চীনের দুই অধিবেশন
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে ‘দুই অধিবেশন’ শুরু হতে যাচ্ছে। ইংরেজিতে এই ‘দুই অধিবেশন’-কে বলা হয় ‘Two Sessions’। আর চীনা ভাষায় ‘দুই অধিবেশন’-কে ডাকা হয় ‘লিয়াংহুই’ (‘লিয়াং’ মানে ‘দুই’ এবং ‘হুই’ মানে ‘অধিবেশন’)। চায়না মিডিয়া গ্রুপের বাংলা বিভাগ থেকে প্রচারিত খবর, সংবাদ পর্যালোচনা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে শ্রোতারা ‘দুই অধিবেশন’ শব্দ দুটি শুনছেন এবং সামনের আরও কয়েকদিন শুনবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ‘দুই অধিবেশন’ কী?
সাধারণত প্রতি বছরের বসন্তে তথা মার্চ মাসে চীনে ‘দুই অধিবেশন’ বসে; চলে ১০-১৪ দিন। আসলে চীনের জাতীয় গণকংগ্রেস (এনপিসি) ও চীনা গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন (সিপিপিসিসি)-র জাতীয় কমিটির বার্ষিক অধিবেশন দুটিকেই একত্রে ডাকা হয় ‘দুই অধিবেশন’। এই ‘দুই অধিবেশন’ সাধারণত বছরে একবার আয়োজন করা হয়। সিপিপিসিসি’র অধিবেশনটি খানিকটা আগে শুরু হয়। এর দু-এক দিন বাদে শুরু হয় এনপিসি’র অধিবেশন।
এবারের ‘দুই অধিবেশন’ হচ্ছে ত্রয়োদশ এনপিসি’র চতুর্থ অধিবেশন ও সিপিপিসিসি’র ত্রয়োদশ জাতীয় কমিটির চতুর্থ অধিবেশন। এবার সিপিপিসিসি’র ত্রয়োদশ জাতীয় কমিটির অধিবেশন শুরু হচ্ছে আজ (৪ মার্চ) এবং এনপিসি’র অধিবেশন শুরু হবে ৫ মার্চ। বলা বাহুল্য, চীনের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এই ‘দুই অধিবেশন’-এর গুরুত্ব অপরিসীম। এবারের দুই অধিবেশনে চীনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের চতুর্দশ পাঁচসালা পরিকল্পনা এবং ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন নিয়ে বিশেষ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। বস্তুত, দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ চীনের ‘দুই অধিবেশন’ বিশ্বের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
সিপিপিসিসি কী?
চীনা গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন (সিপিপিসিসি)-র সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দেশের অন্যান্য পার্টির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিপিপিসিসি গড়ে তোলে। শুরুতে এর নাম ছিল ‘রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন’ বা পিসিসি। পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সিপিপিসিসি। পরে প্রথম সিপিপিসিসি-তে ‘সাধারণ কর্মসূচি’ বা ‘কমন প্রোগ্রাম’ অনুমোদিত হয়। এই ‘সাধারণ কর্মসূচি’ই পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য চীনের ডি-ফ্যাক্টো সংবিধান হিসেবে কাজ করে।
প্রথম সিপিপিসিসি-র অধিবেশনই চীনের জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, রাজধানী, রাষ্ট্রের নাম নির্ধারণ করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রথম সরকার নির্বাচন করে। বস্তুত, ১৯৪৯-১৯৫৪ পর্যন্ত সিপিপিসিসি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ডি-ফ্যাক্টো পার্লামেন্ট হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৫৪ সালে, চীনা সংবিধান অনুসারে, পার্লামেন্টের দায়িত্ব অর্পিত হয় জাতীয় গণকংগ্রেস (এনপিসি)-র ওপর। সেই থেকে সিপিপিসিসি দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের ‘পরামর্শক উচ্চ কক্ষের’ মতো দায়িত্ব পালন করে আসছে।
প্রথম সিপিপিসিসি-র অধিবেশনই চীনের জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, রাজধানী, রাষ্ট্রের নাম নির্ধারণ করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রথম সরকার নির্বাচন করে।
বর্তমান সিপিপিসিসি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে না, নীতি নির্ধারণ করে। কিন্তু এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন জাতির গ্রুপ ও সমাজের বিভিন্ন মহলের প্রতিনিধিরা গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিনিময় ও পরামর্শ দিতে পারে। কার্যত, সিপিপিসিসি’র সদস্যরা সরকার, পার্লামেন্ট ও বিচার বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন; বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইস্যুতে পরামর্শ, সমালোচনা ও প্রস্তাব তুলে ধরেন।
সিপিপিসিসি’র সদস্যরা আসেন সমাজের বিভিন্ন স্তর ও জাতিগোষ্ঠী থেকে। সিপিপিসিসি’র ত্রয়োদশ জাতীয় কমিটির চতুর্থ অধিবেশনে সদস্য সংখ্যা হচ্ছেন দুই সহস্রাধিক। সিপিপিসিসি’র ক্ষমতাসীন দল চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি), অন্য ৮টি গণতান্ত্রিক পার্টি, বিভিন্ন গণসংস্থা, বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতি, বিভিন্ন পেশাদার গ্রুপ, হংকং, ম্যাকাও, তাইওয়ান ও বিদেশ ফেরত চীনাদের প্রতিনিধি এবং বিশেষভাবে আমন্ত্রিত ও নির্দলীয় ব্যক্তিবর্গ নিয়ে গঠিত।
সিপিপিসিসি’র ভূমিকা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, সিপিপিসিসি চীনের ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও রেখে যাবে। এ ভূমিকা যেমন হবে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে, তেমনি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদারের স্বার্থেও। সিপিপিসিসি চীনকে সমাজতান্ত্রিক আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে, চীনা জাতির পুনরুত্থানের মহান চীনা স্বপ্ন পূরণে ও একীকরণের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে চীনকে প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাবে। চীনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বহুদলীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ ব্যবস্থা টিকে থাকবে এবং উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকবে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একবার সিপিপিসিসি’র জাতীয় কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক কালে বলেছিলেন, ‘সিপিসি’র নেতৃত্বাধীন বহু পার্টির সহযোগিতা ও রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের ব্যবস্থা চীনের মৌলিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা সিপিসি, চীনা জনগণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টি ও নির্দলীয় ব্যক্তিবর্গের যৌথ উদ্যোগে সৃষ্টি হয়েছে, যা চীনের মাটিতে উন্নত নতুন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা আধুনিক চীনের বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং চীনা জাতির সহনশীলতা ও ‘অমিল পাশে রেখে মিল অন্বেষণ করার’ সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। এটা মানবজাতির রাজনৈতিক সভ্যতায় চীনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান।’
এনপিসি’তে চীনের বিভিন্ন প্রদেশ, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসমূহ, কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত বিভিন্ন শহর, চীনা গণমুক্তি ফৌজ, হংকং ও তাইওয়ানের প্রতিনিধি থাকেন। বছরে একবার এনপিসি’র অধিবেশন বসে।
এখানে আরেকটি কথা জানিয়ে রাখি, সিপিপিসিসি’র জাতীয় কমিটির সদস্যরা জাতীয় গণকংগ্রেসের অধিবেশনেও উপস্থিত থাকেন। তবে, সেখানে তাদের কোনো ভোটাধিকার নেই।
এনপিসি কী?
জাতীয় গণকংগ্রেস (এনপিসি) চীনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সংস্থা। এনপিসি’কে বলা হয় ‘বিশ্বের বৃহত্তম পার্লামেন্ট’। এর সদস্য সংখ্যা প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। অবশ্য এনপিসি’র সদস্য সংখ্যা তিন হাজারের বেশি হতে পারবে না। আইন অনুসারে এরা নির্বাচিত হন ৫ বছরের জন্য।
এনপিসি’তে চীনের বিভিন্ন প্রদেশ, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসমূহ, কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত বিভিন্ন শহর, চীনা গণমুক্তি ফৌজ, হংকং ও তাইওয়ানের প্রতিনিধি থাকেন। বছরে একবার এনপিসি’র অধিবেশন বসে। তবে, এনপিসি’র স্থায়ী কমিটি প্রয়োজন মনে করলে বিশেষ অধিবেশন ডাকতে পারে। তাছাড়া এক-পঞ্চমাংশ বা তার বেশি সদস্য একসঙ্গে অনুরোধ জানালেও বিশেষ অধিবেশন ডাকা হতে পারে।
এনপিসি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট। এনপিসি দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করার, সংবিধান সংশোধন করার, প্রেসিডেন্টসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করে। এছাড়াও এনপিসি রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে এবং সরকারের কাজ সরাসরি তত্ত্বাবধান করে। এনপিসি’র একটি স্থায়ী কমিটি থাকে। এনপিসি যখন অধিবেশনে থাকে না, তখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে স্থায়ী কমিটিই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ। এই দেশে ক্ষমতাসীন দল হচ্ছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)। সিপিসি দেশের সকল রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন গণসংগঠন, বিভিন্ন সংস্থা, পেশাদার গ্রুপ, বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতি, বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপ ও গুরুত্বপূর্ণ নির্দলীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে দেশ শাসনের নীতি মেনে চলে। এটাকেই বলা হয়ে থাকে চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রে তৃণমূল পর্যায়ে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের ভোটাধিকার রয়েছে। ১৮ বছর বয়স হলেই চীনারা তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন। তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পরবর্তী স্তরের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করেন, এই স্তরের প্রতিনিধিরা পরবর্তী স্তরের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন এবং এভাবে শেষ পর্যন্ত এনপিসি’র সদস্যরা নির্বাচিত হন।
আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)