আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন
আমরা অনেক সময় একটা কথা বলে থাকি, ‘কারো শূন্যতাই অপূর্ণ থাকে না। কোনো না কোনোভাবে সেই শূন্যতা পূরণ হয়।’ আসলেই কি তাই? আমি মনে করি সর্বক্ষেত্রে কথাটি প্রযোজ্য নয়। তবে, কথাটি আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মানুষের সেই শূন্যতা পূরণ না হলেও তার দেখা স্বপ্নের মৃত্যু হয় না! সেই স্বপ্ন আজ না হয় কাল ঠিকই বাস্তবায়ন হয়। তাই আমরা প্রিয় কোনো মানুষ প্রয়াত হলে তার স্বপ্ন বা ইচ্ছেগুলো বাস্তবায়নের কথা বলে থাকি।
অমর একুশের গানের রচয়িতা, প্রখ্যাত কলামিস্ট ও সাংবাদিক ভাষা সৈনিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রয়াত হয়েছে ১৯ মে ২০২২। তার শূন্যতা কি কেউ পূরণ করতে পেরেছেন? পারেননি! আমি মনে করি, সেটা সম্ভবও নয়। তবে, তিনি যে স্বপ্নের কথা বলে গেছেন, তার সেই স্বপ্নগুলো চেষ্টা করলে হয়তো আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব। যে স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়ার কথা জীবনের শেষ দিনগুলোয় বারবার বলেছেন এবং লিখেছেন সেই কথাগুলোই আমি পুনরাবৃত্তি করব।
গাফ্ফার চৌধুরীর বিশ্বাস ছিল আরও কয়েকটি জন্মদিন তিনি উদযাপন করে যেতে পারবেন। যদিও ডাক্তাররা তাকে জানিয়ে দিয়েছিল তার আয়ু কমে আসছে। কিন্তু তিনি সেটা বিশ্বাস করেননি। ডাক্তারদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে চিরপ্রস্থান করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : আমি কি ভুলিতে পারি
মৃত্যুর আগের দিনও সচল ছিল তার কলম। শুরু করেছিলেন আত্মজীবনী লেখা। ডিকটেশন দেওয়ার সময় আমাকে বলেছিলেন, ‘বড্ড দেরি করে ফেলেছি। এতটা দেরি করা ঠিক হয়নি।’ তার স্বপ্ন ছিল, আত্মজীবনী লিখে শেষ করার। যদি শেষ করতে না পারেন, তাহলে কী করতে হবে অসম্পূর্ণ লেখা দিয়ে সেই ব্যাপারেও দিয়েছেন নির্দেশনা।
আমি তার এই ইচ্ছে বাস্তবায়নের চেষ্টা করব যথাসাধ্য। তবে, অন্য যে স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি বলে মনে করতেন গাফ্ফার চৌধুরী, অল্প কথায় সেই কথাগুলো বলব এবার। সেগুলো বাস্তবায়নে আবশ্যিকভাবেই এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। কারণ তার স্বপ্নগুলো ব্যক্তি উদ্যোগে বাস্তবায়ন অসম্ভব।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নাম উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের কথা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়ে তিনি ছিলেন আপসহীন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নাম উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের কথা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়ে তিনি ছিলেন আপসহীন। দুঃখ করে বলতেন, যে লক্ষ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হলো, সেই লক্ষ্য তো পূরণ হলো না আজও।
মুক্তিযুদ্ধে আমরা এক কাতারে দাঁড়ালাম স্বাধীনতার জন্য। ধর্ম, বর্ণের ব্যবধান ঘুচে গেল। তাহলে আজ কেন আমাদের এই পশ্চাৎপদতা। আর এজন্য তিনি রাজনীতিকেই দায়ী করেছেন। ১৯৭৫ পরবর্তী ২১ বছরের রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করিয়েছেন কাঠগড়ায়।
টানা ৩ দফা ক্ষমতায় থেকেও ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে না পারা তাকে ব্যথিত করেছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের রাজনীতিতে উত্থান প্রসঙ্গে বারবার কথা বলেছেন তিনি।
আরও পড়ুন : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা
রাজনীতি হবে মানুষের কল্যাণে, মানুষের জন্য, ধর্ম থাকবে এসবের ঊর্ধ্বে—একথা বিশ্বাস করতেন তিনি। কিন্তু আমাদের দেশে ধর্মকে পুঁজি করে যে রাজনীতির বলয় গড়ে উঠেছে, তিনি ছিলেন এর ঘোর বিরোধী। বলতেন, এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে যেমন সাংঘর্ষিক তেমনই পরিপন্থী। পরিস্থিতির কারণে যেসব দল বা সংগঠনের সাথে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব সমঝোতায় গিয়েছে, এই পরিস্থিতির জন্য তিনি আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেছেন।
তার ভাষ্য ছিল আওয়ামী লীগ যদি সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দিতে পারতো তাহলে যারা দেশ ছেড়ে গেছে তারা দেশ ছেড়ে যেত না। আর তারা যদি দেশ ছেড়ে না যেত তাহলে আজ শুধু ভোটের জন্য হেফাজতের কাছে যেতে হতো না। নিজেদের শক্তিশালী ভোট ব্যাংক থাকতো আওয়ামী লীগের।
তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, সংখ্যালঘুদের কেউ কখনো কোনো ক্যুর সাথে যেমন সম্পৃক্ত ছিল না, তেমনই তাদের রাজনীতি নিয়েও উচ্চাভিলাষ নেই। কিন্তু ধর্মীয় রাজনীতি যারা করে তাদের সেটা আছে।
তিনি ভারতের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, হিন্দু প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেই দেশে যদি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে, তাহলে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রে কেন সেটা আজও সম্ভব হলো না। আর যদি সেটা হতো তাহলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং আস্থার সংকট তৈরি হতো না।
আরও পড়ুন : ‘আমি কি ভুলিতে পারি?’
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল, ধর্ম হবে যার যার, দেশ হবে সবার। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেলে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত বিশ্বাস করতেন তিনি এবং স্বপ্ন দেখতেন একদিন না একদিন বঙ্গবন্ধুর সংবিধানে ফিরে যাবে দেশ।
তিনি সৌদি আরবের উদাহরণ দিয়ে তাদের আধুনিকতার পথযাত্রার কথা বলেছেন, তারা পারলে আমরা কেন পারব না। বাইরের সংস্কৃতি যে বাঙালির সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত করছে তাও বলেছেন বারবার। বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধে ভূমিকা নিতে বলেছেন সরকারকে।
দেশের উন্নয়ন নিয়ে তিনি যতটা সন্তুষ্ট ছিলেন, ততটাই অসন্তুষ্ট ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ আজও প্রতিষ্ঠা না হওয়ায়। বলতেন, শুধু উন্নয়ন দিয়ে জাতি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। নানা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করলেও তার প্রতিই অবিচল আস্থা এবং বিশ্বাস ছিল তার।
আমি একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আওয়ামী লীগ করেও আওয়ামী লীগের এত সমালোচনা করেন কেন? প্রতি উত্তরে বলেছিলেন, কাউকে না কাউকে তো সঠিক পথের দিশা দেখাতে হবে। বলতে হবে সত্য কথা। তবে সবকিছুর পরও আমি নেত্রী হিসেবে, জাতির আশা এবং ভরসার স্থল হিসেবে শেখ হাসিনার প্রতিই আস্থা রাখব। কারণ সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া বা নেতা ছাড়া কোনো জাতি অগ্রসর হতে পারে না।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল, ধর্ম হবে যার যার, দেশ হবে সবার। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেলে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত বিশ্বাস করতেন....
নেতাকে হতে হবে ডায়নামিক এবং বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য। বঙ্গবন্ধু সঠিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলেই আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। আর শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের বদৌলতেই বাংলাদেশ পৌঁছেছে আজকের পর্যায়ে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা ছাড়া আর একজন নেতা বা নেত্রী কি আছে যে বাঙালি জাতিকে এই মুহূর্তে নেতৃত্ব দিতে পারবে?
আসলে তার বিকল্প নেই। কিন্তু তার মুশকিল হলো, বিশ্বস্ত সহযোদ্ধার অভাব! গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব বিষয়েই তাকে কথা বলতে হয়, সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে বিষয়গুলো আসলে তার হস্তক্ষেপ না করলেও চলে সেই ব্যাপারে তাকে হস্তক্ষেপ করতে হয় অনেক সময়।
আরও পড়ুন : সায়মন ড্রিং : জন্মদিনে বিনীত অভিবাদন
সরকার এবং দল দুটোই চালাতে হয় শেখ হাসিনাকে। এজন্য তিনি আওয়ামী লীগে কাউকে কার্যনির্বাহী সভাপতি করার এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে রাজনীতির ময়দানে নামানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এটা করলে আগামী নির্বাচনে সুফল পাবে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী এবং সুবিধাভোগীদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকার কথা বলেছেন তিনি। তার মতে, এরা ভয়ংকর।
শুরুতে যেমন বলেছিলাম, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ—এই তিন বিষয় আবর্তিত করেই ছিল তার লেখার জগৎ। তাই স্বাভাবিকভাবেই বেঁচে থাকলে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কলম ধরতেন তিনি। ১০ ডিসেম্বর নিয়ে যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছিল, কোন পথে হাঁটবে আওয়ামী লীগ এবং কোনপথে হাঁটবে বিএনপি সেই নির্দেশনা নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যেত তার লেখনী থেকে।
একজন পাঠক হিসেবে আমি মিস করছি গাফ্ফার ভাইয়ের কলামগুলো। আমার বিশ্বাস আরও অনেকের মতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও মিস করছেন গাফ্ফার চৌধুরীর উপদেশমূলক কলামগুলো। যে কলামগুলো দেখাতো আমাদের সঠিক পথের দিশা।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের যে কাজগুলো করা প্রয়োজন সেগুলো নিয়েই বারবার কথা বলেছেন তিনি, দেখিয়েছেন স্বপ্ন এবং সেটা তিনি করেছেন কোনো পদে আসীন না হয়েও।
আরও পড়ুন : মিশুক স্যার : ব্রডকাস্ট সাংবাদিকতার স্টাইলশিট
তিনি যে স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের কথা বারবার বলেছেন, সেই স্বপ্নগুলো আসলে বঙ্গবন্ধুরই স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং তার আদর্শের পথে যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয় দেশ তাহলেই পূরণ হবে গাফ্ফার চৌধুরীর স্বপ্ন।
এবার তার ব্যক্তিগত একটি স্বপ্নের কথা বলে শেষ করব। সেই স্বপ্ন তার প্রয়াত মেয়ে তাকে দেখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সেটি বরিশালের উলানিয়ায় তাদের বাড়িতে তার বাবা মায়ের নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন আসলে কঠিন বলে মনে করি না।
চারশ বছরের পুরোনো জমিদার বাড়িতে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হলে গাফ্ফার চৌধুরীর স্বপ্ন যেমন পূরণ হবে, তেমনই তাকে জানার ক্ষেত্রও হবে সম্প্রসারিত।
অপূর্ব শর্মা ।। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক