মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা
আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের চরম দুর্দিনে, মাতৃভূমির টানে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঝাঁক স্বপ্নবাজ যুবকদের সাথে তিনিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
স্বপ্ন দেখেন, স্বাধীন দেশ হবে ক্ষুধামুক্ত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, স্থান করে নেবে উন্নত দেশের আসনে। থাকবে না কোনো হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ। মানুষ মর্যাদা পাবে মানুষ হিসেবে।
১৯৭১ সালের টগবগে সেই তরুণের বয়স আজ ষাট থেকে সত্তরের কোটায় এগিয়ে চলছে। বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে বিশ্বাসের সংকট, কারণ চারপাশে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতা।
আরও পড়ুন >>> ধর্মের রাজনীতি নাকি রাজনীতির ধর্ম
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চন্দ্রে আজ একটু একটু করে গ্রহণ লেগেছে। দুষ্ট রাহুর করালগ্রাসে গলাধকরণ হয়ে যাচ্ছে বাঙালির শাশ্বত চেতনার চন্দ্র। কোনোমতে টিকে আছে সরু এক ফালি চাঁদ। তাও বুঝি নিভু নিভু করছে। নিভে গেলেই সব শেষ, শুধুই একরাশ অন্ধকার! তবে একথাও সত্য গ্রহণ সাময়িক; গ্রহণের পরেই আবার আকাশে পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্র হাসে।
কিন্তু ১৯৭১ সালের অসাম্প্রদায়িক পটভূমিতে জন্ম নেওয়া দেশের গতিপ্রকৃতি ধীরে ধীরে এমন কেন হয়ে যাচ্ছে? এমনটা হওয়ার তো কখনোই কথা ছিল না। এরকম সহস্র 'কেন' এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দাদু-বাবা-কাকাদের প্রজন্মের সাথে সাথে আমরা নতুন প্রজন্মও বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
মনে হয় শিশুকালই ভালো ছিল, আর বড় হতে ইচ্ছে করে না চারপাশের ছদ্মবেশী মুখগুলোর কারণে। অসাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গে আশেপাশের চেনা মুখগুলো মাঝেমধ্যে বড় অচেনা লাগে...
আজ চারপাশের ঘটনা দেখে 'স্বাধীনতা' শব্দকে মাঝেমধ্যে পরিহাসের মনে হয়। একরাশ হতাশার অন্ধকারে নিজেকে বড় অসহায় লাগে। পরক্ষণেই আবার আশ্বস্ত হয়ে, স্বাধীনতার মূল্যবোধের শক্তিতে আশায় বুক বাঁধি।
জানি বিশ্বাস হারানো যাবে না। তবুও যতদিন যাচ্ছে জীবনের মালা থেকে একটি একটি করে বছররূপী ফুল খসে খসে পড়ছে; তত বেশি করে আমরা মুখোমুখি হচ্ছি এক ঝাঁক রুঢ় নির্মম নগ্ন বাস্তবতার।
মনে হয় শিশুকালই ভালো ছিল, আর বড় হতে ইচ্ছে করে না চারপাশের ছদ্মবেশী মুখগুলোর কারণে। অসাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গে আশেপাশের চেনা মুখগুলো মাঝেমধ্যে বড় অচেনা লাগে। সামান্য কোনো ইস্যু পেলেই পরিচিত মুখ থেকে শোনা যায়—উসকানিমূলক কথা, মিথ্যা বুলি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই অবিশ্বাস্য আষাঢ়ে সাম্প্রদায়িক গালগল্পগুলো বর্তমান প্রজন্মের বিশালসংখ্যক তরুণ বিশ্বাস করছে, হৃদয়ে গভীরভাবে ধারণ করছে এবং তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রচারও করছে।
আরও পড়ুন >>> ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস
কোনটা সত্য তা বলার আগে দশবার, দশদিক ভাবতে হয়। সদা সর্বদাই আত্মবিশ্বাসের অভাব। এই অভাব টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলেছে সমস্ত সম্ভাবনা; সমস্ত সৃষ্টিশীলতা। লোভী, ভণ্ড, ছদ্মবেশী সাম্প্রদায়িক দানবেরা নৈরাজ্যের ঘুঙুর পায়ে দিয়ে সারাদেশে এক আনন্দ উল্লাসে মত্ত।
এদের অনুগামী নাগিনরা সারাদেশে বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে। বিষের চাদরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে দেশের আকাশ। হিংস্র শকুনের দল, রক্ত মাংসের আকাঙ্ক্ষায় সদানুসরণ করছে তাদের। মনে পড়ে হিংস্র নাগিনদের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা।
“নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস--
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের হিসাবে দেশে কমপক্ষে নয় লাখ হিন্দু কম আছে। এদের মধ্যে ১৫টি জেলায় দশ বছরে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে আশঙ্ক্ষাজনক হারে। (প্রথম আলো, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২)
আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন
আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করি হিংস্র শ্বাপদের এবং এই ধারাবাহিকতায় আমার সর্বপ্রকার বিভেদের দুয়ার চিরতরে বন্ধ করে গড়ে তুলি একটি অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা। যে স্বপ্ন আমরা স্বাধীনতার ঊষালগ্নে দেখেছিলাম। কিন্তু সেই অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সোনার বাংলার স্বপ্ন হয়তো স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে।
১৯৭১ সালে দেশের সবাই মিলে স্বাধীনতার, অসাম্প্রদায়িকতার স্বপ্নের বীজ রোপণ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলাম–“বাংলার হিন্দু, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালী।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল না কোনো বিভেদ, ছিল না কোনো উঁচু-নিচু বাছবিচার। আমরা দীক্ষিত হয়েছিলাম স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ঐক্যের মূলমন্ত্রে।
১৯৭১ সালে দেশের সবাই মিলে স্বাধীনতার, অসাম্প্রদায়িকতার স্বপ্নের বীজ রোপণ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলাম–“বাংলার হিন্দু, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালী।” কিন্তু যখন হাজার বছরের সাতসমুদ্র সেঁচা স্বাধীনতা নামক অমূল্য ধন আমাদের হাতে যখন আসলো, ঠিক তখনই চলে আসলো, সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ। পরে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পরে তো সকল সংখ্যালঘুই প্রায় দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হতে শুরু করলো। শুধুমাত্র ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী বারিধারায় বসবাস করা গুটিকতক ধনী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ছাড়া।
রাষ্ট্রের কি কোনো দায় নেই সব ধর্মের মানুষের অধিকার রক্ষায়? এখন প্রয়োজন সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়, যা পাকিস্তানের মতো বর্বর রাষ্ট্রেরও আছে। কিন্তু আমাদের নেই।
এই দেশ ‘হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ’—এই সম্প্রীতি রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ষোড়শ শতকের খ্যাতিমান কবি জ্ঞানদাস বলেছেন—
“সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
আনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল।।
সখি কী মোর করমে লেখি।
শীতল বলিয়া ও চাঁদ সেবিনু
ভানুর কিরণ দেখি।।
উচল বলিয়া অচলে চড়িতে
পড়িনু অগাধ জলে।”
আমরাও আশায় বুক বাঁধি। সেই আশা প্রতিবার হতাশায় রূপ নেয়।
আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়
হায় দেশমাতৃকা! হায় ১৯৭১! হায় কোথায় তোমার অসাম্প্রদায়িক চেতনা। তুমি কি ঘুমিয়ে আছ দেখতে পাচ্ছো না—তোমার পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন। তোমার সন্তানদের দিনে দিনে ভুল পথে প্ররোচিত করে জোটবদ্ধ হচ্ছে শকুনের দল। ছলে-বলে-কৌশলে শক্তি বৃদ্ধি ঘটছে তাদের, এদের আক্রমণ দিনে দিনে তীব্রতর হচ্ছে। সেদিকে কেন চোখ পড়ছে না?
অসাম্প্রদায়িক বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে, স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অগ্রগামী থেকে এই কি তাদের পুরষ্কার! অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার লক্ষ্যে এখন সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। বিজয়ের এই সময়ে এসে আমাদের সবাইকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, মনে ধারণ করতে হবে, ‘আমরা অসাম্প্রদায়িক’।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়