দলাদলি নয় গলাগলি হোক
জাতীয় নির্বাচনের আগেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনীতির ময়দান। বড় দুই দলের নেতারা জড়িয়েছেন বাকযুদ্ধে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতাদের আক্রমণাত্মক বক্তব্যে বাড়ছে উত্তেজনার পারদ।
সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, তাদের আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাসীনরা ‘পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।’ জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতাদেরই বিদেশে ‘পালানোর ইতিহাস রয়েছে।’
আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, পনেরো বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এবার নির্দলীয় সরকারের দাবিতে তাদের নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতে পেরেছে। ঢাকার বাইরেও বড় জমায়েতে কর্মসূচি পালন করেছে দলটি।
আরও পড়ুন : নূর হোসেন : আমাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মার প্রতিশব্দ
গত নির্বাচনের একমাস আগেও বিএনপি যেখানে তেমন বড় জমায়েত দেখাতে পারেনি সেখানে এবার নির্বাচনের একবছর আগেই বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক জনসমাগম দেখিয়েছে। সাম্প্রতিক আওয়ামী লীগের সমাবেশগুলোয় অবশ্য জনসমাগম কম ছিল না।
বিএনপি এরমধ্যে ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে স্মরণকালের বড় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এসেছে, ১০ তারিখ ঘিরে নানা কর্ম পরিকল্পনা ঠিক করেছে দলটি।
ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকলে কোনোভাবেই আর নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি, এমন কথাই এখন হরহামেশা বলছে দলটির শীর্ষ নেতারা।
বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, ১০ ডিসেম্বর তাদের দলের প্রধানের কথায় দেশ চলবে। এমন কথা তিনি জোশে নাকি অন্য কোনো কারণে বলেছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে এমন হুঙ্কারের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলটির প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আসছে ডিসেম্বরে বিএনপিকে মাঠেই থাকতে দেওয়া হবে না। রাজপথ আওয়ামী লীগের দখলে থাকবে বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডিসেম্বর ঘনিয়ে আসছে। বড় দুই দলের যে বাকযুদ্ধ দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, মাঠ দখলে রাখতে হলে সংঘাত অনিবার্য। কেউ কাউকে ছাড় না দিলে সংঘাত ছাড়া আর উপায় কি!
আরও পড়ুন : রাজনৈতিক পাপের উৎস সন্ধানে
গত নির্বাচনের আগে বিএনপি শেষ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করেছে। এবার কোনোভাবেই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলছে। দলটি কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আবার কখনো নির্দলীয় সরকারের কথা বলছে।
মোদ্দাকথা, ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকলে কোনোভাবেই আর নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি, এমন কথাই এখন হরহামেশা বলছে দলটির শীর্ষ নেতারা।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। আর সেই অনুযায়ী নির্বাচন হলে দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচনের সুযোগ নেই। বড় দুই দলের মুখোমুখি এমন অবস্থান তাতে রাজনীতির আকাশে কালো মেঘই দেখা যাচ্ছে।
দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি স্পষ্টতই ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-পরবর্তী অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। সেই সময় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কথার লড়াইয়ের পর সংঘাতে জড়ায় দুই পক্ষ। এতে ঝরে বহু প্রাণ, সম্পদহানি ছিল ব্যাপক।
আরও পড়ুন : রাজনৈতিক দলের রাজনীতি
দুই পক্ষই আবার অনড় অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়ার পর প্রায় এক দশক আগের অচলাবস্থা ফিরে আসছে কি না, নাকি আগের চেয়েও জটিল কোনো পরিস্থিতি হবে, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এখন কেবল কথার লড়াইয়ে সীমিত নয়। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানি হয়েছে। কয়েকটি জেলায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অস্ত্র হাতে শোডাউনও দেখা গেছে। নির্বাচনের এত আগে অস্ত্র হাতে শোডাউন নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি মনে হচ্ছে জটিল রূপ পাচ্ছে। এটা পরিস্থিতি বিবেচনায় আন্দাজ করেই বলা। এমন পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের কি হবে? কী হতে যাচ্ছে? দেশের মানুষের মনেই নানা শঙ্কা।
করোনার ধাক্কা কিছুটা সামলে ওঠার পর এরমধ্যে অর্থনীতিতে আবার মন্থর গতি বিরাজ করছে। রিজার্ভ কমে গেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
আরও পড়ুন : বিএনপির লবিং এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রমাণ
একাধিক গণমাধ্যম তাদের নিজস্ব প্রতিবেদনে বলেছে, মানুষ এখন আগের চেয়ে কম খাচ্ছে। এতে পুষ্টিমানও ঠিক থাকছে না। অন্যদিকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়েছে। সঞ্চয়পত্রের উপর নির্ভরশীল মানুষের উপরও একের পর অশনি সংকেত।
কয়েকবছরে সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমেছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ায় শর্ত দিয়েছে যে, সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমাতে হবে। মুনাফার হার আরও কমলে সঞ্চয়পত্রের উপর নির্ভরশীল মানুষের কী অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত জটিল হবে, তার বলি হতে থাকবে সাধারণ মানুষ। অতীতেও দেখা গেছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্ধের শিকার হন জনগণ।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত জটিল হবে, তার বলি হতে থাকবে সাধারণ মানুষ। অতীতেও দেখা গেছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্ধের শিকার হন জনগণ।
প্রশ্ন আসে, আমাদের দেশের এমন রাজনৈতিক সংকটের সমাধান কে করবে? বিদেশ থেকে কেউ এসে বড় দুই দল আলোচনার টেবিলেও বসাবে না।
প্রভু দেশগুলো অপেক্ষাকৃত অর্থনৈতিক দুর্বল দেশগুলোর সমস্যায় কিছু বিবৃতি দিলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তারা হয়তো ভাবে, সংকট যত ঘনীভূত হয়, তত মোড়ল দেশগুলোর কদর বাড়ে। আদতে তাই দেখা যায়।
আরও পড়ুন : বিএনপি চা খেতে যাক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে
রাজনৈতিক সংকট আমাদের। সমাধানও আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর করতে হবে। সমাধান না হলে বিপদে পড়বে দেশের মানুষ। কারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িত দেশের অর্থনীতি।
রাজনৈতিক সংকট জটিল করে অর্থনীতি। তাতে ব্যাহত হয় মানুষের জীবনযাত্রা। এমন সংকট কাটিয়ে উঠতে রাজনৈতিক নেতাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
এক দল আরেক দলকে ছাড় না দেওয়ার হুঙ্কার সংকট আরও বেশি ঘনীভূত করবে। এমন পরিস্থিতি ছড়িয়ে পড়লে নির্বাচনকে ঘিরে বাকযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে সংঘাতে। এই অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোরও দেশের মানুষের জানমালের স্বার্থে ঐক্যমতে পৌঁছাতে হবে।
কেবল মাঠ দখল করে শক্তি প্রদর্শন করলে সমস্যার সমাধান হবে না। দেশের মানুষ ভালো না থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো কাদের নিয়ে রাজনীতি করবে?
মানুষের জন্যইতো রাজনীতি। দেশ আমাদের। রাজনৈতিক সংকটও আমাদের দেশের। সমাধানও আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর করতে হবে।
আদিত্য আরাফাত ।। সাংবাদিক