জনগণের টাকায় আনন্দ উল্লাস!
মাস চারেক আগেও যে টাকায় বাচ্চাদের দুধের প্যাকেট কেনা যেত ওই টাকায় এখন আর কেনা যায় না। প্যাকেট প্রতি দাম বেড়েছে ষাট থেকে সত্তর টাকা। একটি বহুল পরিচিত কোম্পানির এক কেজি ডিটারজেন্ট পাউডার মাস দুয়েক আগেও ১১০ টাকায় কেনা গেছে; অথচ এখন ১৮০ টাকা।
জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধের দামও বেড়েছে। ডায়াবেটিস, লিভার, ক্যান্সারের ওষুধের দাম আগের চেয়ে চড়া। দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ে হরহামেশা প্রতিবেদন হলেও এসব পণ্য ও ওষুধের দাম বাড়ার বিষয়টি আড়ালেই থেকেছে।
কেবল চাল-ডাল, আটা, তেল, মাছ, মাংস, শাক-সবজির দাম বাড়েনি, মানুষের অতি প্রয়োজনীয় অনেক কিছুর দাম বেড়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে দেশের অবস্থা কেমন, তা জানতে সংবাদমাধ্যমে চোখ না রাখলেও আপনি আন্দাজ করতে পারবেন।
আরও পড়ুন : বৈশ্বিক সংকট : দরকার মুদ্রানীতি ও বাজেটের যথাযথ সমন্বয়
ছয় মাস আগে যে টাকায় সপ্তাহের বাজার হতো তা এখন আর হয় না। ওই টাকায় বাজারের থলের অর্ধেক বাজার হয়। ছয় মাস আগে তেল-নুন-চালের দাম যা ছিল তা বেড়েছে ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত। গণমাধ্যম যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে বলে প্রতিনিয়ত খবর প্রকাশ করে এর বাইরেও অনেক কিছুর দাম বেড়েছে।
দেশে অর্থনৈতিক সংকটের বিষয় এখন আর গোপন করার কিছু নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমেছে। সংকট ডলারের। সরকারই বলেছে মন্দা চলছে। মন্দা চলছে বলেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। নানা কঠিন শর্ত দিয়ে আমাদের ঋণ দিচ্ছে আইএমএফ। তবুও আমরা ঋণ নিচ্ছি। এছাড়া আমাদের উপায় নেই।
ছয় মাস আগে তেল-নুন-চালের দাম যা ছিল তা বেড়েছে ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত। গণমাধ্যম যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে বলে প্রতিনিয়ত খবর প্রকাশ করে এর বাইরেও অনেক কিছুর দাম বেড়েছে।
অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে সরকার ব্যয় কমাতে বলছে। সে অনুযায়ী অফিসের সময়সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। অফিসে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে বলা হয়েছে।
ব্যয় কমাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। কিন্তু কে শোনে কার কথা, বিদেশ সফর চলছেই। বর্তমান মন্ত্রিসভায় রয়েছেন ৪৮ জন সদস্য। এর মধ্যে পূর্ণ মন্ত্রী ২৫, প্রতিমন্ত্রী ২০ ও উপমন্ত্রী আছেন তিনজন।
আরও পড়ুন : আইএমএফের ঋণ : ইতিহাস যা বলে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ও মন্ত্রীদের ভ্রমণসূচি ঘেঁটে দেখা যায়, প্রায় অর্ধেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা নানা অজুহাতে এই সংকটের সময়ও বিদেশ সফরে গেছেন।
পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে- চাল কিনতে তিন দেশে গেছেন মন্ত্রী-সচিব। মন্ত্রী-সচিবসহ ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড সফরে গেছেন। ভিয়েতনাম থেকে চাল কেনা হচ্ছে বেশি দামে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম সফরের খরচ বহন করছে ওই দেশের সরকার। আর বাকি দুটি দেশ সফরের খরচ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার (প্রথম আলো, ২৯ নভেম্বর ২০২২)।
এদিকে গর্ত ভরাট যন্ত্র দেখতে এক এমপি গেছেন বিদেশে, এমন খবর দিয়েছে দৈনিক সমকাল (২৪ নভেম্বর ২০২২)।
দেশে যখন অর্থনৈতিক সংকট চরমে তখন নানা অজুহাতে বিদেশ সফর করছেন আমাদের মন্ত্রী-আমলারা। সরকার দুই দুইবার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পরিপত্র জারি করার পরও এ ঘটনা ঘটছে।
দেশে আইনের শাসন যে নেই, তা বলা যায় না। গরিবের জন্য আইনের শাসন জোরালোভাবে প্রয়োগ হয়। না হলে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণের জন্য ১২ কৃষককে জেলখানায় যেতে হতো না। ২৪ নভেম্বর পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগে করা একটি মামলায় ৩৭ জন কৃষকের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ১২ জন প্রান্তিক কৃষককে গ্রেপ্তার করে জেলখানায় পাঠায় পুলিশ।
আরও পড়ুন : অর্থনৈতিক মন্দার শিকড় কোথায়?
আইনের এমন প্রয়োগ আমরা রাঘব বোয়ালদের বেলায় খুব একটা দেখি না। পঁচিশ-ত্রিশ হাজার টাকার ঋণের মামলায় কৃষক জেলে যায় আর হাজার হাজার কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে যারা ঋণ নিয়ে মেরে দেন তাদের বেলায় আইনের শাসন কোথায় থাকে?
সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিকে এসেছে চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি প্রভাবশালী কোম্পানি বেসরকারি এক ব্যাংক থেকে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় ঋণ নিয়েছে তা স্বচ্ছ নয় বলা হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাগুজে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ঋণ নেওয়ার খবর আমরা দেখেছি। এসবের শেষ পরিণতি আসলে কী?
ব্যয় কমাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বিদেশ সফর থেমে নেই।
বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি মামলার বিষয়টি আমরা জানি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ব্যাংক থেকে ঋণের নামে যে টাকা লোপাট হয়েছে তাতে ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু দায়ী। কিন্তু বাচ্চুর কী হয়েছে? কিছুই না। দুদকের কাছেও বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রতিবেদন আছে। যেখানে জালিয়াতির সব প্রমাণ রয়েছে। অথচ সাত বছর ধরে দুদক এর তদন্তই শেষ করতে পারেনি। বাচ্চু কিংবা বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কিছুই করতে পারেনি দুদক।
একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ব্যাংক থেকে টাকা তছরুপ হওয়া মানে ওই ব্যাংকের অর্থ লোপাট হওয়া নয়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি ব্যাংক জনগণের আমানতের টাকায় চলে। জনগণের আমানতের টাকায় ব্যাংক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়। সেই ঋণের টাকা যখন লোপাট হয়ে যায় তখন সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা হুমকিতে পড়ে।
আরও পড়ুন : সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি!
অনেক তো হলো, সরকারের এবার উচিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া। নানা ফন্দি-ফিকিরে সরকারি অর্থে মন্ত্রী-আমলাদের বিদেশ সফর বন্ধ করতে হবে। জনগণের করের টাকায় কর্তারা আরামে বিদেশ সফর করবেন; ভালো জায়গায় থাকবেন, খাবেন, ঘুরবেন- এটা অর্থনৈতিক সংকটে থাকা জনগণ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে না।
এই মুহূর্তে ব্যাংকিং খাত, সেবা খাতে সুশাসন ফেরানো জরুরি। মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ হলে সচল হবে দেশের অর্থনীতির চাকা। কেবল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার ওপর দায় চাপানোর সুযোগ নেই।
আদিত্য আরাফাত ।। বিশেষ প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ