মাদকের অর্থের প্রবাহ ও করণীয়
মাদকাসক্তির করাল গ্রাস আমাদের সমাজে নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, বিশেষত তরুণ সমাজের উপর এর প্রভাব মারাত্মক। মাদকাসক্তির ফলে তরুণ সমাজ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং সেটি আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত এবং স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
মাদকাসক্তদের বিভিন্ন ধরনের মাদকের প্রতি আসক্তির ফলে স্বাস্থ্য সমস্যা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণে পরিবর্তন, অপরাধ বৃদ্ধি এবং অন্যান্য আক্রমণাত্মক কার্যকলাপের কারণ হয়েছে।
মাদক চোরাচালান ও মাদকাসক্তের মতো ব্যাপারগুলোর মূল ভিত্তি হলো ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, জাতিসত্তা ও ঐতিহ্যগত কার্যকারণ। মায়ানমার, লাওস এবং থাইল্যান্ড গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে গঠিত এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, মাদক চোরাচালানের অন্যতম অভয়ারণ্যের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ার কারণে এদেশে মাদকের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে।
আরও পড়ুন : মাদক আইন, নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময়
অন্যদিকে মাদক যেমন ইয়াবা ব্যবসা করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে একটি গোষ্ঠী। এমনকি কখনো বৈধভাবে মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে আবার অবৈধভাবেও এই মাদক ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটেছে।
অনেক সময় মাদকের গডফাদার ও তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে অঢেল সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মাদক চোরাচালান ও মাদকাসক্তের মতো ব্যাপারগুলোর মূল ভিত্তি হলো ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, জাতিসত্তা ও ঐতিহ্যগত কার্যকারণ।
এছাড়াও বিভিন্ন সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তৈরি দেড় শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা ধরে অনুসন্ধান করছে দুদক। কিন্তু তারপরও আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার করা এখনো সম্ভব হয়নি।
১৯৬১ সালের মাদকদ্রব্যের একক কনভেনশন, ১৯৭১ সালের সাইকোট্রপিক সাবস্টেন্সেসের কনভেনশন এবং ১৯৮৮ সালের মাদকদ্রব্য ও সাইকোট্রপিক পদার্থের অবৈধ চোরাচালানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কনভেনশন, এই তিনটি জাতিসংঘের কনভেনশন যা বাংলাদেশ মাদকের অপব্যবহার এবং পাচারের জন্য একটি স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে উল্লেখিত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান যারা মূলত মাদকের অপব্যবহার, চোরাচালান ইত্যাদির তথ্য সংগ্রহ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সাথে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনা এবং অবৈধ মাদকের চোরাচালান রোধের মাধ্যমে ‘ডিমান্ড রিডাকশন’ পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়।
আরও পড়ুন : মাদক এবং ওষুধে ভেজাল রোধ করুন
বাংলাদেশের মাদক আইন শুধুমাত্র বিভিন্ন ওষুধের কয়েকটি শ্রেণিবিন্যাস এবং মাদকাসক্তির জন্য বিভিন্ন ধরনের আইনি অনুমোদন তৈরি করেছে।
যেহেতু আইনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মাদক পাচার নির্মূল করা, তাই এটি বাংলাদেশে মাদকের অপব্যবহার মোকাবিলা করে এবং একটি পুলিশ-পরিষেবা পদ্ধতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আরও বেশি সক্রিয়তার মাধ্যম উল্লেখ রয়েছে।
এইসব সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে মাদকের অপব্যবহার মোকাবিলা করার জন্য সব প্রাসঙ্গিক পক্ষকে জড়িত করে উল্লেখযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক এবং নীতিগত পরিবর্তনের আহ্বান জানায়।
বিভিন্ন সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তৈরি দেড় শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা ধরে অনুসন্ধান করছে দুদক। কিন্তু তারপরও আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার করা এখনো সম্ভব হয়নি।
এছাড়াও কঠোর আইন প্রয়োগ এবং মাদকের অপব্যবহার ও চোরাচালানের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার, ক্রসফায়ারে হত্যা করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সফলভাবে মাদকের চাহিদা হ্রাস করতে পারেনি।
২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অবৈধ মাদকের ব্যবহার ও চোরাচালানের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডে শাস্তির বিধান রেখেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনো অনেক উদ্বেগ রয়েছে আশঙ্কা রয়েছে আইনের বিধান ও আইন প্রয়োগের কার্যকারিতা নিয়ে এবং মাদকের অপব্যবহার প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশের মাস্টার প্ল্যানে এটি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যার মাধ্যমে মাদক থেকে আয়কৃত অর্থ শনাক্তকরণ এবং উদ্ধারকরণ খুব জরুরি।
আরও পড়ুন : হাফিজুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যু ও এলএসডি নিয়ে কিছু প্রশ্ন
টেকসই মাদক নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ মাদক পলিসি প্রবর্তন করা প্রয়োজন। দেশের সীমান্তসহ মাদক প্রবেশের যত রুট রয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশের উদ্যোগে ভারত-মিয়ানমার-বাংলাদেশ নিয়ে ত্রিপক্ষীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ আঞ্চলিক কাঠামো করা মাদক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
একইসাথে অভ্যন্তরীণ সংস্থা যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যৌথ এবং পারস্পারিক সহায়তায় টাস্কফোর্স গঠন করে মাদক ব্যবসার অর্থ ও সম্পদ শনাক্ত ও বাজেয়াপ্তকরণে দল, মত, রাজনীতি নির্বিশেষে আসল অপরাধী আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
খন্দকার ফারজানা রহমান ।। চেয়ারম্যান, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়