ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আজও চলছে
স্বাধীনতা কি একটি ধারণা মাত্র? নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার ক্ষমতা? নাকি স্বাধীনতা আসলে একটা খোলা মাঠ, যারও সীমা আছে? তার একটা পরিসরও আছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে প্রতিরোধের মার্চ মাসে এমন প্রশ্ন আমাদের মগজে আসছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নৃশংস গণহত্যার শিকার বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে যে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং পরবর্তী নয় মাস ধরে প্রাণপণে যে যুদ্ধ চালিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় সম্পন্ন করে, তা ছিল প্রকৃত অর্থে সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। এর আগে ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণেই নির্ধারিত হয়েছিল যে, আমরা বাঙালিরা কোন পথে চলবো।
এই এক সময় পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান ও সাধ্য অনুযায়ী অবদান রেখেছিল। অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাদের কেউ কেউ শহীদ হয়েছেন। ফলে তাদের পরিবার-পরিজন দীর্ঘ দুঃখ-বেদনার মুখোমুখি হয়েছেন, অনেক পরিবার বৈষয়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আবার অস্ত্র হাতে লড়াই করেননি কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন, বাংলার মাটিকে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য বিপজ্জনক ও বৈরী করে তুলেছিলেন, এমন মানুষের সংখ্যাও প্রচুর। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মানুষের পাশে ছিল সমগ্র জাতি।
কিন্তু সেই ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভাজিত করল কে? সেই প্রশ্নের সাথেই শুরুর প্রশ্নের অনেক মিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক-কে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তান ধারায় ফিরে গিয়েছিল এবং একুশ বছর সেভাবেই চলেছে। রাজনীতির কুটিল প্রয়োগ দেশ সম্পর্কে ধারণাটি ছিন্নভিন্ন করে দেয় ১৯৭৫-এ।
অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাদের কেউ কেউ শহীদ হয়েছেন। ফলে তাদের পরিবার-পরিজন দীর্ঘ দুঃখ-বেদনার মুখোমুখি হয়েছেন, অনেক পরিবার বৈষয়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আবার অস্ত্র হাতে লড়াই করেননি কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন, বাংলার মাটিকে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য বিপজ্জনক ও বৈরী করে তুলেছিলেন, এমন মানুষের সংখ্যাও প্রচুর।
সদ্যোজাত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় এমন ঘটনার কারণে দেশ সম্পর্কিত বোধ, স্বাধীনতার ধারণা, ন্যায়-নৈতিকতা বিষয়ে উত্থাপিত প্রশ্ন আজও নির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে যেতে পারেনি। শাসন ক্ষমতা দখল করে সেদিনকার খুনি ও তাদের উপকারভোগীরা আমাদের জন্মভূমিকে বিভাজিত করেছিল। সেই বিভাজন আজও চলছে।
সে বিবেচনায় বলা যেতে পারে, ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশকে আবারও একটা লড়াইয়ের মধ্যে থাকতে হচ্ছে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতা দিবস মানে শুধু সকল বীর সেনানীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্মৃতিসৌধে যাওয়া নয়। বরং তাদের প্রতি, তাদের অভীপ্সার প্রতি, তাদের আত্মত্যাগের প্রতি এবং সর্বোপরি আমাদের অর্জিত স্বাধীনতার প্রতি প্রকৃত ও যথার্থ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
এই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটাই চলছে। স্বাধীনতা দিবস মানে, একটা শপথ গ্রহণের দিন, একটা সংকল্প, একটা অঙ্গীকার গ্রহণের দিন। অনেক কিছুর বিবেচনায় দেশ প্রকৃত অর্থে আজও স্বাধীন হয়নি, কিংবা ১৯৭৫-এর ঘটনা আমাদের নতুন করে পরাজিত করেছে। এদেশে এখনও শোষণ ও বঞ্চনা আছে, আছে দুর্নীতি আর কালোবাজারি, আছে অন্যায় ও অবিচার, অশিক্ষা ও অন্ধকার, দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও বৈষম্য, আছে নারীর নিরাপত্তাহীনতা, জীবন যন্ত্রণায় দগ্ধে যাওয়া, ফতোয়া জারি, ধর্ষণ আর খুন।
স্বাভাবিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রচেষ্টায়, সুশাসনের মাধ্যমে এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে এবং হবেও। কিন্তু বাংলাদেশ আরও এক বড় অসুখের সামনে দাঁড়িয়ে এখন। দেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের জন্য প্রস্তুত, তখন আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে এমন এক তত্ত্বকে, যাকে পরাজিত করেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। এর নাম সাম্প্রদায়িকতা। এই তত্ত্বের প্রবক্তারা আবার যেন আঘাত হানতে শুরু করেছে। আধুনিক শিল্প-সংস্কৃতি বিরোধী শক্তি যেন ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছে পুরনো সাম্প্রদায়িক চেহারাকে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ পর্যন্ত উদারনৈতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে রক্ষিত করা হয়েছিল। এরপরও আমাদের লড়াই ছিল এ পথেই। এখন একটি অরাজনৈতিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী সেই ভিত্তি ভূমিকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে চায়। উগ্র মনোভাবের ভিত্তিতে নতুন কিছু প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থরক্ষার নামে বিভেদের রাজনীতি এবং অসহিষ্ণুতার রাজনীতিকে বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে একটি মহল।
শাসন ক্ষমতা দখল করে সেদিনকার খুনি ও তাদের উপকারভোগীরা আমাদের জন্মভূমিকে বিভাজিত করেছিল। সেই বিভাজন আজও চলছে।
সাম্প্রদায়িকতার এই বীজ বপন করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৭ সালে। ভারত বিরোধিতার নামে ধর্মীয় উন্মাদনা ও ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদ তৈরি করেছিল জিন্নাহ’র পাকিস্তান। কালক্রমে এই সাম্প্রদায়িকতা সমাজে বিভেদের পথ আরও প্রশস্ত করেছিল। শাসকগোষ্ঠী আর ও তাদের অনুচরেরা সেই বিভেদকে নিজের স্বার্থে বারবার উসকে দিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে জাতির জন্য সবচেয়ে বড় খবর এই যে, আমরা এখন আর স্বল্পোন্নত দেশ নই। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে হওয়ার পথে যে কয়টি শর্ত পূরণ করতে হয় তার সবগুলোতে অনেক বেশি পয়েন্ট পেয়েছে।
জাতি যখন নতুনের প্রেরণায়, উন্নয়নের স্পৃহায় জেগে উঠতে চাইছে তখনই প্রবলভাবে যেন প্রকাশ পাচ্ছে ধর্ম বিদ্বেষ। সবসময় এটাই দেখছে বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বর্তমান বাংলাদেশ একই অবস্থায় চলছে। আমরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে সেই শক্তিকে পরাজিত করে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। কিন্তু এইবার শক্তি সঞ্চয় করেছে স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতরে থেকেই। রাজনৈতিক ধার্মিক শ্রেণি এই ধর্মীয় মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে এই উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিমের সরাসরি রাজনৈতিক দল গঠনে উৎসাহ জুগিয়েছিল। ১৯৪৭-এর পর পাকিস্তানিরা আরও বেশি উৎসাহ জুগিয়েছে। করা হয়েছে ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরেও। আজ যে উগ্র ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আমরা দেখছি তার শিকড়ও সেখানে।
ধর্মের জিকির তুলে নিজেদের অশুভ স্বার্থ চরিতার্থ করতে ধর্ম ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটে নেওয়ার চেষ্টা করে। সাধারণ সরল বিশ্বাসী মানুষ রাজনীতির মারপ্যাঁচ না বুঝতে পেরে এদের কথায় উত্তেজিত হয়। মিথ্যার ফাঁদে পা দেয়। শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ সবসময় এদের কারণে আতঙ্ক ও অস্বস্তিতে থাকে। সাধারণ রাজনৈতিক দলগুলোও এদের তোষণ করে ভোটের হিসাব কষে।
দেশের উন্নতি তখনই সম্ভব যদি সঠিক নেতৃত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশে উন্নয়নের নেতৃত্ব আছে। দেশকে সুদৃঢ়ভাবে দাঁড় করানো রাজনীতির আসল পাঠ। সেটা সম্ভব সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে। সে পথে চলুক বাংলাদেশ দ্বিধাহীন ভাবে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি