নির্বাচনী বছরে উত্তপ্ত রাজনীতি ও অর্থনীতি
আগামী সপ্তাহ রাজনৈতিকভাবে বেশ কর্মসূচি নির্ভর থাকবে বলেই বোঝা যাচ্ছে। নেতৃত্ব নির্বাচনে আগামী ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২২তম জাতীয় সম্মেলন বা কাউন্সিল করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এদিন ঢাকায় গণমিছিলের কর্মসূচি থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের অনুরোধে বিএনপি তা পিছিয়ে নিয়েছে ৩০ ডিসেম্বর। বিএনপি শুধু একা নয়, সমমনা বিরোধী দলগুলোও একই দিন আলাদা আলাদা গণমিছিল করবে।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় মহাসমাবেশ ঘিরে যে রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আপাতত মিইয়ে গেছে। সরকারি চাপে বিএনপি নয়া পল্টন থেকে সমাবেশ কমলাপুরের গোলাপবাগে নিতে হয়েছে, বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশের অভিযান পরিচালিত হয়েছে, সংঘর্ষ হয়েছে, একজনের মৃত্যু হয়েছে, পুলিশসহ অনেকে আহত হয়েছে এবং দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং কেন্দ্রীয় নেতা মির্জা আব্বাস গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।
ঢাকার সমাবেশের আগে বিএনপির কোনো কোনো নেতার বক্তব্য পরিস্থিতি বদলে দেয়। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে খালেদা জিয়া উপস্থিত থাকবেন বা ১০ তারিখের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে—এই ধরনের বক্তব্য উঠে আসায় একটা যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতি তৈরি হয়।
আরও পড়ুন >>> ১০ ডিসেম্বর : কী খেলা হবে?
তাই ১০ ডিসেম্বর কী জানি কি হয়—জনমনে এমন যে একটা আতঙ্ক ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই সমাবেশ করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা চলে গেছে তা বলা যাবে না। বলতেই হবে যে, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এই উত্তাপের পারদ উঠানামা করবে।
বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিজেকে সরিয়ে রেখে গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অধীনে নির্বাচন করেছে। ফলাফল তার অনুকূলে যায়নি। এবার দলটি দীর্ঘদিনের সাথী জামায়াতে ইসলাম থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখছে, তবে রাজনৈতিক কর্মসূচি যুগপৎভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সামন্তরালভাবে বিএনপির কর্মসূচিগুলোয় থাকবে মাহমুদুর রহমান মান্না ও রেজা কিবরিয়ার দলও। নিজেদের মতো করে আছে সিপিবি ও বাসদ।
বিরোধী পক্ষ যখন আন্দোলনমুখী, শাসক দল আওয়ামী লীগ তখন নির্বানচনমুখী। কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুন মুখ নিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চায় দলটি।
বিরোধী পক্ষ যখন আন্দোলনমুখী, শাসক দল আওয়ামী লীগ তখন নির্বানচনমুখী। কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুন মুখ নিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চায় দলটি। সেই নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়েই বেশি আলোচনা।
আওয়ামী লীগ চায় সংবিধান মোতাবেক শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই হবে। তবে বিএনপিসহ প্রায় সব বিরোধী দল বলছে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই তা হতে হবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই, এই একটি বছরের রাজনীতি অনেক বেশি অস্থিরতার ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইঙ্গিত দিচ্ছে সহিংসতার।
আরও পড়ুন >>> রাজনীতির খেলায় ফাউল যেন না হয়
নির্বাচনের আগের বছর হিসেবে রাজনীতি এমন একটা পর্যায়ে থাকবে সেটা বোঝাই গিয়েছিল। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও রাজনীতির সাথে সমভাবে আলোচিত। ইতিমধ্যে আর্থিক খাতের অনিয়ম নিয়ে মাঠ গরম আছে। দেশ থেকে বড় আকারে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বলেও বড় প্রচারণা আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের আঁচে সাধারণ মানুষের হাত নিয়মিত পুড়ছে।
এমন এক বাস্তবতায় রাজনীতির মাঠ মানুষকে কোনদিকে ধাবিত করে সেটা দেখবার বিষয়। গোলাপবাগে ঘোষিত বিএনপির ১০ দফার সঙ্গে তাল রেখে আরও নানারকম দফা ভিত্তিক কর্মসূচি দিচ্ছে বিএনপির সমমনা দল ও জোট সমূহ।
এসব দফায় নতুনত্ব কিছু নেই। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পর্যদুস্ত মানুষকে উত্তেজিত করতে চাইবে এরা। জনগণ কতটা সাড়া দেবে বা দিতে পারবে সেটাও এখনই বলা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন >>> দলাদলি নয় গলাগলি হোক
প্রধানমন্ত্রী নিয়মিতই কথা বলছেন আর্থিক খাত ও অর্থনীতি নিয়ে। বলছেন গুজবে কান দিয়ে আতঙ্কিত না হতে। দাবি করছেন, বিশ্বে অস্থিরতা সত্ত্বেও, দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে পেরেছে সরকার এবং সেটা রাখতে তিনি ও তার সরকার বদ্ধপরিকর। তিনি সবাইকে বৈশ্বিক পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিয়ে খাদ্য উৎপাদনে প্রতিটি নাগরিকের সক্রিয়তা প্রত্যাশা করেছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ দুটি—অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন করা এবং অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি কৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
সত্যিকার অর্থে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সতর্ক থাকতেই হচ্ছে আমাদের। বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলে মূলত জ্বালানির দর বৃদ্ধি এবং সরবরাহ ব্যবস্থা ধাক্কা খেতেই পারে এবং তখন ফের মাথাচাড়া দিতে পারে মূল্যস্ফীতির হার। এমনিতেই চড়া জিনিসের দামে নাজেহাল মানুষ। তার মধ্যেই যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সহিংসতা হয়, তখন উদ্বেগ বাড়ে বৈকি।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ দুটি—অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন করা এবং অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি কৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এক দৃষ্টিতে দেখলে এগুলো তার জন্য সুযোগও বটে।
আরও পড়ুন >>> আন্দোলনের ডামাডোলে থাকুক শান্তির বারতা
পুলিশি চাপ ও নিজেদের পেশিশক্তির মহড়ার বাইরে গিয়ে কীভাবে রাজনীতির মাঠে নিজেরা থাকবে, সেটাই বিবেচ্য। ২৪ তারিখের কাউন্সিলের পর, নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকতে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে কী ধরনের গুণগত পরিবর্তন আসে সেটা দেখার বিষয়। এর মধ্যেই আমরা দেখলাম স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীসহ দলের শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত শতাধিক নেতা-কর্মীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ।
প্রশ্ন হলো, এতে করে কী প্রান্তিক পর্যায়ে শক্ত গৃহবিবাদের চর্চা যে চলছে বহু বছর ধরে সেটা কমবে? অন্যদিকে অর্থনীতিতে বড় আলোচনা ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি, টাকা পাচার ও দুর্নীতি। মানুষ এখানেও দোষী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধ দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দেখতে চায়।
পথকে ঘিরে যে রাজনীতি, সেই পথ হারিয়েছে অনেক আগেই। তাই নিশ্চিত হয়েই বলা যায় সামাজিক যুদ্ধ চলবে, চলবে রাজনৈতিক সংঘাত। উদারনৈতিক শক্তির অবস্থান রাজনীতিতে যত দুর্বল হবে, এক অঘোষিত যুদ্ধে সবাই নিয়োজিত থাকবে। একটা মোটামুটি মানের জনবাদী রাজনীতির আশায় দেশের মানুষ।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন