বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি : সংকট দূরীকরণে সদিচ্ছা কতখানি?
বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী, ছোট পর্দা, বড় পর্দার অনেক অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রী সুযোগ পেলেই বিদেশে স্থায়ী হচ্ছেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে অধিকাংশই বিদেশে স্থায়ী হচ্ছেন। অথবা টাকা থাকলে দেশের টাকা বিদেশে নিয়ে ইনভেস্টমেন্ট পলিসিতে গিয়ে স্থায়ী হচ্ছেন।
একটা দেশে যখন অন্যায়, দুর্নীতি, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা বাড়ে তখন শিল্পী, সাহিত্যিক ও উচ্চ শিক্ষিতরাই প্রতিবাদ জানায়। এদের চলে যাওয়ার ফলে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়ে পড়ছে, দেশের সাহিত্যাঙ্গন দুর্বল হচ্ছে, দেশের শিক্ষা ও গবেষণার মান দুর্বল হচ্ছে। কেন তারা বিদেশে চলে যাচ্ছেন?
এর মূল কারণ দেশে ভালো মানের শিক্ষাব্যবস্থা নেই, স্বাস্থ্যব্যবস্থা নেই, নিরাপত্তা নেই, ভালো ইনস্যুরেন্স পলিসি নেই। তাহলে তারা থাকবে কেন? কিন্তু তবুও তাদের থাকার দরকার ছিল। এইসব প্রতিবাদী মানুষগুলো থাকলে অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেওয়া যেত।
আরও পড়ুন : বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কেন উন্নত হচ্ছে না?
যাদের এক সময় বড় শিল্পী, বড় অভিনেতা ভাবতাম তারা সব এখন বিদেশে। বিদেশে গিয়ে কি করছেন? খুবই মামুলি চাকরি করছেন। দেশে তারকা খ্যাতি, অর্থ সবকিছু থাকা সত্ত্বেও বিদেশে ওই ছোট চাকরিই শ্রেয় মনে করছেন।
আসল কথা হলো, একটা সুশৃঙ্খল জীবন সবাই চায়। সবাই চায় তাদের সন্তান লেখাপড়ার ভালো পরিবেশ পাক, দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠুক, অসাম্প্রদায়িক দেশে যেন সন্তানের মনন গড়ে উঠুক। তা কি আমাদের দেশে আছে? নেই। তাহলে তারা কেন বিদেশে যাবে না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলেও প্রায়ই দেখা যায় বিশাল বিশাল রাজনৈতিক ব্যানার। এইরকম চিত্র কি বাংলাদেশ ব্যতীত বিশ্বের আর কোথাও পাবেন?
গণমাধ্যমে কয়েকদিন আগে দেখলাম, ইডেন কলেজের ছাত্রনেত্রীর দখলে আবাসিক হলের ৯০টি রুম। সেখানকার রুম ভাড়া দিয়ে মাসে ২০ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা আয় হয় তাদের। এখন বুঝতে পারছেন হলে হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে এত হট্টগোল কেন?
সব টাকা। এখন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় বলে ছাত্রলীগ এই কাজ করছে। আওয়ামীলীগের জায়গায় বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল ঠিক একই কাজ করবে। পুরো সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে।
ক্ষমতায় থাকার জন্য আমাদের রাজনীতিবিদরা সব সুনীতি বিসর্জন দিয়ে যা কিছু করলে ক্ষমতায় থাকা যাবে তাই করে যাচ্ছে। ছাত্রদের তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। বিনিময়ে ক্ষুদকুড়া ছিটাচ্ছে।
ছাত্ররা হলো নিচের তলায়। যত উপরে যাবেন টাকার পরিমাণ ততই বেশি। এমনি কী আর ১ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের খরচ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি? এই দেশ পচে গলে গিয়েছে একদম। সেই জন্যই কেউ দেশে থাকতে চায় না। দেশে যারা পড়ে আছে সেটা কেবল সুযোগের অভাবে।
আরও পড়ুন : বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং ও বিজ্ঞান শিক্ষার মান
ছাত্ররাজনীতি বলেন আর দলীয় রাজনীতি, সবই বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। এই বিষ সবার প্রথমে গ্রাস করছে শিক্ষার্থীদের। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি যদি দুষ্ট জাতীয় রাজনীতি গ্যাঁড়াকল থেকে মুক্ত করা যেত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর লেখাপড়ার জন্য আদর্শ পরিবেশ গড়ার সুযোগ তৈরি হতো।
কিছুদিন আগে ঢাকার বাইরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি প্রতিটা ভবন রাজনৈতিক ব্যানার আর পোস্টারে ভরা। ব্যানারে-পোস্টারে ভবনের চেহারা দেখা যায় না।
আমি যখন লেকচার দিচ্ছিলাম তখন ঢাকা ঢোল পিটিয়ে বিরাট মিছিল দেখলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলেও প্রায়ই দেখা যায় বিশাল বিশাল রাজনৈতিক ব্যানার। এইরকম চিত্র কি বাংলাদেশ ব্যতীত বিশ্বের আর কোথাও পাবেন? বিশ্বের ভালো কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক ব্যানার-পোস্টার দেখা যায় না।
এছাড়া ইডেন কলেজসহ দেশের নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী ঘটছে তা একটু খোঁজ নিলে দুঃখে মন বিষিয়ে ওঠে। মনে হয় যেন আমাদের আগামী প্রজন্ম সম্পূর্ণ ধ্বংস করার জন্য একজন স্থপতি নিখুঁতভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্বের অন্য দেশের মতো আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরাও যদি ছাত্রদের জন্য আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করতো তাহলে শিক্ষকদের অনেক কর্মঘণ্টা বেঁচে যেত।
আরও পড়ুন : বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯টি আবাসিক হল আছে। তার মানে ১৯জন প্রভোস্ট এবং কমপক্ষে ১০০জন আবাসিক শিক্ষক এই হলগুলো পরিচালনা করেন। এটি পুরোপুরি নন-একাডেমিক কাজ। দুষ্ট রাজনীতি থাকার কারণে শিক্ষকদের এমন সমস্যার সমাধান করতে হয়, যা একটি সভ্য দেশে কল্পনাই করা যায় না।
বিশ্বের অধিকাংশ ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল চালায় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। আর সত্যিকারের সভ্য দেশে সিনিয়র ছাত্ররাই খণ্ডকালীন কাজ করে। কিন্তু আমাদের দেশে এই দুষ্ট রাজনীতির কারণে ছাত্র হয়ে ছাত্রদের মেরে ফেলার মতো ঘটনা ঘটে বলে শিক্ষকদের এইসব অযাচিত কাজে জড়ানো হয়। যাতে শিক্ষার্থীরা শান্ত থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯টি আবাসিক হল আছে। তার মানে ১৯জন প্রভোস্ট এবং কমপক্ষে ১০০জন আবাসিক শিক্ষক এই হলগুলো পরিচালনা করেন। এটি পুরোপুরি নন-একাডেমিক কাজ।
অথচ শিক্ষার্থীরা সুন্দর সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে এই প্রভোস্টদের কোনো কাজ থাকে না। বরং ছাত্ররা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে হল চালাতে পারে। এইসব দুষ্ট রাজনীতির কারণে ভিসি প্রোভিসিদেরও দিনের বড় একটা সময় কিছু অযাচিত ছাত্র সমস্যার সমাধানে ব্যয় করতে হয়।
কয়েকদিন আগে বেসরকারি এক টেলিভিশন চ্যানেলে আবরার হত্যার পর বুয়েটের সার্বিক পরিবেশ দেখানো হচ্ছে। বুয়েটের পরিবেশের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আসলেই তাই। বুয়েটের কর্তৃপক্ষের পক্ষে এখন অনেক কাজই সহজ হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে
ছাত্ররা যদি নানা সামাজিক ও ছাত্রদের নানা সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতো, তবে এর মাধ্যমে তারা সত্যিকারের নেতৃত্ব শিখতো।
বর্তমান ছাত্ররাজনীতি নেতৃত্ব তো শেখায়ই না বরং অসততা ও মাস্তানি শেখায়। দেখা গিয়েছে, বর্তমানে ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্ররাই ছাত্রনেতা। তারা বারবার ফেল করে। তারা যেহেতু নেতা তাদের পাস করার সুযোগ দেওয়ার জন্য নতুন করে নিয়ম তৈরি করতে হয়। আর এই নিয়ম তৈরি করে নিজেরাই।
একই কথা বলা চলে শিক্ষক রাজনীতির ক্ষেত্রে। শিক্ষক রাজনীতিতে যেই শিক্ষকেরা নেতৃত্ব দেয়, তারা হলো শিক্ষকদের মধ্যে খারাপ মানের শিক্ষক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব যেহেতু তাদের হাতেই চলে গিয়েছে এই নেতৃত্বে আমাদের ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশাও করা যায় না।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়