ফুটবল তারকারা যেভাবে উঠে এসেছেন
বিশ্বকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ না থাকলেও ফুটবল নিয়ে আমাদের উত্তেজনা অনেক। প্রিয় দেশের পতাকা উড়িয়ে, প্রিয় তারকাদের জার্সি গায়ে আমরা খেলা দেখতে বসি। তারকাদের সাফল্য আমাদের চোখ জুড়ালেও আমরা জানি না তাদের উঠে আসার গল্পগুলো। আজ জেনে নিই তাদের উঠে আসার গল্প।
নেইমার (Neymar)
ফুটবলের মহাতারকা নেইমার। তার আগে তিনি সমুদ্র বন্দরে এবং গাড়ির পার্কিং লটগুলোয় বাবার সাথে প্রায়ই কুলির কাজ করতেন। জীবনের প্রথম জুতা জোড়া ময়লার ভাগাড় থেকে কুড়িয়ে পরেছিলেন।
এতটা বিঘ্ন ও সংকটময় জীবন পার করেও ফুটবলের জন্য প্রবল ভালোবাসায় নিরন্তর কঠিন পরিশ্রম করে গেছেন তিনি। আজকের ব্রাজিল দলের তিনি অন্যতম সেরা খেলোয়াড় এবং ক্লাব বদলের ক্ষেত্রে তার পারিশ্রমিক সবচেয়ে চড়া—২২২ মিলিয়ন ইউরো।
আরও পড়ুন : ফুটবলে বাংলাদেশ কোথায়?
অস্কার (Oscar)
স্যাপ্পোরো শহরের বস্তিতে অত্যন্ত শোচনীয় এক শৈশব কেটেছে অস্কারের। মাত্র তিন বছর বয়সে তার বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। কিন্তু এতে তিনি দমে যাননি। ফুটবল খেলায় বরাবরই তিনি ছিলেন কঠোর মনোযোগী। শৈশবেই তার প্রতিভা ফুটবল বোদ্ধাদের নজর কাড়লে পাল্টে যায় তার জীবন। আজ তিনি বছরে মিলিয়ন পাউন্ড আয় করেন।
ন্যানি (Nani)
পর্তুগিজ এই উইঙ্গার মাত্র আট বছর বয়সে তার বাবা-মা কর্তৃক পরিত্যক্ত হন। তার এক বর্ষীয়সী আত্মীয়ার সাথে তখন লিসবনের শহরতলিতে থাকা শুরু করেন তিনি। অল্প বয়সেই শহরের নানা অপরাধী গ্যাং আর পুলিশের সংঘর্ষেও ভেতর পড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও তার হয়েছে। তবে অল্প বয়সেই তার ফুটবল প্রতিভা বিচ্ছুরিত হলে ‘ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাব’ তাকে ২৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করায়।
শৈশবের ঘটনা বলেন এইভাবে—“যেদিন একটি লোক আমার মাথার দিকে লক্ষ্য করে বন্দুক তুললো, সেদিনই আমি মরে যেতে পারতাম...
ডিয়েগো কোস্টা (Diego Costa)
ছোটবেলায় ডিয়েগোর এমন দিনও কেটেছে যখন প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন জোগাড় করতে হয়েছে। পরেরদিনের খাবার আগেরদিন থাকতো না। ষোল বছর বয়সে তিনি রাস্তায় ফুটবল খেলতে নামেন শখের বসে।
আরও পড়ুন : ফুটবল তারকা : যাদের শৈশব কেটেছে দারিদ্র্যে
প্রথম যৌবনে এমনও সময় গেছে যখন ব্রাজিলের গ্যাংস্টার দলে যোগ দেওয়ার কথা ভেবেছেন ভালো খেতে-পরতে পাওয়ার আশায়। কিন্তু, সেই সময়েই একটি পত্রিকায় ডেভিড বেকহ্যামের বিলাসী জীবনের উপর একটি প্রতিবেদন পড়ার পর থেকে ফুটবলেই মনোযোগ নিবিষ্ট করেন। আজ তিনি অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ-এর সেরা স্ট্রাইকারদের একজন।
রিচার্লিসন (Richarlison)
২০২২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচেই বাইসাইকেল শটের মতো দৃশ্যে পৃথিবীর কোটি কোটি দর্শকের হৃদয় জয় করলেন যে পঁচিশ বছরের রিচার্লিসন, তার শৈশব কেটেছে ব্রাজিলের দক্ষিণ-পশ্চিমের এসপ্রিটিও স্যান্টো প্রদেশের নোভা ভেনিসিয়ায়। রিচার্লিসনের শৈশবও আদৌ খুব সুখকর ছিল না এবং প্রিমিয়ার লিগ অব্দি খেলতে আসার আগে ব্রাজিলের নিষ্ঠুর শহরতলির রাস্তা পার হয়েই তাকে আসতে হয়েছে।
শৈশবের ঘটনা বলেন এইভাবে—“যেদিন একটি লোক আমার মাথার দিকে লক্ষ্য করে বন্দুক তুললো, সেদিনই আমি মরে যেতে পারতাম। সে ভেবেছিল আমি বোধ করি শহরের যে জায়গায় মাদক বিক্রি করে, সেখানে তার বেচা-কেনায় কোনো ঝামেলা পাকাবো। আমি খুব ভয় পেয়ে ভাবলাম, ‘ও ট্রিগার টিপলেই আমি মারা যাব।’—তবে সে যাত্রায় আমি বাঁচলাম এবং পালিয়ে এলাম।”
আরও পড়ুন : অর্থনীতির বিশ্বকাপ!
ভয়াবহ শৈশব পার করা রিচার্লিসন বলেন, ‘আমি যেখানে বড় হয়েছি সেখানে বহু মানুষ মাদক ও বন্দুক নিয়ে খেলতো। কাজেই শহরটি আপাতদৃষ্টে ঠাণ্ডা মনে হলেও আসলে ছিল বিপজ্জনক। বেশ কয়েকবারই আমাকে গাঁজা খেতে বলা হয় কিন্তু আমি কখনো খাইনি।
আমাদের ফুটবল স্কুলের শিক্ষকেরা ছিলেন পুলিশ অফিসার এবং তারা সবসময়ই আমাকে ও আমার ভাইকে ভালো পরামর্শ দিতেন। আমার অনেক বন্ধুই মাদকের নেশায় হারিয়ে গেছে। আজ তারা জেলখানায়। আমি আজও তাদের সাথে কথা বলি তবে সেই পথে যাইনি বলে নিজেকে আমি ধন্যবাদ দিই। সবসময় বিবেকের কথা শুনেছি আমি।’
একসময় তার জীবন ঘুরে গেল। তখন তার বাবা-মা’র বিচ্ছেদ হলো, তখন খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো তাকে। “বাবা-মা’র যখন ছাড়াছাড়ি হলো, মা তখন নোভা ভেনিসিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। সব মালপত্র বহনকারী ট্রাকের একদম উপরে আমি বসে। কিন্তু হুট করে আমি লাফ দিয়ে নেমে গেলাম, বাবার কাছে দৌড়ে গেলাম।
মেসির পরিবার এই বিপুল খরচ বহন করতে সমর্থ ছিল না। আর্জেন্টিনার কিছু ফুটবল ক্লাবও সাহায্যে অসম্মতি প্রকাশ করে...
আমি জানতাম যে মা আমাকে ফুটবল বা কোনো ধরনের খেলাই খেলতে দেবে না। তাই আমি বাবার কাছে চলে গেলাম এবং দশ বছর পর্যন্ত তার কাছেই ছিলাম। ছোটবেলায় আমি গাড়ি ধুয়েছি, ট্রাফিকের মোড়ে দাঁড়িয়ে চকলেট বিক্রি করেছি এবং মাঝে মাঝে আমার পিতামহের সাথে মিলেও কাজ করতে হয়েছে আমাকে, যদিও আমি তার সাথে কাজ করতে পছন্দ করতাম না। প্রচণ্ড ক্ষুধায় ফেরার টিকিটের টাকা খাবার কিনে শেষ করায় বুঝলাম যে এখন ভালো খেলে টিকে থাকতে হবে। যেহেতু ফেরার টাকা নেই।”
আরও পড়ুন : ফুটবল : বাঙালির প্রেম, বাঙালির জ্বর!
সেই থেকে রিচার্লিসন কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজের পরিবর্তন ঘটান, ব্রাজিল দলে ডাক পান এবং নিজেকে প্রমাণিত করেন। আজ তিনি কোটি মানুষের কাছে ফুটবল আইকন হয়ে উঠেছেন।
লিওনেল মেসি (Lionel Messi)
আর্জেন্টিনার রোসারিওতে ১৯৮৭ সালে জন্ম হয় মেসির। স্বদেশে এক প্রবল অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং চরম মুদ্রাস্ফীতির সময়ে তার জন্ম।
রোসারিও শহরে বেকারত্বের হার যখন ২০ শতাংশ, তখন তার প্রতিভা প্রথম আবিষ্কৃত হয় সেই ১৯৯৫ সালে। তার বাবা ইস্পাত কারখানার শ্রমিক এবং মা খণ্ডকালীন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। মাত্র ১১ বছর বয়সে মেসির হরমোন গ্ল্যান্ডের অসুখ ধরা পড়ে এবং প্রতি মাসে তার স্বাস্থ্যসেবায় ৬০০ ইউরোর দরকার পড়ে।
মেসির পরিবার এই বিপুল খরচ বহন করতে সমর্থ ছিল না। আর্জেন্টিনার কিছু ফুটবল ক্লাবও সাহায্যে অসম্মতি প্রকাশ করে। তখন বার্সা তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সেই বার্সার হয়ে অনেকদিন খেলার পর মেসি এখন পিএসজি’র হয়ে খেলছেন। পিএসজি’র অন্যতম বড় তারকা মেসি এবং বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার অগণিত ভক্ত।
অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক