সমাজে নারী কি প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছে?
‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় মানব সভ্যতা বিকাশে নারী-পুরুষের সমান অবদানের কথা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু আজকের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী তার অধিকার নিয়ে কতটা সচেতন হতে পেরেছে?
আমরা অনেকেই মনে করি যুগের হাওয়া বদলে গেছে। আধুনিক নারীর মনে কোনো ব্যথা নেই। কিন্তু আধুনিক সমাজেও আজ ওত পেতে বসে আছে ঘুণে ধরা মানুষ! তাদের আদিম মানসিকতা দিন দিন নানা রকমের অবমাননাকর ও আপত্তিকর মন্তব্য করে বিষিয়ে তুলছে নারীর স্বাভাবিক জীবন। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে দূর করতে হবে নারী-পুরুষ বৈষম্য। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সমূলেই উৎপাটন করতে হবে। প্রতিটা নারীকে সোচ্চার হতে হবে। আওয়াজ তুলতে হবে। প্রতিনিয়ত নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে লড়াই ও প্রতিবাদ করে।
প্রতি বছরের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস যথারীতি নিয়মে পালিত হচ্ছে ৮ মার্চ। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে উদযাপিত হয়ে আসছে এ দিবসটি। শুধু দিবসটি পালন করলেই হবে না। এর পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অধিকার রক্ষা, নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর প্রতি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠাই এর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের এই আধুনিক যুগেও প্রতিদিন বহু সংখ্যক কন্যা শিশু, কিশোরী, যুবতী কিংবা নারী অমানবিক, পাশবিক, নৃশংসসহ নানা ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বিশ্বজুড়ে নারীদের কর্মক্ষেত্রে হয়রানি অতি পুরনো এক সমস্যা। বাংলাদেশে নারীরা প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে যেভাবে এগিয়ে আসছে, হয়রানির মাত্রাও সেভাবে বাড়ছে।
আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন হয়রানির মাত্রা ছিল অনেক। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়োজিত নারীদের পুরুষের সমান বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া ও রাজনীতিতে নারী প্রতিনিধি বাড়ানোর দাবিতে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে এক কর্মসূচি পালিত হয়েছে। নির্যাতিত নারীরা ‘মি টু’ লেখা ব্যানার ও পোস্টার নিয়ে সমবেত হন সেখানে। সেই থেকে যৌন হয়রানি ঘটনা এখন আর আগের মতো হচ্ছে না। তার মানে এই সমাজে যখনই নারীরা প্রতিবাদী হয়ে রুখে দাঁড়াবে তখনই আমাদের সমাজ সোচ্চার হবে।
বিশ্বজুড়ে নারীদের কর্মক্ষেত্রে হয়রানি অতি পুরনো এক সমস্যা। বাংলাদেশে নারীরা প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে যেভাবে এগিয়ে আসছে, হয়রানির মাত্রাও সেভাবে বাড়ছে। ঠিক সেই প্রেক্ষাপটে আজ আমাদের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় অসুস্থ মানসিকতার পুরুষেরা ঘরে-বাইরে নানাভাবে নারীকে অপদস্থ করছে। একজন শিক্ষিত নারীকে কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে কটু কথার মাধ্যমে তার মনোবলকে দুর্বল করে দিচ্ছে। কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত একজন নারীকে কথার আঘাতে রক্তাক্ত করছে আমাদের পুরুষতন্ত্রের মানসিকতা।
শিক্ষিত নারীকে কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে কটু কথার মাধ্যমে তার মনোবলকে দুর্বল করে দিচ্ছে। কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত একজন নারীকে কথার আঘাতে রক্তাক্ত করছে আমাদের পুরুষতন্ত্রের মানসিকতা।
একজন নারী কীভাবে বসছে, কীভাবে খাচ্ছে, কীভাবে কথা বলছে, কী পোশাক পরছে, কীভাবে সাজছে সব কিছু নিয়ে নোংরা মানসিকতার পুরুষরা প্রতিনিয়ত বুলিংয়ের মাধ্যমে কর্মস্থলে নারীকে মানসিক হেনস্তা করছে। অধিকাংশ কর্মস্থলে পুরুষরা হয়রানিমূলক কথা, গালি, তিরস্কারমূলক শব্দ নারীকে নানাভাবে অপমান অথবা হয়রানি করার জন্য ব্যবহার করে। ফলে নারীরা নানা ধরনের মানসিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এসব ঘটনা সবসময় সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ইচ্ছে করে করা হয়। এমনকি এটা করে অসুস্থ মানসিকতার মানুষগুলো পৈশাচিক আনন্দ পায়।
অনেক কর্মস্থলে পুরুষ সহকর্মীরা এমন কথাও বলতে শোনা যায় যে, নারীরা কাজ নয়, তাদের রূপ দেখিয়ে বেতন নেয়! এসব নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করে প্রতি মুহূর্তে নারী সহকর্মীকে হেয় করা হয়। অনেক সময় নারীরা কর্মস্থলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সহকর্মীরা বলে উঠেন, ভাই আসছে...! এটাই হলো আমাদের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা। কোথায় যাবে নারীরা? কার কাছে যাবে? এই অবস্থার জন্য দায় আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের। অনেক সময় মনে হয়, এই সমাজে নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করায় যেন পাপ! অথচ ঘরে ঘরে আমাদের মায়েরা, বোনেরা, ভগ্নিরা যদি সঠিক শিক্ষাটুকু পায় তাহলে সেই ঘরের পুরুষ সদস্য কোনোভাবেই এমন আচরণ করতে পারত না! তাহলে আমরা কাদের ওপর দায় চাপাব? এই প্রশ্ন শেষে রাখতেই চাই।
বিভিন্ন কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও এখনো নিশ্চিত করা যায়নি নারীর নিরাপত্তা। উল্টো নারীর প্রতি বেড়েছে ভয়াবহ সহিংসতা। নারীরা বাইরে কাজ করছে, কিন্তু যারা পথ তৈরির কাজটা করছে তাদের ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হতে হয়। প্রকৃতপক্ষে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা রাষ্ট্র কিংবা সমাজের কাছে ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। নারীর অধিকার আদায়ের লড়াই স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই। তারপরও এখনো নারীরা বৈষম্যের মধ্যে আছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সহকর্মীরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
পরিশেষে বলা যায়, এখনো আমাদের মানসিকতা, মুক্তচিন্তা আর প্রকৃত শিক্ষার অভাব রয়ে গেছে। এই দিবস পালন করার আগে আমাদের মানুষ হওয়ার দিবস পালন করা উচিত।
নাহিদা রিনথী ।। সংবাদ উপস্থাপিকা