ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার
আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীদের ওপর হওয়া বৈষম্য, নির্যাতনের বিরুদ্ধে করা প্রতিবাদে নারীদের জাগ্রত করাই নারী দিবস পালনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। অথচ এই নারীর অবদান পুরুষ কখনও অস্বীকার করতে পারবে না। পুরুষের প্রতিটি সৃষ্টিকর্মের মধ্যে রয়েছে নারীর ভূমিকা। তাইতো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৪৮ সালে মানবাধিকার ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় বলা হয়েছে, সকল মানুষ সমভাবে জন্মগ্রহণ করে এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে অধিকারগুলো ভোগ করতে পারবে।
মানব মন ও মানব সমাজে নারী প্রগতির গোড়াপত্তন করে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। নর-নারী উভয়ে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে স্বীকৃত এবং কর্মফল অনুযায়ী স্বর্গ লাভের সম অধিকার প্রাপ্য। যেভাবে পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করছেন, ‘তিনি তোমাদের একই সত্তা হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার জীবন সঙ্গিনীকে একই উপাদান হতে সৃষ্টি করেছেন’ (সুরা নেসা, আয়াত: ১)।
পারিবারিক জীবনে সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রে নারীর ওপর পুরুষের প্রাধান্য থাকলেও সার্বিক মূল্যায়নে ইসলাম নারী জাতিকে পুরুষের অধিক মান-মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছে, যা অন্য কোনো জাতিতে করেনি।
ইসলামের কষ্টিপাথরে নারী-পুরুষের মর্যাদা ও অধিকার তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসলাম নারীকে শুধু পুরুষের সম-অধিকার নয় বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষ থেকে নারীকে অধিক মর্যাদা দিয়েছে। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত ঘোষণা করে ইসলাম নারী জাতিকে সর্বোত্তম মর্যাদায় ভূষিত করেছে, যে মর্যাদা পুরুষকে দেওয়া হয়নি। ইসলামে একজন নারী, একজন পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ও মর্যাদার অধিকারী।
পারিবারিক জীবনে সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রে নারীর ওপর পুরুষের প্রাধান্য থাকলেও সার্বিক মূল্যায়নে ইসলাম নারী জাতিকে পুরুষের অধিক মান-মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছে, যা অন্য কোনো জাতিতে করেনি। ইসলাম নারী-পুরুষের জন্য পৃথক পৃথক কোনো আদেশ-নিষেধও করেনি, আবার তাদের মাঝে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করেনি।
এ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহতাআলা নিজেই নারী-পুরুষের মাঝে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করেননি। যেভাবে বলা হয়েছে, নারী-পুরুষ যেই ভালো কাজ করবে সে-ই জান্নাতে প্রবেশ করবে। এছাড়া ইসলামে নারী জাতির অবদান অনেক। সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার মর্যাদাও লাভ করেছিলেন একজন নারীই। ইসলামের উন্নতির জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থের জোগানও দিয়েছিলেন একজন নারীই।
ইসলামের পক্ষে জেহাদ করতে গিয়েও সর্বপ্রথম যিনি নিজের জীবন দান করেন, তিনিও ছিলেন একজন নারী।
স্মরণ করি জাহানারা ইমামকে। বাঙালি জাতির যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে আলোর মশাল হাতে পথ দেখিয়েছেন তিনি। তার হাতে গড়া গণআদালতের মাধ্যমেই বাংলাদেশে শুরু হয় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া।
আজ যখন একজন নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন কান্নায় বুক ফেটে যায়। বিভিন্ন দোকানে পণ্যসামগ্রীকে যেভাবে সাজিয়ে রাখা হয় ক্রেতাদের আকর্ষণের জন্য, ঠিক একইভাবে নারীদেরকেও পণ্যের মতো উপস্থাপন করা হচ্ছে। ঘরে বসে টেলিভিশন দেখুন বা বাজার করতে যান, সর্বত্রই যেন নারীরা আজ পণ্যে রূপ নিয়েছে। অথচ এই নারীর গর্ভেই জন্ম নেবে আগামী দিনের দেশ পরিচালনাকারী।
একজন নারী তখনই আদর্শ মা হবেন, যখন আমরা সবাই তার মর্যাদা দেব। শুধু একদিন নারীদের অধিকার বা মর্যাদার কথা উল্লেখ করাতেই কি মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়? না, বরং এর জন্য প্রয়োজন প্রতিটি দিন, প্রতিটি সময়, প্রতিটি ঘরে তাদের মর্যাদা ও সম্মানের বিষয় নিয়ে ভাবা এবং তাদের সঙ্গে সেই ধরনের উত্তম আচরণ করা। আর এ কাজ প্রথমে নিজ পরিবার থেকে শুরু করা যেতে পারে।
নর-নারী এ দুয়ের সমন্বয়ে মানবগোষ্ঠী। নারী কাজে ও চিন্তায় পুরুষের সঙ্গিনী। পুরুষের আনন্দক্ষণে খুশির বার্তাটুকু জানানোর জন্য আর তার দুঃখের মুহূর্তে তার বেদনায় সহানুভূতি জানানোর জন্যই নারী।
নারী জীবনের আবাহন, পুলকের সংগীত, পবিত্র স্নেহ-মমতার প্রতীক, বিশ্ব নিখিলের প্রাণ-স্পন্দন। বিশ্বের যত বড় বড় ব্যক্তি, তারা সবাই নারীর গর্ভে অস্তিত্ব লাভ করেছে, নারী কর্তৃক প্রসবিত এবং নারীর ক্রোড়েই লালিত-পালিত হয়েছে। মানবজাতির মর্যাদা বাড়িয়েছে নারী, গোটা মানবতাই নারীর কাছে ঋণী।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ আমরা গভীরভাবে স্মরণ করি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে। যিনি বাঙালি নারী জাগরণ ও নারীর অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে নারী-পুরুষের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে বেগম রোকেয়া প্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন। তিনি বাঙালি মুসলমানদের নবজাগরণের সূচনালগ্নে নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণে নেতৃত্ব দেন। আমরা স্মরণ করি জাহানারা ইমামকে। বাঙালি জাতির যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে আলোর মশাল হাতে পথ দেখিয়েছেন তিনি। তার হাতে গড়া গণআদালতের মাধ্যমেই বাংলাদেশে শুরু হয় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া।
আমরা আরও স্মরণ করি বীরকন্যা প্রীতিলতাকে। যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাঙালি নারীর সাহসের বাতিঘর ছিলেন। অগ্নিযুগের বীরকন্যা প্রীতিলতা যুগে যুগে বাংলার নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।
হায়! বড়ই আফসোস হয় যখন শুনি নারীর গায়ে আগুন, শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা, কেরোসিন ঢেলে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া এবং গাছে বেঁধে নির্যাতনের খবর।
তাই আর নয় নারীর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন। নারীর প্রতি এমন কোনো অমানবিক আচরণ যেন আমরা না করি, যা আমাকে সৃষ্টিকর্তার সামনে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজ ও দেশ।
মাহমুদ আহমদ ।। গবেষক ও কলামিস্ট