সিনেমা হোক দখিনা হাওয়ায় দুরন্ত পালতোলা নাও
পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি জলবায়ু পরিবর্তন থেকে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সব ক্ষেত্রেই সত্য। এই অভিযোজনে অক্ষমতার কারণে প্রবল প্রতাপশালী বহু প্রাণী যেমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তেমনি বিলুপ্ত হয়েছে মানবজীবনের অপরিহার্য নানান ব্যবহার্যও।
সিনেমা নিয়ে কথা বলব বলে ভাবছিলাম। প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে তাহলে অভিযোজনের প্রশ্নটি কোথা থেকে এলো? বিষয়টা খুব সূক্ষ্ম কিছু নয়। বরং মোটা দাগেই দৃষ্টিগ্রাহ্য।
কয়েক বছরে বাংলা সিনেমা একটি সন্ধিক্ষণ পার করছে। সিনেমা থেকে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে, লগ্নিকারকরা বিকল্প ক্ষেত্র খুঁজছেন, এমনকি অসংখ্য চলচ্চিত্র কর্মী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এমন নানান পরিস্থিতি আমরা দেখেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, এই রূঢ় বাস্তবতা কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে সম্প্রতি সিনেমায় যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা নিয়ে খানিক কথা বলা যেতে পারে।
আরও পড়ুন : শনিবার বিকেল : খুলে যাক রুদ্ধ দ্বার
সাম্প্রতিক সময়ে হ্ঠাৎ করেই যেন সিনেমার সেই মরা গাঙে আবার জোয়ার উঠেছে। ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ সেই জোয়ার তৈরি করেছে, হয়তো এরপর একে একে আরও অনেক চলচ্চিত্র পাল তুলতে শুরু করেছে এবং করবেও।
আমাদের সিনেমার বহুল জনপ্রিয় বাণিজ্যিক ধারার প্রথাগত যে গল্প এবং গল্প বলার ধরন, তার সঙ্গে এই পরিবর্তিত সময় ও রুচির দর্শক আর নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেন না।
এই যে একটা পরিবর্তনের ডামাডোলের কারণ অনুসন্ধানে সিনেমাপ্রেমী প্রতিটি মানুষই সম্ভবত নিজেদের মতো করে নানান ভাবনা ভেবেছেন, যুক্তি-তর্ক, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছেন। কখনো হাহাকার, আক্ষেপ করেছেন, কখনো আশায় বুক বেঁধেছেন। সমাধান বাতলানোর চেষ্টা করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কী ভেবেছি?
সেই উত্তর দেওয়ারই চেষ্টা করব। প্রথমত, ১০-১৫ বছরে ম্যাসিভ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ঘটেছে বিশ্বব্যাপী। তার ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশেও। ফলে ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট দেখার যে দীর্ঘদিনের প্রথাগত অভ্যস্ত পরিসর তাতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে।
পরিবর্তন ঘটেছে। কিংবা সাধারণ দর্শক হঠাৎ করেই বৃহৎ পরিসরে হাতের মুঠোয় ডিজিটাল ডিভাইস পেয়েছেন, বৈচিত্র্যময় ভিজ্যুয়াল কন্টেন্টের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেছেন এবং এগুলো তাদের মনোজগতে নতুন স্বাদ তৈরি করতে শুরু করেছে। তাদের অভ্যস্ত পরিসরের বাইরে নিয়ে গেছে। কিংবা একটি বৃহৎ নতুন প্রজন্ম গড়েই উঠেছে এই পরিবর্তিত বাস্তবতার ভেতর দিয়ে। ফলে তাদের রুচিও গড়ে উঠেছে তার ভিত্তিতে। যা আমাদের পৌনঃপুনিক প্রথাগত গল্পের বয়ান ও প্রেক্ষিত থেকে ভিন্ন। নবতর।
আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী?
অর্থাৎ ইউটিউব, নেটফ্লিক্স কিংবা টেলিভিশনের অসংখ্য চ্যানেলে তারা বিশ্ববিখ্যাত অসাধারণ সব সিনেমা, ভিডিও, ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট দেখে বেড়ে উঠেছে। কিংবা পুরোনোরাও এই নতুন স্বাদে অভ্যস্ত হয়েছেন। আরও বেশি স্বাদ খুঁজে পেয়েছেন। যা অবচেতনেই আমাদের দেশীয় প্রচলিত ভিজ্যুয়াল কন্টেন্টের সঙ্গে ওইসব কন্টেন্টকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই সেখানে আমাদের কন্টেন্ট কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এর কারণ—
প্রথমত, আমাদের সিনেমার বহুল জনপ্রিয় বাণিজ্যিক ধারার প্রথাগত যে গল্প এবং গল্প বলার ধরন, তার সঙ্গে এই পরিবর্তিত সময় ও রুচির দর্শক আর নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেন না।
তারা ততদিনে বৈশ্বিক কন্টেন্টের নিয়মিত দর্শক হয়ে উঠেছেন। তাদের স্বাদ বদলেছে। ফলে তারা বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ বাংলা সিনেমা কিংবা ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট খুঁজতে থাকেন। কিংবা তুলনা করার সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু সেখানে তাদের প্রত্যাশা না মিটলে স্বভাবতই তারা ঝুঁকতে থাকেন বিদেশি কন্টেন্টের দিকে।
এই সময়টা আরও বিপদসংকুল হতে থাকে যখন আমাদের পূর্বতন প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় নির্মাতা ও সফল প্রযোজকেরা নিজেদের ভাবনা ও কাজের নবায়ন না করে, নিজেদের আধুনিকায়নের দিকে মনোযোগী না হয়ে বরং তাদের সেই গৎবাঁধা পুরোনো ফর্মুলায় সফল হওয়ার বেপরোয়া চেষ্টা করতে থাকেন এবং যেকোনো মূল্যে নিজেদের অহংকার ধরে রাখতে থাকেন। কিন্তু তাদের অনেকেরই এই অতীত শৌর্যবীর্যের ইতিহাস, সফলতার সোনালি পরিসংখ্যান, আটপৌরে ভাবনা কিংবা গর্বিত ইমেজ মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে পরিবর্তিত আধুনিক ভাবনা ও বাস্তবতায়।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা
তাদের এতদিনের দক্ষতাও অকার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হতে থাকে। ফলে তারা যখন তাদের নস্টালজিক সময়ের স্মৃতিতে জাবর কেটে পুরাতন সুখানুভূতিতে সওয়ার হওয়ার চেষ্টায় সনাতনী অভ্যস্ত ফর্মুলায় সফল হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন, তখন তার ফলাফল হয় আরও ভয়ানক ।
আমাদের সিনেমা থেকে আমাদের নিজেদের গল্প মোটামুটি হারিয়েই যেতে থাকে। সেখানে জায়গা করে নিতে থাকে কাটপিস, অপ্রয়োজনীয় অশ্লীলতা, ম্যাড়ম্যাড়ে নির্মাণ, খাপছাড়া আকর্ষণহীন একঘেয়ে গল্প কিংবা প্রবল নকল প্রবণতা।
অর্থাৎ সিনেমার যে সন্ধিক্ষণে আমাদের গল্পের, ভাবনার, দর্শনের, এমনকি আঙ্গিকের নবতর বৈচিত্র্যময় উপস্থাপন দরকার ছিল, ক্ষুরধার শৈল্পিক ও বাস্তবিক স্পর্শময়তা অনিবার্য ছিল, ঠিক তখনই আমাদের সিনেমা থেকে হারিয়ে যেতে থাকল আমাদের গল্প। উপেক্ষিত হতে থাকল আমাদের পরিবর্তিত যাপিত জীবন। কিংবা হয়ে উঠতে থাকল গল্পহীন।
আর যে গল্পগুলো তারা তাদের প্রথাগত অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বলতে থাকলেন, আমরা আসলে সেখানে আর নেই। আমাদের সমাজ, আমাদের ভাবনা, অনুভূতি ও তা প্রকাশের ধরন পাল্টেছে। কারণ সময় বদলেছে।
বিস্তৃত প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা আমাদের জীবন ব্যবস্থায়ও বিস্তর পরিবর্তন ঘটিয়েছে। নবায়ন করেছে। কিন্তু আমাদের সিনেমায় সেই পরিবর্তন উঠে আসেনি। চলমান সময়ের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়নি। যাপিত জীবন, গল্প কিংবা অনুভব ধরা দেয়নি। বরং রয়ে গেছে পুরোপুরি অনুপস্থিত।
আরও পড়ুন : এখন তাহলে কোন জীবন থেকে নেবেন?
দ্বিতীয় সংকট আবার ভিন্নভাবে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের অভিযোজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেটি হলো, তরুণ যে নির্মাতারা পুরোনো ধ্যানধারণার বাইরে এসে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে শুরু করলেন, তারা বর্তমান বৈশ্বিক ভাবনার মানদণ্ডে যে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সিনেমায় করছেন, তাতে সিনেমা হয়ে উঠল কেবলই ক্যামেরার কারিকুরি, আলোর লুকোচুরি, কালার, কম্পোজিশন, অ্যাঙ্গেল, সাউন্ডের অত্যাধুনিকরণ। অর্থাৎ গল্পের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল অতিশৈল্পিক দৃশ্যায়ন, যন্ত্রের নানামুখী ব্যবহার। সমস্যা হচ্ছে, সিনেমা ম্যাস মিডিয়া। এর বেশিরভাগ দর্শকই সাধারণ। এরা ক্যামেরার কারিকুরি কিংবা উপস্থাপনের জটিল কলাকৌশল বোঝেন না। বুঝতেও চান না। এরা চান গল্প। যে গল্প তাদের জীবন ও অনুভবের কথা বলবে, স্পর্শ করবে। কিন্তু এখানে কেবল সেই গল্প ছাড়া আর সবই রইল। উন্নত কারিগরি নির্মাণ, চোখ ধাঁধানো দৃশ্যায়ন, অভিনব আলোক প্রক্ষেপণ। সবই। কেবল গল্পের সঙ্গে হৃদয়ের বন্ধন বাদে আর সব।
সিনেমা ম্যাস মিডিয়া। এর বেশিরভাগ দর্শকই সাধারণ। এরা ক্যামেরার কারিকুরি কিংবা উপস্থাপনের জটিল কলাকৌশল বোঝেন না। বুঝতেও চান না। এরা চান গল্প...
মোটা দাগে এই দুটি ‘ফেজ’ আমাদের 'ফেস' করতে হয়েছে। এর বাইরেও অসংখ্য কারণ রয়েছে। কিন্তু সিনেমায় আমাদের তারুণ্যের ভাবনা ও লাইফ স্টাইলের অনুপস্থিতি এবং গল্পের চেয়েও প্রযুক্তিগত সৌকর্য উপস্থাপনের অধিক চেষ্টা সাধারণ দর্শকের সঙ্গে সিনেমার একটা দূরত্ব তৈরি করেছিল। গল্প থেকে গল্প শোনার মানুষদের রেখে দিয়েছিল দূরে। তবে আশার কথা হলো, আমরা সম্ভবত আমাদের এই বোঝাপড়ার সংকট ধীরে হলেও কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছি।
আমাদের সিনেমায় উঠে আসতে শুরু করেছে আমাদের পরিবর্তিত সময় ও জীবনের প্রতিচ্ছবি। একইসঙ্গে সেই উঠে আসা উপস্থাপিতও হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির সৌকর্যতায় সহজবোধ্যভাবে। যা দর্শককে যুক্ত করতে পারছে গল্পে ও গল্পের উপস্থাপনার সঙ্গে। অর্থাৎ একটা সেতু বন্ধন তৈরি হচ্ছে। যা সিনেমায় সবচেয়ে বেশি জরুরি।
আরও পড়ুন : ভাষা আন্দোলনকে নিছক জাতীয়তাবাদী মোচড়ে আমি দেখি না
ফলে দর্শক তার চারপাশে যে অসংখ্য বিকল্প বৈশ্বিক বিনোদনের মাধ্যম রয়েছে, সেসবের মধ্যেও আমাদের সিনেমা ইতিবাচকভাবে তুলনা করতে শুরু করেছে এবং সেই তুলনায় নিজেদের খুঁজে পাচ্ছে অন্তরঙ্গভাবেও।
আমার বিশ্বাস, চলচ্চিত্র নির্মাতারা যত বেশি আমাদের সময়ের পরিবর্তন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনা ও ভাবনা প্রকাশের ধরনের পরিবর্তন, প্রতিক্রিয়া ও প্রণোদনার প্রচলিত প্যাটার্ন পাঠ করতে পারবেন, উপলব্ধি করতে পারবেন, তত বেশি সিনেমাকে ছড়িয়ে দিতে পারবেন বিস্তৃত মানুষের হৃদয়ে।
স্পর্শ করতে পারবেন তাদের জীবনের গল্প, গল্পের জীবন। আর সেটি যদি নিয়মিত হয়, তাহলে সিনেমার এই যে জোয়ার, তা আরও বেগবান হবে। ছুঁয়ে যেতে থাকবে অজস্র মানুষের মন। হয়ে উঠতে থাকবে দখিনা হাওয়ায় দুরন্ত পাল তোলা নাও।
সাদাত হোসাইন ।। কথাসাহিত্যিক