শঙ্কা নয়, উৎসবের রঙ লাগুক সবার প্রাণে
শারদীয় দুর্গোৎসব। এই উৎসবের সাথে ধর্মের যেমন যোগ আছে, আছে ঋতুর সম্পৃক্ততাও। শরতে হয় বলে শারদীয়া। বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। ‘বাঙালি হিন্দু’ বললাম, দুর্গাপূজা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা যতটা সাড়ম্বরে পালন করেন, অন্য ভাষাভাষী হিন্দুরা ততটা নয়।
আকাশে যখন ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা, উদার প্রকৃতিতে যখন কাশের দোলা; তখনই বাঙালি হিন্দুদের মনে লাগে উৎসবের রঙ। কিন্তু এই উৎসবের রঙের আড়ালেই থাকে শঙ্কার ছোঁয়া। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আকাশে দুর্গাপূজার রঙ দেখেন, বাতাসে পূজার গন্ধ পান। কিন্তু আকাশে-বাতাসে না দেখেও আমরা টের পাই পূজা আসছে।
যখন প্রতিমা ভাঙার খবর পাই, আমরা বুঝে যাই পূজা আসছে। কয়েক বছর ধরেই প্রতিমা ভাঙাতেই পূজার আগমনী বার্তা ঘোষিত হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও পূজার আগেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য গণমাধ্যম দেখলে সেটা টের পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রতিমা ভাঙচুর বা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারের ব্যাপারে বেশ রক্ষণশীল। তবে এই রক্ষণশীলতা আসে গভীর বিবেচনা থেকে।
দিনাজপুরের একটি প্রতিমা ভাঙচুরের খবর প্রচার বা প্রকাশ মানে হলো দেশের আরও অনেক জায়গা সাম্প্রদায়িক পশুদের সজাগ করে দেওয়া। এই কারণে গণমাধ্যম সাধারণভাবে বিচ্ছিন্ন প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা একটু আড়াল করে রাখে। তবে দায়িত্বশীল সব গণমাধ্যমই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির ওপর গভীর মনোযোগ রাখে।
আরও পড়ুন>> ধর্ম যার যার থাকুক, উৎসব হোক সবার
যখনই পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়, তখন আবার সবাই মিলে সংবাদ প্রচার করে, প্রতিরোধের লড়াইয়ে সামিল হয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের এই বিবেচনাবোধ এবং দায়িত্বশীলতাকে আমি সাধুবাদ জানাই।
উৎসবের পাশে শুয়ে থাকা এই শঙ্কা আমাদের লজ্জিত করে। নিজেদের উৎসব আমরা আনন্দের সাথে নির্বিঘ্নে উদযাপন করি। কিন্তু পূজা এলেই আমার হিন্দু বন্ধুটির মনে যখন আনন্দের চেয়ে শঙ্কা বেশি থাকে, তখন লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়।
কিন্তু উৎসবের পাশে শুয়ে থাকা এই শঙ্কা আমাদের লজ্জিত করে। নিজেদের উৎসব আমরা আনন্দের সাথে নির্বিঘ্নে উদযাপন করি। কিন্তু পূজা এলেই আমার হিন্দু বন্ধুটির মনে যখন আনন্দের চেয়ে শঙ্কা বেশি থাকে, তখন লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়।
আমি চাই আমরা সবাই, মানে সব ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের উৎসব উদযাপন করবে। পূজামণ্ডপে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হামলা নয়, মুসলমান যুবকেরা পূজার মণ্ডপ পাহারা দিচ্ছে; আমরা এই সম্প্রীতি দেখতে চাই।
ঈদের আনন্দে যেমন আমার হিন্দু বন্ধু শামিল হয়, আমরাও তাদের পূজার আনন্দে অংশ নিতে চাই। ধর্মীয় উৎসবের দুইটা অংশ। একটা ধর্ম, একটা উৎসব। ধর্মীয় অংশটা শুধু সংশ্লিষ্ট ধর্মের লোকজন পালন করবেন, উৎসব হবে সবার। যেমন আমরা ঈদের নামাজ পড়ি, আর সেমাই খাই সবাই মিলে। তেমনি হিন্দুরা পূজা করে, আনন্দ সবার জন্য।
আরও পড়ুন>> মিলেছি প্রাণের উৎসবে
তেমন একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্যই একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে।
শারদীয় দুর্গোৎসব যাতে নির্বিঘ্নে উদযাপিত হতে পারে, তার জন্য সরকারের চেষ্টার কমতি নেই। এবার ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে, যা গতবারের চেয়ে ৫০টি বেশি। পুলিশ সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকারকে ধন্যবাদ। কিন্তু যেকোনো উৎসবে পুলিশের উপস্থিতি মানেই আমাদের ভেতরে সমস্যা আছে।
শুধু শারদীয় দুর্গোৎসব নয়, পহেলা বৈশাখের আয়োজন, মঙ্গল শোভাযাত্রা, এমনকি মহররমের মিছিলও এখন সাম্প্রদায়িক অপশক্তির টার্গেটের বাইরে নয়। মহররমের মিছিল বা মঙ্গল শোভাযাত্রার চারপাশ যখন পুলিশ বেষ্টিত থাকে, পূজার মণ্ডপের চারপাশে যখন পুলিশ ঘিরে রাখে; তখন আমাদের সমস্যাগুলো স্পষ্ট হয়। পুলিশের উপস্থিতি যত বেশি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তত খারাপ।
ধর্মীয় উৎসবগুলোয় ধর্মের সাথে উৎসবের যোগ থাকে; আর উৎসবের সাথে থাকে অর্থের যোগ। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশেই ধর্মীয় উৎসব ঘিরে চাঙা হয় অর্থনীতি। পশ্চিমা অর্থনীতিতে জোয়ার আনে বড়দিন। বাংলাদেশে রোজার ঈদে খাদ্যপণ্য আর পোশাক ব্যবসায়ীদের রমরমা ব্যবসা হয়। খামারিরা অপেক্ষায় থাকে কোরবানির ঈদের।
এই যে ধর্মের সাথে উৎসবের, উৎসবের সাথে অর্থের, অর্থের সাথে সব মানুষের অংশগ্রহণ; এটাই একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের সত্যিকারের চিত্র।
পহেলা বৈশাখও বাঙালির অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য আনে। সর্বজনীন এই উৎসবে সামিল হন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই। শারদীয় দুর্গোৎসবও বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। কয়েকবছর ধরে কারওয়ানবাজারে মিডিয়াপাড়া পূজার আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ততার সুবাদে কাছ থেকে দেখেছি পূজার সাথে কত মানুষের যোগ।
ধর্মীয় কারণে না হলেও অনেক মানুষ অপেক্ষায় থাকেন পূজার। প্রতিমা বানানো থেকে শুরু করে মণ্ডপ, আলোকসজ্জা, ঢাকি, পুরোহিত, প্রসাদ-সম্পৃক্ততার নানামাত্রিক আয়োজন। ৩২ হাজার ১৬৮টি পূজা মণ্ডপের আয়োজনে কয়েকশ কোটি টাকা ব্যয় হয়। পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব হলেও এর আয়োজনে সব ধর্মের লোকজনের অংশগ্রহণই বেশি থাকে।
মিডিয়াপাড়া পূজার আয়োজনে বেশিরভাগ মানুষই মুসলমান। পূজার অর্থনীতির বড় আয়োজন পোশাককে ঘিরে। মুসলমানদের যেমন ঈদে নতুন জামা চাই, নতুন পোশাক ছাড়া হিন্দুদেরও পূজা অসম্পূর্ণ থাকে। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারের সবার জন্য নতুন পোশাক বিপুল আনন্দ নিয়ে আসে হিন্দুদের ঘরে ঘরে।
প্রতিবার পূজায় আমিও একাধিক নতুন শার্ট বা পাঞ্জাবি উপহার হিসেবে পাই। পূজা উপলক্ষে যে কোটি টাকার কেনাবেচা হয়, তার বড় অংশ কিন্তু মুসলমান ব্যবসায়ীদের দখলে। দুই বছর করোনার কারণে শারদীয় দুর্গোৎসব পূর্ণতা পায়নি। এবার তাই উৎসবের বাঁধভাঙা জোয়ার সর্বত্র।
এই যে ধর্মের সাথে উৎসবের, উৎসবের সাথে অর্থের, অর্থের সাথে সব মানুষের অংশগ্রহণ; এটাই একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের সত্যিকারের চিত্র। কিছু অন্ধকারের অপশক্তি যতই চেষ্টা করুক, বাংলাদেশের সেই চিত্র পাল্টাতে পারবে না।
ধর্ম যার, উৎসব সবার; এই স্লোগানে উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
[email protected]