মেধা পাচার কি রোধ করা সম্ভব?
কোনো বিষয়ে সম্যকভাবে বোঝার, শেখার এবং সেই বিষয়ে স্বাধীন ও সৃজনশীলভাবে চিন্তা করার বিশেষ ক্ষমতার নাম হলো মেধা। কোনো ব্যক্তির মধ্যে যখন এরূপ গুণাবলীর সমন্বয় ঘটে তখন তিনি মেধাবী বলে অভিহিত হন।
একজন মেধাবী শুধু নিজের ব্যক্তিগত জীবনেই নয় বরং পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে মেধার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে অভূতপূর্ব অবদান রাখতে সক্ষম হন। মেধাবী ব্যক্তি তার মেধা দ্বারা দেশ ও জাতির উন্নয়নের চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যেতে পারেন। এরূপ মেধাবী ব্যক্তিরা যখন তাদের জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান তখন আমরা তাকে মেধা পাচার বলে সংজ্ঞায়িত করি।
মেধা পাচার এজন্য বলা হয় যে, একজন ব্যক্তি তার মেধা, যোগ্যতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা সবই দিয়ে অন্য দেশকে সেবা দিচ্ছেন। মেধা বলতে যে শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা বোঝানো হয় বিষয়টি কিন্তু সেরকম নয়। বরং মেধা বলতে মূলত বোঝানো হয় একজন ব্যক্তি যে কি না যেকোনো একটি বিষয়ে দক্ষ কিংবা অভিজ্ঞ।
আরও পড়ুন >>> কত শিক্ষক অপমানিত হলে আমাদের ঘুম ভাঙবে?
দক্ষ জনশক্তিকে বলা হয় একটি দেশের সম্পদ। প্রতিটি দেশের লক্ষ্যই থাকে তার জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা। সেই দক্ষ জনশক্তির যখন ঘাটতি হয় স্বভাবতই তখন একটি দেশ যুগের সাথে তাল মেলাতে পারে না। সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে।
দারিদ্র্যতা, সামাজিক অবক্ষয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ বিবিধ সামাজিক সমস্যা দেশে জেঁকে বসে। এক সময় সেই দেশটি বিশ্ববাসীর কাছে বোঝায় পরিণত হয়।
বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশে মেধার যথাযথ মূল্যায়নের অভাব। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় মূল্যায়নের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে মেধা।
তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশ থেকে পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোয় এই মেধা পাচারের হার অনেক বেশি। বাংলাদেশ ও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার সম্ভাবনাময় মেধা পাচার হয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশের মাটিতে। এরা সেই মেধাবী প্রজন্ম যারা দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশের মাটিতে বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হচ্ছে। যে দেশের মাটিতে তাদের জন্ম বেড়ে ওঠা সেই দেশ তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায় UNESCO-এর Global Flow of Tertiary Level Students বিষয়ক রিপোর্ট ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৫৭,৬৭৫ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
আরও পড়ুন >>> শিক্ষক লাঞ্ছনায় সবাই নিশ্চুপ কেন?
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ওয়েবসাইটে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে ১০,৫০০ এরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ায় আমেরিকাতে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিগত শিক্ষাবর্ষের ১৪তম স্থান থেকে উন্নীত হয়ে ১৩তম হয়েছে।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, শুধু কি উচ্চ বেতন অথবা বিলাসী জীবন যাপনের আশায় মানুষ বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমায়। উত্তর হচ্ছে, একেবারেই না।
বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশে মেধার যথাযথ মূল্যায়নের অভাব। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় মূল্যায়নের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে মেধা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টা।
বাংলাদেশে মেধার চেয়ে দলীয় আনুগত্য, চাটুকারিতা, কালো টাকা, পেশী শক্তির প্রভাব প্রভৃতির মূল্যায়ন অনেক বেশি। এই দেশে মেধাবীরা পদে পদে বিব্রত হয়। বাংলাদেশে একজন মেধাবী পেশাজীবীর চেয়ে স্বল্প মেধার চাটুকার টাইপ মানুষের মূল্য অনেক বেশি।
এই স্বল্প মেধার মানুষগুলো যখন শুধু মাত্র চাটুকারিতা উপজীব্য করে নীতিনির্ধারক পদে যায় তখন সেই মানুষগুলোর প্রণীত নীতির সাথে মানিয়ে চলা একজন মেধাবীর পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে তার দেশ ত্যাগ ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না।
কর্ম জীবনে প্রবেশ থেকে শুরু করে কর্ম জীবনের শেষ অব্দি একজন মানুষের মেধার চেয়ে দলীয় আনুগত্য, চাটুকারিতা, কালো টাকা, পেশী শক্তির মূল্যায়ন অনেক বেশি। যার ফলে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেও অনেক মেধাবী হতাশ হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
আরও পড়ুন >>> আমাদের ঘুম ভাঙবে কবে?
মেধা পাচারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। আইনের শাসনের অভাব মেধাবীদের দেশের প্রতি বিমুখ করে তোলে। একজন মেধাবী ব্যক্তি যখন বুঝতে পারে যে তিনি তার প্রতি ঘটে যাওয়া কোনো অন্যায়ের বিচার পাবেন না। স্বভাবতই তিনি নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কা থেকে সেই দেশের প্রতি কোনো টান অনুভব করেন না। পাড়ি জমান নিরাপদ কোনো গন্তব্যে।
মেধা পাচারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। আইনের শাসনের অভাব মেধাবীদের দেশের প্রতি বিমুখ করে তোলে।
মেধা পাচার রোধে সর্বপ্রথম থাকতে হবে স্বদিচ্ছা। মেধা পাচার দেশের জন্য অশনি সংকেত। মেধা পাচারের ফলে দেশ যে কী ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে আগাচ্ছে সেই সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে। একেক জন মেধাবী দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে দেশের যে ক্ষতি হয় তা আর্থিক মানদণ্ডে নিরূপণ অসম্ভব। তেমনি সম্ভব নয় সহসা এই ক্ষতি পূরণ করা। তাই বাস্তবতার ভয়াবহতা উপলব্ধি পূর্বক মেধা পাচারে চাই দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবমুখী পরিকল্পনা।
মেধা পাচার রোধে সর্বাগ্রে চাই মেধার মূল্যায়ন। সবকিছুর উপরে মেধার মূল্য দিতে হবে। শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থের বরাদ্দ দিতে হবে। শিক্ষাকে আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ না করে শিক্ষার মানোন্নয়নে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। যত বেশি শিক্ষাব্যবস্থার মানের উন্নয়ন ঘটবে দেশে ততবেশি মেধার প্রসার ঘটবে।
আরও পড়ুন >>> শিক্ষার ভিত শক্ত হবে কবে?
দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। দেশে যতদিন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হবে ততদিন মেধাবীরা নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা থেকে অধিকতর নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় লাভের সুযোগ খুঁজবে।
কাজেই সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া মেধা পাচার রোধ সম্ভব নয় একথা সত্য যে মেধা পাচার রোধ করতে হলে মেধাবীদের কদর করতে হবে। মেধাবীদের কদর না করে দলীয় আনুগত্য, চাটুকারিতা, কালো টাকা, পেশী শক্তির প্রভৃতির কদর করলে মেধা পাচার রোধ সম্ভব নয়।
একজন মেধাবীর একমাত্র পরিচয় হবে তিনি মেধাবী। তিনি একমাত্র মেধার ভিত্তিতে মুল্যায়িত হবেন অন্য কোন ভিত্তিতে নয়। সমাজে যতদিন এই সত্য প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন মেধা পাচার রোধ সম্ভব নয় ।
মনিরা নাজমী জাহান ।। পিএইচডি গবেষক, ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য