আন্দোলনের ডামাডোলে থাকুক শান্তির বারতা
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের খুব বেশি সময় বাকি নেই। কিন্তু চারপাশে ধুন্ধুমার স্বরে বাজছে নির্বাচনের ঢোল। রাজপথের আন্দোলনের পালে জোর বাতাস লাগানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। মূলত ২২ আগস্ট থেকে একের পর এক ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে দলটি। এই করতে গিয়ে ভোলায় দুই কর্মীর মৃত্যু হয় তাদের।
এরপর নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ এবং সবশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরসহ আরও কয়েকটি জায়গায় বেশকজন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম দিয়ে শুরু হওয়া বিভাগীয় সমাবেশ প্রায় শেষের পথে। ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী বিভাগে তাদের গণসমাবেশ। এরপর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে এই ধাপের কর্মসূচি শেষ হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে ঢাকার সমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে তারা।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায় বিএনপির এই আন্দোলনের দাবিগুলো ছিল পণ্যের অতিমূল্য, গুম খুনসহ আরও কয়েকটি দাবির পর তারা বলছিল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সব ছাপিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন তাদের প্রধান দাবি।
আরও পড়ুন : ক্ষমতাবানদের পেছনে গড্ডলিকা
এমনকি নেতাদের বক্তৃতা শুনলে একমাত্র দাবিও মনে হতে পারে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে একটু বিশদ বলতে চাই। এই দেশে সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচন হয়েছে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে—যেখানে বিএনপি ৩০টির মতো সিট পেয়ে প্রধান বিরোধীদলের আসনে বসে।
এরপর আদালতের নির্দেশে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হয়। যদিও আদালত বলেছিলেন—সংসদ চাইলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংসদ তা মনে করেনি।
বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ফেরত আনতে পারেনি, নির্বাচনও ঠেকাতে পারেনি। উপরন্তু ২০১৩-২০১৫ সালের তিন বছরের জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে মারা গেছেন বহু মানুষ, আহত হয়েছেন অনেকে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। তবুও তত্ত্বাবধায়ক ফেরানোর জন্য বিএনপি আন্দোলন করেছে। লাগাতার হরতাল অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে দেশজুড়ে। জ্বালাও পোড়াও সন্ত্রাস হয়েছে দেশজুড়ে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে বালুর ট্রাক দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে তার গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে। কার্যত বেগম জিয়ার সঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পুরোটাই আটকে ছিল গুলশান কার্যালয়ে। এদিকে অবরোধের আগুনে পুড়ছে পুরো দেশ। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বাসে পেট্রোল বোমা ছোঁড়ার ঘটনা ঘটেছে। আগুনে পোড়া মানুষের আর্তনাদে ভারি হয়েছে হাসপাতালের বাতাস। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট উপচে পড়ছে আগুনে পোড়া মানুষে।
অন্যদিকে প্রায় প্রতিদিন গুলশান কার্যালয়ে গণমাধ্যমে আন্দোলনের আপডেট দিতেন বিএনপি নেতারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
আরও পড়ুন : জনপ্রতিনিধি নাকি জনপ্রিয় প্রতিনিধি?
এত আগুন, এত মৃত্যুর পরেও এক সপ্তাহ করে বাড়ানো হচ্ছিল অবরোধ। এভাবে কয়েক মাস চলার পর একটি প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে অবরোধের সমাপ্তি টানা হয়। এদিকে বিএনপিকে ছাড়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যায়।
বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ফেরত আনতে পারেনি, নির্বাচনও ঠেকাতে পারেনি। উপরন্তু ২০১৩-২০১৫ সালের তিন বছরের জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে মারা গেছেন বহু মানুষ, আহত হয়েছেন অনেকে। এক পর্যায়ে জ্বালাও পোড়াও অগ্নি সন্ত্রাসের দায় বিএনপি অস্বীকার করলো। এখনো করে।
বিএনপির ভাষ্য তাদের আন্দোলনে স্যাবোটাজ হয়েছে। সরকার দলীয় লোকজন আগুন সন্ত্রাস করে বিএনপির ঘাড়ে দায় চাপিয়েছে। কিন্তু যখন তাদের অবরোধ চলছিল, দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর বোমাবাজি এবং আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটছিল—তখন তো বিএনপি বলেনি আমাদের আন্দোলনে স্যাবোটাজ হচ্ছে।
আমাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে অন্য কেউ গুলি ফুটাচ্ছে। বরং তাদের প্রতিদিনের ব্রিফিংয়ে এগুলোর প্রতি এক ধরনের প্রশ্রয়মূলক বক্তব্য ছিল। আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়ার দুয়েক বছর পর থেকে বিএনপি বলছে—আমাদের আন্দোলনে অন্য কেউ আলু পোড়া দিয়েছে। এই বক্তব্য কি এখন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল। যেটি আমরা অনেকেই ভুলে গেছি। তৎকালীন প্রধান বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করে সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলন সরকার প্রধান। তাতেও সাড়া দেয়নি বিরোধীদল হরতালের অজুহাত দেখিয়ে। এছাড়া সেই সময় কোন ধরনের বাক্য বিনিময় হয়েছিল সেটিও পরে শুনেছে দেশের মানুষ।
এবার আসি ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় বিএনপি, সেই দাবির মধ্যে অটল থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলো। বেগম জিয়ার অনুপস্থিতিতে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে জোট করলো বিএনপি। ফলাফল হলো অতি খারাপ।
আরও পড়ুন : রাজনীতি কি মরণ খেলা?
বিএনপির ভাষায় দলীয় ২০১৮ সালে তারা নির্বাচনে গিয়ে এবং ২০১৪ সালে না গিয়ে প্রমাণ করেছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু হতে পারে না। হ্যাঁ ২০১৮ সালের নির্বাচন ভালো হয়েছে একথা কেউ বলেন না। এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেও এই নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের চাপা অস্বস্তি রয়েছে। যদিও সেটি তারা মুখে স্বীকার করেন না।
এইসব মাথায় রেখে বিএনপি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েমের আন্দোলন জোরদার করেছে। বলছে যেকোনো মূল্যে তত্ত্বাবধায়ক আদায় করা হবে। এখানে কিছু যদি কিন্তুর প্রশ্ন এসে যায়। কোন পন্থায় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক আদায় করবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরতে হলে সংসদে বিল আনতে হবে। সেই বিল বিএনপিও আনতে পারে—সাতজন সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি দলের মাধ্যমেও। কিন্তু সেই বিল পাস করতে হলে সরকার দলীয় সংসদ সদস্যদের সমর্থন লাগবে। এখন কথা হলো সরকার কেন তাতে সমর্থন দেবে, অথবা নিজেরা সেই বিল আনবে?
বিএনপির ভাষায় দলীয় ২০১৮ সালে তারা নির্বাচনে গিয়ে এবং ২০১৪ সালে না গিয়ে প্রমাণ করেছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু হতে পারে না।
বিএনপি কি এখনো পর্যন্ত আন্দোলন সেই মাত্রায় নিতে পেরেছে যাতে সরকার বাধ্য হবে তত্ত্বাবধায়কে ফিরতে? প্রশ্ন আরও আছে- তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরায় বহাল করার। কিন্তু তাহলে আদালতের রায়ের কী হবে? সেই রায় বাতিলের জন্য এখন পর্যন্ত কেউ একটি রিভিউ আবেদন করে রেখেছে—এমনটা তো নয়। তাহলে উপায়?
রাজনীতির মাঠ এখন গরম ১০ ডিসেম্বর নিয়ে। এদিন ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ করার কথা। এরই মধ্যে সরকারের তরফে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিএনপি বলছে, সোহরাওয়ার্দী নয়, নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনেই সমাবেশ করবে তারা। একটা বিষয় খেয়াল করা যাক—এর আগে বিভিন্ন সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চেয়েছে বিএনপি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তখন অনুমতি দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন : সহমতের রাজনীতি
এখন যেহেতু না চাইতেই সোহরাওয়ার্দী দেওয়া হয়েছে বিএনপির মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। আবার উল্টো যুক্তিও দেওয়া যায়। এতদিন সরকার দেয়নি, এখনতো দিচ্ছে। তাহলে সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশ করতে আপত্তি কোথায়?
যদিও এখনো দুই পক্ষই অনড়। বিএনপি বলছে নয়াপল্টনেই হবে সমাবেশ। সরকার বলছে, সমাবেশ করলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই করতে হবে। তবে আমার মনে হয় ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ হবেই। এক্ষেত্রে দুই পক্ষ মিলে নিশ্চয় একটি উপায় বের করবেন।
উপরে একটি প্রশ্ন রেখে এসেছিলাম—তত্ত্বাবধায়ক প্রসঙ্গে ‘তাহলে উপায়?’ আমার মনে হয় আওয়ামী লীগ বিএনপি মিলেই একটা উপায় বের করবে। এবং বিএনপি অবশ্যই আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে।
তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে আর ফিরছে না এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারো কাছে হয়তো এটি অতি আগাম মন্তব্য মনে হতে পারে।
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি