মধ্যবিত্তের নতুন আতঙ্ক বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি
পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯.৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। মূল্য বৃদ্ধির এই ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল। পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) রিভিউ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এই সিদ্ধান্ত নেয়। পাইকারি পর্যায়ে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ টাকা ২২ পয়সা, যা আগে ছিল ৫ টাকা ১৭ পয়সা।
ক্যাবের এক জরিপে দেখা গেছে, ১০ বছরে জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১২৫ শতাংশ, কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম যেভাবে হু হু করে বেড়ে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে, সেখানে ১৭ কোটি সাধারণ জনগণের স্বার্থ চিন্তা না করে বিদ্যুতের আর এক দফা মূল্য বৃদ্ধি প্রস্তাব অযৌক্তিক।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, ভর্তুকি হ্রাসের অজুহাতে আকস্মিকভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, পাইকারি পর্যায়ে ১৯.৯২ শতাংশ দাম বাড়ানোর ঘোষণা, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি চলমান জীবনযাত্রার মূল্য বৃদ্ধি মধ্যবিত্তসহ সাধারণ জনগণের জীবন যাপনে নিত্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্য সামগ্রী ও জীবন যাত্রার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা নিত্য প্রয়োজনীয় সবো ধরনের দ্রব্যসমাগ্রী ও সেবা সার্ভিসের আরেক দফা আগুন ধরাবে।
আরও পড়ুন : মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা
বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি পাগলা ঘোড়া বাজারে আগুন ছড়াচ্ছে যা মধ্যবিত্ত জনগণসহ সর্বস্তরের সাধারণ নাগরিকদের জীবন যাত্রা ভয়াবহ দুর্বিষহ করছে, সাধারণ মানুষ এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের সীমাহীন মূল্য বৃদ্ধি, গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি, বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ইত্যাদি যন্ত্রণায় কাতর, সেখানে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি এই যন্ত্রণা বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে।
বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। শিল্প কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন এবং ফিনিশিড প্রোডাক্টস’র মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ কার্যকর ভূমিকা রাখে বিধায় এসব উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি যেভাবে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় মারাত্মক নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, ঠিক একইভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণেও জনজীবনে অস্থিরতা বাড়াবে।
কিন্তু বিদ্যুতের দাম ফের বৃদ্ধি মধ্যবিত্তসহ সব মানুষের জন্য আরেকটি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একদিকে বেশ কিছুদিন ধরেই মানুষ বিদ্যুৎ ঠিকমতো পাচ্ছে না। আবার নতুন করে দাম বাড়ানোর কারণে সাধারণ মানুষের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আর্বিভূত হবে এই দাম বৃদ্ধি।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি যেভাবে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় মারাত্মক নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, ঠিক একইভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণেও জনজীবনে অস্থিরতা বাড়াবে।
আরও পড়ুন : বিদ্যুৎ সংকট : সমাধান হবে কবে?
নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ যখন দিশেহারা, ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানোর ফলে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রস্তাব তৈরি করবে বিতরণ কোম্পানিগুলো। আর বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যমূল্য এবং সেবার মূল্য আরও বেড়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্গতির আর একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
বিগত সরকার যেভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় ভোক্তাদের বিষয়টি চিন্তা না করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিবর্তে ২০০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন। বর্তমান সরকারও পূর্বের ধারা অব্যাহত রেখে পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সংস্কার না করে ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, রেন্টাল পাওয়ারের জন্য শুল্কমুক্ত জ্বালানি আমদানি সুবিধা প্রদান, স্লাব নির্ধারণের নামে বিপুল অর্থ আদায়, বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ না করে, সেবার মান না বাড়িয়ে জনগণের উপর মূল্য বৃদ্ধির যন্ত্রণা চাপিয়ে দিয়ে পূর্বসূরির ধারা অব্যাহত রেখেছেন, এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
এদিকে জ্বালানি সংকটের কারণে শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়লে বিদ্যুৎ চালিত কারখানা চালানোই কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
আরও পড়ুন : লোডশেডিং : এত বিপর্যয় কেন?
দ্রব্যমূল্য সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যমূল্য আরও বেড়ে যাবে। জনগণের জীবন জীবিকার খরচ বাড়বে। শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। যার চূড়ান্ত ফল মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।
বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনায় আছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো। আর সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
অথচ কিছুদিন আগেও এই ধরনের প্রস্তাব নাকচ করেছিল বিইআরসি। সেই সময় দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভালো না থাকায় এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সরকারের ওপর মহল আগ্রহ না থাকায় দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে সায় দেয়নি। শীতের শুরুর কারণে এখন বিদ্যুতের লোডশেডিং সেভাবে নেই। পাশাপাশি আইএমএফের চাপ রয়েছে।
সকলের আশঙ্কা বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব ধরনের পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়বে। এর আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় পণ্যমূল্য, গণপরিবহনের ভাড়া দফায় দফায় বেড়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে শিল্প উৎপাদনে খরচ বাড়বে, বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের জ্বালানি খাতে খরচ বাড়বে।
আরও পড়ুন : লোডশেডিং : সাশ্রয়েই সমাধান?
মানুষ এমনিতেই নিত্যপণ্য, বাসা ভাড়া, সন্তানের লেখাপড়া, চিকিৎসা খাতের খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু খরচের পাল্লা দিন দিন বাড়ছে। একটা সময় সরকারি অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবিরা সঞ্চয়পত্রের লাভ দিয়ে সংসার চালাতেন এখন সেখানেও লাভ কমানো হয়েছে নানা অজুহাতে।
অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স, ভ্যাট, আয়করসহ নানা কারণে সরকারি করারোপের কারণে আগামী জানুয়ারি থেকে ঘরভাড়া বাড়বে।
দ্রব্যমূল্য সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যমূল্য আরও বেড়ে যাবে। জনগণের জীবন জীবিকার খরচ বাড়বে। শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যয় বাড়বে।
শিল্পে উৎপাদন খরচ বাড়লে তারা পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়াবে। আর একারণে মধ্যবিত্তসহ সীমিত আয়ের মানুষ পড়বে আরেক দফা চরম দুর্ভোগে। বিদ্যুৎ চালিত কলকারখানায় জ্বালানি সংকটের কারণে কলকারখানায়ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দাম বাড়লে কৃষিতে সেচ প্রদান ও কলকারখানায় উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
আমাদের টালমাটাল বাজার ব্যবস্থা এমনিতেই অস্থিরতার শেষ নেই। বিদ্যুতের দাম বাড়ার অজুহাতে আবার টালমাটাল হতে পারে গোটা বাজার ব্যবস্থা। জানা যায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করে। ১৮ মে তাদের প্রস্তাবে ওপর গণশুনানি হয়।
আরও পড়ুন : মেগা প্রকল্প, উচ্ছেদ ও কর্মসংস্থানের ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতি
শুনানিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটি ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করে। প্রায় ৫ মাস পর ১৩ অক্টোবর এক ঘোষণায় বিইআরসি জানায়, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ও যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারায় পিডিবির আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বারবার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমানোর কথা বলছেন বেশ কিছুদিন ধরেই। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের জন্য বিদ্যুৎ খাতে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বিবেচনা করে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯.৯২ শতাংশ বাড়নো হয়েছে।
তবে জ্বালানি খাতে ভোক্তা আন্দোলনের বিশেষজ্ঞদের মতে গণশুনানি ছাড়া বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আদেশ আইনসম্মত নয়। আর বিগত গণশুনানির আদেশ যেহেতু দেওয়া হয়েছিল আর সেই আদেশের ওপর পিডিবি আপিল করেছিল। তাই নতুন করে এই আপিল শুনানি ছাড়া দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বিইআরসি দিতে পারে না।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)