এক দেব শিশুর জন্মদিন
আজ বঙ্গবন্ধুর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মাত্র ১০ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জীবনদানকারী শেখ রাসেলের জন্মদিন। এই জন্মদিন স্মরণ করে এবং ঘাতকদের হাতে নিপীড়ন, অত্যাচার নির্যাতনে যে শিশুরা জীবন দিয়েছেন, পঙ্গু হয়ে গেছেন, তাদের স্মরণে ও সাহসী শিশু রাসেল এবং অন্যান্যদের প্রতি শ্রদ্ধা-সহমর্মিতা দেখিয়ে আমার আজকের লেখা।
জীবনে বেঁচে থাকলে মালালা ইউসুফ জাইর মতো অন্যায়, মিথ্যা, অসততা, ধর্মান্ধতা ও পৈশাচিকতার প্রতিনিধিত্বকারী মানবরূপী হিংস্র, মোশতাক-জিয়াসহ, যারা গোলাম আজমদের ভৃত্যের অবস্থানে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অকার্যকর করার চেষ্টা করেছিল তাদের বিদায়ের ঘণ্টা বাজিয়ে দিত সেদিনের এই শিশুরা। আমরা ঘৃণাভরে এই পাপিষ্ঠদের প্রত্যাখান করি। রাসেলের জন্মের সময়ের উত্তাল বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর গতিশীল নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকদের ও ধর্মীয় মৌলবাদীদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, বাঙালির সেকালের সমস্ত আন্দোলনের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাভ্যন্তরে ছিলেন তার দেশপ্রেমের খেসারত হিসেবে।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শেখ রাসেলের জন্মদিনে সন্তান সম্ভবা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব নতুন শিশুর আগমণের প্রতীক্ষায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর চার সন্তান শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রেহানা গভীর আগ্রহে এ বাড়িতেই নতুন অতিথি আগমনের অপক্ষোয় ক্ষণ গুনছিলেন।
সেকালের বাংলাদেশে আমাদের মতো লক্ষকোটি শিশুর মতোই বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কোল আলোকিত করে রাসেলের জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু এবং বেগম মুজিবের ইচ্ছা অনুসারেই সমকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও তৃতীয় বিশ্বের মানুষের অধিকার আন্দোলনের নেতা দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামে তার নামকরণ করা হয়। পিতা জেলের অভ্যন্তরে তবুও, এই ছোট্ট শিশুকে নিয়ে তার চার ভাই-বোনের সে কি আনন্দ, ভাষায় তা প্রকাশ করা যায় না। লাফালাফি করে এই সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে কে কতক্ষণ কোলে রাখতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছিল সে রাতে।
এতো সম্ভ্রান্ত ঘরে, এতো ভালোবাসার নিগড়ে, আবদ্ধ ভাই বোন এবং মায়ের আশ্রয়ে লালিত এই শিশুটিকে দেখার সৌভাগ্য তার জীবনের প্রথমদিকে আমার হয়নি। তার ৭ বছর বয়সে ১৯৭২ সালে দীর্ঘ নয় মাস কারা জীবন-যাপনের পর, স্বাধীন বাংলাদেশে সদ্য মুক্তি পাওয়া বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে শিশু রাসেলকেও আমার দেখার সৌভাগ্য হয়। সেই থেকে মৃত্যুদিন পর্যন্ত তার বৈশিষ্টপূর্ণ আচার-আচরণ, আমাকে এবং আমার স্ত্রী-সন্তানকে ওই বাড়িতে গেলেই মোহিত করতো।
আমার ১ বছরের সন্তান রাজিয়া ও জননেত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে কাছে পেলেই, তাদের নিয়ে রাসেল খেলায় মগ্ন হয়ে যেতো। আমাদের এই আনন্দের দিনগুলোকে বিষাদে পরিণত করার ষড়যন্ত্রকারীরা দশ বছরের শিশু রাসেল, চার বছরের শিশু বাবু, অন্তসত্ত্বা আরজু মণি অর্থাৎ জন্মের আগেই যে শিশুর জীবন শেষ হয়ে গেল, পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করলো। জীবিত থাকলে বা জীবন লাভ করলে এরা সবাই পরবর্তী সময়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফ জাই যে হতে পারতো না, তাতো নয়। তালেবানি হত্যার শিকার হয়েও বেঁচে যাওয়া মালালা ইউসুফ জাই যেভাবে আজও নারী ও শিশুদের অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করছেন আমার প্রিয় ভাই শেখ রাসেল নিশ্চয়ই তেমনিভাবে মানবকল্যাণের কাজে আত্মনিয়োগ করতেন। তাই জন্মদিনে তার অকাল মৃত্যুর বেদনা আমাকে তার জীবিত দুই বোনের মতোই অশ্রুসিক্ত করতে থাকে প্রতিনিয়ত।
১৯৭১ সালে পুরো সময়টা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের তখনকার কুখ্যাত ধারক হেনরি কিসিন্জারের সক্রিয় সহযোগিতায় চীনের ত্রাতা মাও সেতুং এর নীরব সমর্থনে বাংলার মানুষের ওপর যে নির্যাতন ও হত্যার খড়গ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, তাদের সৈন্যবাহিনীকে ব্যবহার করে চালিয়েছিল, তাতে লাখ লাখ অবলা নারী ও শিশুকে জীবন বলিদান করতে হয়েছে। শেখ রাসেল ও অন্যান্যরা জীবনে বেঁচে থাকলে, মালালা ইউসুফ জাইয়ের মতো এরাও মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে অবিস্মরণীয় অবদান রাখতে পারতেন। বাংলাদেশকে বুদ্ধিজীবী ও নবজাতক শূন্য করার পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র আংশিকভাবে ব্যর্থ করে দিয়ে আমরা ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হয়েছিলাম।
জন্ম ও শিশুকালে রাসেলের ভাগ্যে পিতার স্নেহ জোটেনি। বাল্যকালে আমরা যারা মা-বাবার কোলে, পরম স্নেহ মমতায় বড় হয়েছি, তাদের মতো রাসেলের জীবনে পিতার স্নেহ পরশ, পিতার কোলে ঘুমানো, পিতার কাঁধে চড়ে বেড়ানো ভাগ্যে জোটেনি। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসেন এবং পরিবার পরিজনের সঙ্গে মিলিত হন। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ তার হয়। এর আগে ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেখ রাসেলের কিছুটা সান্নিধ্য পেয়েছিলেন।
উত্তাল স্বাধীনতাকামী বাঙালির সব আন্দোলনের মূল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন সময় পেলেই রাসেলকে কাছে কাছে রাখতেন, রাসেলও তেমনি বাবার যে সময়টুকু পেতেন, সেই সময়টুকু তার সান্নিধ্য পাওয়ার অবিরাম চেষ্টা করে যেতেন। ৭২ থেকে ৭৫ সাল, এই অল্প সময়কালে যতবারই বঙ্গবন্ধু বিদেশে গেছেন, পিতার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য আকুল রাসেল, প্রায় প্রতিবারই তার সফরসঙ্গী হয়েছেন।
আজও যেমন আমাদের শিশু সন্তানরা যখন বড় হতে থাকে, মা-বাবারা বাইরে কোথাও গেলে সুযোগ থাকলে সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে নিয়ে যান, সেভাবেই আমরা শিশুকালে মা-বাবার সঙ্গে কোথাও যাতায়াতের সুযোগ পেলে যে আনন্দ পেতাম, রাসেলকেও দেখলে মনে হতো যে সে কতো খুশি এবং কত আনন্দিত। আমরা আজো যারা এখনো বেঁচে আছি এবং এই পরিবারের সান্নিধ্য পেয়েছি তাদের স্মৃতিতে রাসেলের হাসিভরা মুখটি উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে প্রতিনিয়ত।
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন শেখ রেহানা এই কষ্ট, শোক ও বেদনাকে হৃদয়ে ধারণ করে গভীর মমতায় বাংলার নিরন্ন, অভাবগ্রস্ত মানুষের জীবনে শান্তির সুবাতাস নিয়ে আসার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন।
শিশু রাসেল, আবুল হাসনাত পুত্র বাবু, পরশ-তাপসের গর্ভধারিণী মা অন্তসত্ত্বা আরজু মণির পেটের শিশুটিকে নৃশংস হত্যাকারীদের, শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করে, আমাদের ধন্য করেছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কল্যাণের কথা ক'দিন আগেও জাতিসংঘের অধিবেশনে জোরালোভাবে বিশ্ববাসীকে জানান দিয়ে শেখ হাসিনা মানবজাতির কল্যাণে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং সহযোগিতার আহবান জানিয়েছেন। তিনি বিশ্বের দুঃখী মানুষকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন।
বাংলাদেশের মানুষের গত প্রায় দুই দশকের উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং প্রতিটি শিশুর সুস্থতা, স্বাস্থ্য রক্ষা এবং প্রতিটি মায়ের ভরণপোষণের জন্য সদা উদগ্রীব ও বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণকারী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ও তার বোন শেখ রেহানার মাধ্যমে রাসেলের অসমাপ্ত জীবনের আকাঙ্খা পূরণ হোক এই কামনা করি।
লেখক : সভাপতি, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ