শিক্ষার ভিত শক্ত হবে কবে?
দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক, মানসম্মত শিখন সরঞ্জাম এবং নিরাপদ ও সহায়ক শিক্ষার পরিবেশ—এই তিনটি বিষয় মানসম্মত শিক্ষার স্তম্ভ হিসেবে ধরা হয়। বলা হয়ে থাকে, আধুনিক বিশ্বে যে দেশটি জ্ঞান এবং তথ্যের দিক দিয়ে এগিয়ে সেই দেশ যেকোনো বেসামরিক সেনাবাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী।
যে দেশের মানুষ মানসম্মত শিক্ষা পায় তারাই জ্ঞান ও তথ্যে এগিয়ে থাকে। সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সমস্যা সমাধানে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা মানুষকে এমন কিছু ক্ষমতা প্রদান করে যার ফলে তারা মানব সম্পদে পরিণত হয় এবং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। এতে করে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
তবে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর শিক্ষা বিষয়ক পরিসংখ্যান হতাশ হওয়ার মতো তথ্য দিচ্ছে। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, প্রাথমিক শিক্ষায় গণিত বিষয়ে পাঠদান কঠিন মনে করেন ৭৫ শতাংশ প্রধান শিক্ষক।
আরও পড়ুন >>> জিপিএ-৫ তৈরির কারখানা!
মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পাঠদান করেন তাদের ৮০ শতাংশের ওই বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই। এছাড়া তাদের ৫৫ শতাংশের নেই বিষয়ভিত্তিক কোনো প্রশিক্ষণ।
অন্যদিকে ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস—এর পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, প্রাথমিক শেষ করেও গণিতের ন্যূনতম জ্ঞান অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু। ষষ্ঠ, অষ্টম শ্রেণির প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজি বিষয়ে দক্ষতার অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক।
আবার যেসব শিক্ষার্থী গণিত বিষয়ে দক্ষ হিসেবে গড়ে উঠছে না, পরবর্তীতে তারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার আগ্রহও রাখছে না। দুই দশকের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর সংখ্যার দিকে নজর রাখলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।
শিক্ষা পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত তিন দশকে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ।
যে দেশের মানুষ মানসম্মত শিক্ষা পায় তারাই জ্ঞান ও তথ্যে এগিয়ে থাকে। সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সমস্যা সমাধানে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়া শিক্ষার্থীরা উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে বিভাগ পরিবর্তন করছে। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান-ভীতি, বিজ্ঞান বিভাগে অতিরিক্ত খরচের ভয়, আশানুরূপ ফলাফল অর্জনের ভয়, দক্ষ বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব এক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
উচ্চ মাধ্যমিকের প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে উচ্চশিক্ষায়। গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স ২০২১-এর তথ্য মতে, প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সাধারণ সহায়ক পরিবেশের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে তৈরি করা ইনডেক্স অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে সবার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন >>> সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি?
উপরের তথ্যগুলো যদি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরে প্রদত্ত শিক্ষার গুণমান শক্তিশালী মানব সম্পদ তৈরি করতে পারার মতো নয়।
একই সাথে দেশে জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজের প্রত্যাশা পূরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ রয়েছে বলেও চিহ্নিত করা যায় না। অর্থাৎ যেখানে দুর্বলতা থেকে গেলে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার ভিতই নড়বড়ে থেকে যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সেটি ঘটছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত মানদণ্ড অনুযায়ী না হওয়া, নাজুক অবকাঠামো, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া পাঠদান, শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম বারবার পরিবর্তন, টেকসই শিক্ষা-ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও দেশের শিক্ষার ভিত শক্ত নয়। অর্থাৎ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় উপরে উল্লিখিত তিনটি স্তম্ভেরই ঘাটতি রয়েছে—সেটি সহজে আঁচ করা যায়।
বিদ্যালয়ে প্রতিবছর শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার বিষয় স্বাভাবিক হলেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অসম অনুপাত লক্ষণীয়, যা সুষ্ঠু শিক্ষাদানে বড় বাধা। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, উন্নত দেশগুলোয় প্রতি ১২ থেকে ১৫ শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক থাকলেও বাংলাদেশে প্রতি ৩৫ শিক্ষার্থীর জন্য আছেন ১ জন শিক্ষক।
আরও পড়ুন >>> জিপিএ-৫, শিক্ষায় বরাদ্দ এবং বাস্তবতা
এদিকে শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ সুবিধা নিশ্চিত না করা এবং নিম্নমানের প্রারম্ভিক শৈশব উন্নয়ন কর্মসূচি মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের জন্য অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। কারণ এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক, নিম্নমাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মরিচা ও বায়ুস্থিত বিভিন্ন পদার্থের সংস্পর্শে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি বিনষ্ট হওয়ার খবর পাওয়া যায় গণমাধ্যমে। এছাড়া দক্ষ শিক্ষক না থাকায় মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞানের পাঠদান সহজ হয় না।
শুধু তাই নয়, শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তনও শিক্ষার ভিত দুর্বলতার জন্য দায়ী বলে মনে করা যায়। যেমন, ২০০৯ সালে চালু হওয়া শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এক যুগ পার না হতেই বন্ধ হচ্ছে। এভাবে বছর বছর নতুন পাঠ্যক্রমে শিক্ষকের পাঠদান ও শিক্ষার্থীর পাঠ গ্রহণের সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া কম বরাদ্দের প্রভাবও পড়ছে শিক্ষায়।
মর্যাদা ও বেতনের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থান সবার নিচে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে শিক্ষকেরা মানে ও গুণে উপেক্ষিতই থাকছেন।
জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (এসকাপ) অর্থনৈতিক ও সামাজিক জরিপের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় ব্যয় করে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ব্যয় করে।
জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) যেকোনো দেশের শিক্ষা খাতে তার জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের পরামর্শ দেয়। কিন্তু ২০২১ ও ২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে এই অনুপাত ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ এবং ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।
আরও পড়ুন >>> শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই দুই খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকলে একটি কর্মক্ষম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। যদিও বিশ্বের ১২৫টির মতো দেশে গবেষণা ও উন্নয়ন নামে আলাদা একটি খাত রয়েছে, যার বরাদ্দ শিক্ষাখাতের বরাদ্দের বাইরে রাখা হয়।
সদস্য দেশগুলো এই খাতে প্রতি বছর প্রায় এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করে থাকে। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যারা বেশি ব্যয় করে, তারা বেশি উন্নত। এই তালিকায় নেপাল থাকলেও বাংলাদেশের নাম নেই।uni
ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে এমন বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, এবং গণিত (STEM) বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থায় গতি আনতে সক্ষম হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশ এখনো এই উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার সাথে যুক্ত হতে পারেনি। কারণ পরিকল্পনাহীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রমাণ দিচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
বিশেষায়িত দক্ষ স্নাতক ডিগ্রিধারী তৈরির চিন্তা থেকেই দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেখানে মানবিক, সমাজবিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো বিষয় পড়ানো হচ্ছে।
মর্যাদা ও বেতনের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থান সবার নিচে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে শিক্ষকেরা মানে ও গুণে উপেক্ষিতই থাকছেন। তাই তারা পর্যাপ্ত আগ্রহ নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সঠিকভাবে মনোনিবেশ করতে পারছেন না।
আরও পড়ুন >>> মাধ্যমিকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পাঠ : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
আসলে, শিক্ষার মনোন্নয়নের মধ্যেই জাতি ও দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিহিত। কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়নই টেকসই হবে না, যদি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা না যায়।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্বে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটাকে টেকসই করার জন্য দরকার যোগ্য ও দক্ষ মানসম্পদ। আদর্শ, আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাই কেবল বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। আর এমন শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থায় অধিক দৃষ্টি দেওয়া। কাজটি কিন্তু সরকারকেই করতে হবে এবং তা শুরু করতে হবে এখনই।
ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ; ও প্রশাসক, জনসংযোগ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]