যেও মানুষের মনে ছিল শঙ্কা ও বিষাদের ছাপ।
এছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শারীরিক উপস্থিতি ছিল অনিবার্য।
তাই ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে ১০ জানুয়ারি ছিল বাঙালির জন্য পরিপূর্ণভাবে স্বাধীনতা অর্জনের দিন।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেকটি আলোকিত অধ্যায়। প্রকৃতপক্ষে ১০ জানুয়ারির দিনই বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রবেশ করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায়।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়