মেট্রোরেল যেন সুপার শপ না হয়
মেট্রোরেলের ওয়েবসাইটে গেলে বাংলা এবং ইংরেজিতে যে কথাটি দেখা যায়– তা হলো ‘বাঁচবে সময়, বাঁচবে পরিবেশ, যানজট কমাবে মেট্রোরেল’। অর্থাৎ এখানে মূলত তিনটি জিনিসকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে তা হলো সময়, যানজট ও পরিবেশ।
এ তিনটির মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘যানজট’। কারণ যানজট কমাতে পারলে সময় ও পরিবেশ দুটোই অর্জিত হয়ে যাবে। এখন যানজট কমাতে গেলে আগে এর কারণ ভালোভাবে বুঝতে হবে।
ঢাকার যানজটের কারণ নিয়ে অনেক কথা বলা সম্ভব, কিন্তু মূল যে কারণগুলো রয়েছে তা হলো অল্প পরিমাণ রাস্তা, হেঁটে চলার পথের অব্যবস্থাপনা, অল্প সংখ্যক গণপরিবহন আর অধিক সংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল। এখন মেট্রোরেল যেহেতু কোনো সড়কপথ নয় তাই এর নির্মাণের ফলে ঢাকার মোট সড়কের পরিমাণের কোনো পরিবর্তন হবে না।
আরও পড়ুন : পরিকল্পিত মেট্রোরেল কেন জরুরি
ঠিক একই কারণে মেট্রোরেলের ফলে পথচারীদের বর্তমান অবস্থার ও কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু মেট্রোরেল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যানজটের যে দুটি কারণের ওপর প্রভাব ফেলবে তা হল গণপরিবহনের যে ঘাটতি ছিল তা প্রত্যক্ষভাবে দূর করবে এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীরা অধিক হারে মেট্রোরেল ব্যবহারের ফলে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমে যাবে, যা যানজট কমাতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করবে। মূলত এই কারণে মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগ মানুষ মেনে নিয়েছিল।
সম্প্রতি মেট্রোরেলের ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে এবং তা হলো সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা, যা দিয়ে পরবর্তী দুটি স্টেশন যাওয়া যাবে এবং সর্বোচ্চ ভাড়া ৯০ টাকা, যা দিয়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল (প্রায় ১৯.৮ কিমি) পর্যন্ত যাওয়া যাবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআর টি) লাইন ৬ এ ১৬টি স্টেশন আছে। প্রতিটি স্টেশনের মাঝের গড় দূরত্ব এক কিলোমিটারের কিছু বেশি।
গণপরিবহনের বিকল্প ও ব্যক্তিগত গাড়ি হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে এই ভাড়া একটা বড় অন্তরায় হতে পারে।
এখন আমরা যদি ধরে নেই যে কর্তৃপক্ষ মেট্রোরেলের পরিচালনা ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ও অন্যান্য খরচ বিবেচনা করে এই ভাড়া নির্ধারণ করেছে, তাহলে তাত্ত্বিকভাবে মেট্রোরেল সফল বা লাভবান একটা প্রজেক্ট হয়ত হবে, কিন্তু বাস্তবিকভাবে যদি এ পরিমাণ ভাড়া বাস্তবায়ন হয় তাহলে মেট্রোরেলের মূল যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ যানজট নিরসন তা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। এ আশঙ্কা করার কারণ হলো গণপরিবহনের বিকল্প ও ব্যক্তিগত গাড়ি হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে এই ভাড়া একটা বড় অন্তরায় হতে পারে।
প্রথমত, আমদের দেশে যারা গণপরিবহন বা বাসে চলাচল করে তারা ওই বাসের ভেতরের ময়লা আসন বা ভিড়, অনেকটা বাধ্য হয়ে সহ্য করে, কারণ তারা খুব অল্প খরচে যাতায়াত করতে পারে। মেট্রোরেলের রুটের সঙ্গে যদি তুলনা করি, তাহলে বাসে করে উত্তরা থেকে মতিঝিল আসতে একজন যাত্রীর খরচ হয় ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা।
এই রুটে কিছু এসি বাস চলাচল করে, যেখানে ভাড়া মেট্রোরেলের প্রস্তাবিত ভাড়ার প্রায় সমান। যারা বর্তমানে এসি বাসে চলছে স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামের জন্য তাদের জন্য মেট্রোরেল এ চলাচল কোনো সমস্যা না হলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে এ সংখ্যাটা খুব বেশি নয়।
আরও পড়ুন : এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!
এখন মেট্রোরেলকে যদি গণপরিবহন হতে হয় তাহলে এর ভাড়া সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে থাকতে হবে। বর্তমানে একটি পরিবারের একজন মানুষ যদি বাইরে যাতায়াত করে তাহলে বাসে করে যাওয়া ও আসায় তার দৈনিক খরচ হবে প্রায় ১০০ টাকা। অন্যদিকে মেট্রোরেলে করে সেই একই যাত্রী হয়ত অনেক কম সময়ে তার গন্তব্যে যেতে পারবে, কিন্তু এই আকর্ষণ বেশিদিন থাকবে না যখন তিনি দেখবেন যে তার যাতায়াত খরচ একলাফে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
অনেকেই হয়ত সকালে সময়মত অফিসে যাওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে মেট্রো ব্যাবহার করলেও ফেরার সময় আগের মতই গণপরিবহন ব্যাবহার করে ব্যয় সংকুচিত করতে পারে। এছাড়াও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যখন রাস্তা তুলনামূলক ফাঁকা থাকে তখন যাত্রীরা এত অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে মেট্রো ব্যাবহার নাও করতে পারে। মনে রাখতে হবে, আমরা যদি বাসের যাত্রীদের মেট্রোরেল এ স্থানান্তর করতে না পারি তাহলে এত বিনিয়োগের সুফল পাওয়া যাবে না।
ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তার মাঝে নির্মিত মেট্রো স্টেশনে পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় অনেকেই বাসা থেকে রিকশা বা হেঁটে মেট্রো স্টেশন এ আসার চাইতে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে চলাচলে স্বাচ্ছন্দ্য পেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, যানজট কমাতে হলে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের সংখ্যা কমাতে হবে এবং এর ব্যবহারকারীদের মেট্রোরেলে স্থানান্তর করতে হবে। সাধারণত মেট্রো স্টেশন এ গাড়ি পার্ক করা, বাইসাইকেল বা মোটর সাইকেল রাখার জায়গা আলাদা করে দেওয়া থাকে। এর ফলে, একজন ব্যক্তি বাসা থেকে ব্যক্তিগত বাহনে মেট্রো স্টেশন এ এসে গাড়িটি সারাদিন পার্ক করে রেখে বিকেলে আবার একইভাবে ফিরতে পারে। কিন্তু ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তার মাঝে নির্মিতি মেট্রো স্টেশনে পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় অনেকেই বাসা থেকে রিকশা বা হেঁটে মেট্রো স্টেশন এ আসার চাইতে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে চলাচলে স্বাচ্ছন্দ্য পেতে পারে।
এ ধরনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গাড়ি বা মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের মেট্রোরেলের প্রতি আকৃষ্ট করার ভালো একটা উপায় হতে পারত স্বল্প ভাড়া নির্ধারণ। কিন্তু রাজধানীতে যেখানে গড়ে ৬০০ টাকার সিএনজি ফুয়েল গাড়িতে থাকলে প্রায় ৮ ঘণ্টা চলাচল করা যায়, সেখানে মেট্রোতে একবার যাওয়া এবং আসাতেই যদি ২০০ টাকা খরচ হয় এবং মেট্রো থেকে নেমে অন্য কোনো উপায়ে গন্তব্যে যেতে হয় তাহলে মেট্রোরেলের প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে।
আরও পড়ুন : চট্টগ্রামে মেট্রোরেল : সম্ভাবনা ও কিছু ভাবনা
মেট্রোরেলের মতো একটি ব্যয়বহুল, যানজট নিরসনে পরিক্ষিত ও নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যমের সফলতা নির্ভর করে কত বেশি তা গণমানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারলে তার ওপর। গণমানুষকে সম্পৃক্ত করার কার্যকর একটা মাধ্যম হলো সহনশীল ও অন্যান্য বিকল্প মাধ্যমের তুলনায় সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাড়া নির্ধারণ।
এক্ষেত্রে অল্প লাভ রেখে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়িয়ে ব্যবসায়িকভাবে যেমন সরকার লাভবান হতে পারে তেমনি যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে।
এছাড়াও ছুটির দিনে ভাড়া অর্ধেক নির্ধারণ করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, একটু স্বস্তি বা ঝামেলামুক্ত ভাবে বাজার করার জন্য যিনি সুপার শপে যান তিনি সুবিধামত ফুটপাত থেকেও একই জিনিস কিনতে পারেন, কিন্তু যিনি কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য ফুটপাত থেকে বাজার করেন তার কাছে সুপার শপের শীতল পরিবেশ বা আরাম মুখ্য নয়। মেট্রোরেল একটি গণপরিবহন, আমরা যেন একে সুপার শপ সেবায় পরিণত না করি।
কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট